Twitter

Follow palashbiswaskl on Twitter

Saturday, January 22, 2011

সোজন বাদিয়ার ঘাট

সোজন বাদিয়ার ঘাট

"সে সময় মোর কি করে কাটিবে
মনে হবে যবে সারাটি জনম হায়
কঠিন কঠোর মিথ্যার পাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া
খোঁয়ায়েছি আপনায়।"

সোজন-বাঁদিয়ার ঘাট, জসীমউদ্দীন।

তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার় তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার বাড়ি ছিলো একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগদেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ

১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে সমাধিস্থ করা হয়।
তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার় তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার বাড়ি ছিলো একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগদেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ

১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে সমাধিস্থ করা হয়

জসীমউদ্দীন

 


জনপ্রিয় বাংলাদেশি কবি,লোকসাহিত্য সংগ্রাহক, রেডিও ব্যক্তিত্ব .
 

জসীমউদ্দীন ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার় তাম্বুলখানা গ্রামে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা আনসার উদ্দিন মোল্লা, পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তার মায়ের নাম আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। জসীমউদ্দীনের পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা। যদিও পরে তিনি জসীমউদ্দীন নামেই পরিচিত হন। তিনি ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। ১৯২১ সনে এখান থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি. এ. এবং এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৩৮ সনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী বাদ দিয়ে রেডিও তে যোগদান করেন।জসীমউদ্দীন ছোট কাল থেকেই লেখালেখি করতেন। তিনি কলেজে পরা অবস্থায় কবর কবিতাটি লেখেন যা তাকে পাঠকদের মাঝে পরিচিত করে তোলে। তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তখন কবর কবিতাটিকে প্রবেশিকা পরীক্ষার সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার লেখা "নকশী কাথার মাঠ" বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। রাখালী, বালু চর, ধানখেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, হাসু ,রঙিলা নায়ের মাঝি তার জনপ্রিয় রচনা।বাংলাদেশের পল্লী এলাকার সাধারন মানুষের সুখ-দু:খ, হাসি-কান্না তার লেখায় সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।তাই বাংলার মানুষ তাকে পল্লী কবি অভিধায় অভিসিক্ত করেছে।তিনি অনেক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরমেন্স, একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর) অন্যতম। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করে।১৯৭৪ সনে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কারে মনোনীত হন কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।পল্লী কবি জসীমউদ্দীন ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে তাকে সমাহিত করা হয়।



  1. বেদের বেসাতি [ সোজন বাদিয়ার ঘাট ]
****************************************************

নমুদের কালো মেয়ে

ইতল বেতল ফুলের বনে ফুল ঝুর ঝুর করেরে ভাই।
ফুল ঝুর ঝুর করে ;
দেখে এলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে।
ধানের আগায় ধানের ছড়া, তাহার পরে টিয়া,
নমুর মেয়ে গা মাজে রোজ তারির পাখা দিয়া,
দুর্বাবনে রাখলে তারে দুর্বাতে যায় মিশে,
মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে।
লাউয়ের ডগায় লাউয়ের পাতা, রৌদ্রেতে যায় ঊনে,
গা-ভরা তার সোহাগ দোলে তারির লতা বুনে।
যে পথ দিয়ে যায় চলে সে, যে পথ দিয়ে আসে,
সে পথ দিয়ে মেঘ চলে যায়, বিজলী বরণ হাসে।
বনের মাঝে বনের লতা, পাতায় পাতায় ফুল,
সেও জানে না নমু মেয়ের শ্যামল শোভার তুল।
যে মেঘের জড়িয়ে ধরে হাসে রামের ধনু,
রঙিন শাড়ী হাসে যে তার জড়িয়ে সেই তনু।

গায়ে তাহার গয়না নাহি, হাতে কাচের চুড়ি;
দুই পায়েতে কাঁসার খাড়ু, বাজছে ঘুরি ঘুরি।
এতেই তারে মানিয়েছে যা তুলনা নেই তার;
যে দেখে সে অমনি বলে, দেখে লই আরবার।
সোনা রুপার গয়না তাহার পরিয়ে দিলে গায়,
বাড়ত না রুপ, অপমানই করতে হত তায়।
ছিপছিপে তার পাতলা গঠন, হাত চোখ মুখ কান,
দুলছে হেলছে মেলছে গায়ে গয়না শতখান ।

হ্যাচড়া পুজোর ছড়ার মত ফুরফুরিয়ে ঘোরে
হেথায় হোথায় যথায় তথায় মনের খুশীর ভরে।
বেথুল তুলে, ফুল কুড়িয়ে, বেঙ্গে ফলের ডাল,
সারাটি গাঁও টহল দিয়ে কাটে তাহার কাল।
পুুতুল আছে অনেকগুলো, বিয়ের গাহি গান,
নিমন্ত্রণে লোক ডাকি সে হয় যে লবেজান।
এসব কাজে সোজন তাহার সবার চেয়ে সেরা,
ছমির শেখের ভাজন বেটা, বাবরি মাথায় ঘেরা।
কোন বনেতে কটার বাসার বাড়ছে ছোট ছানা,
ডাহুক কোথায় ডিম পাড়ে তার নখের আগায় জানা।
সবার সেরা আমের আঁটির গড়তে জানে বাঁশী,
উঁচু ডালে পাকা কুলটি পাড়তে পারে হাসি।
বাঁশের পাতায় নথ গড়ায়ে গাবের গাঁথি হার,
অনেক কালই জয় করেছে শিশু মনটি তার।

*****************************************************

নীড়

গড়াই নদীর তীরে,
কুটিরখানিরে লতা-পাতা-ফুল মায়ায় রয়েছে ঘিরে।
বাতাসে হেলিয়া, আলোতে খেলিয়া সন্ধ্যা সকালে ফুটি,
উঠানের কোণে বুনো ফুলগুলি হেসে হয় কুটি কুটি।
মাচানের পরে সীম-লতা আর লাউ কুমড়ার ঝাড়,
আড়া-আড়ি করি দোলায় দোলায় ফুল ফল যত যার।
তল দিয়ে তার লাল নটেশাক মেলিছে রঙের ঢেউ,
লাল শাড়ীখানি রোদ দিয়ে গেছে এ বাড়ির বধূ কেউ।
মাঝে মাঝে সেথা এঁদো ডোবা হতে ছোট ছোট ছানা লয়ে,
ডাহুক মেয়েরা বেড়াইতে আসে গানে গানে কথা কয়ে!
গাছের শাখায় বনের পাখিরা নির্ভয়ে গান ধরে,
এখনো তাহারা বোঝেনি হেথায় মানুষ বসত করে।

মটরের ডাল, মসুরের ডাল, কালিজিড়া আর ধনে,
লঙ্কা-মরিচ রোদে শুখাইছে উঠানেতে সযতনে।
লঙ্কার রঙ মসুরের রঙ, মটরের রঙ আর,
জিড়া ও ধনের রঙের পাশেতে আলপনা আঁকা কার।
যেন একখানি সুখের কাহিনী নানান আখরে ভরি,
এ বাড়ির যত আনন্দ হাসি আঁকা জীবন- করি।
সাঁঝ সকালের রঙিন মেঘেরা এখানে বেড়াতে এসে,
কিছুখন যেন থামিয়া রয়েছে এ বাড়িরে ভালবেসে।
সামনে তাহার ছোট ঘরখানি ময়ূর পাখির মত,
চালার দুখানা পাখনা মেলিয়া তারি ধ্যানে আছে রত।
কুটিরখানির একধারে বন, শ্যাম-ঘন ছায়াতলে,
মহা-রহস্য লুকাইয়া বুকে সাজিছে নানান ছলে।
বনের দেবতা মানুষের ভয়ে ছাড়ি ভূমি সমতল,
সেথায় মেলিছে অতি চুপি চুটি সৃষ্টির কৌশল;
লতা-পাতা ফুল ফলের ভাষায় পাখিদের বুনো সুরে।
তারি বুকখানি সারা বন বেড়ি ফিরিতেছে সদা ঘুরে।
ইহার পাশেতে ছোট গেহ-খনি, এ বনের বন-রাণী,
বনের খেলায় হয়রান হয়ে শিথিল বসনখানি;
ইহার ছায়ায় মেলিয়া ধরিয়া শুয়ে ঘুম যাবে বলে,
মনের মতন করিয়া ইহারে গড়িয়াছে নানা ছলে।

সে ঘরের মাঝে দুটি পা মেলিয়া বসিয়া একটি মেয়ে ,
পিছনে তাহার কালো চুলগুলি মাটিতে পড়েছে বেয়ে।
দুটি হাতে ধরি রঙিন শিকায় রচনা করিছে ফুল,
বাতাসে সরিয়া মুখে উড়িতেছে কভু দু একটি চুল।
কুপিত হইয়া চুলেরে সরাতে ছিড়িছে হাতের সূতো,
চোখ ঘুরাইয়া সুতোরে শাসায় করিয়া রাগের ছুতো।
তারপর শেষে আপনার মনে আপনি উঠিছে হাসি,
আরো সরু সরু ফুল ফুটিতেছে শিকার জালেতে আসি।
কালো মুখখানি, বন-লতা পাতা আদর করিয়া তায়,
তাহাদের গার যত রঙ যেন মেখেছে তাহার গায়।
বনের দুলালী ভাবিয়া ভাবিয়া বনের শ্যামল কায়া;
জানে না, কখন ছড়ায়েছে তার অঙ্গে বনের ছায়া।
আপনার মনে শিকা বুনাইছে, ঘরের দুখানা চাল,
দুখানা রঙিন ডানায় তাহারে করিয়াছে আবডাল।
আটনের গায়ে সুন্দীবেতের হইয়াছে কারুকাজ
বাজারের সাথে পরদা বাঁধন মেলে প্রজাপতি সাজ।
ফুস্যির সাথে রাঙতা জড়ায়ে গোখুরা বাঁধনে আঁটি,
উলু ছোন দিয়ে ছাইয়াছে ঘর বিছায়ে শীতল পাটি।
মাঝে মাঝে আছে তারকা বাঁধন, তারার মতন জ্বলে,
রুয়ার গোড়ায় খুব ধরে ধরে ফুলকাটা শতদলে।
তারি গায় গায় সিদুরের গুড়ো, হলুদের গুড়ো দিয়ে,
এমনি করিয়া রাঙায়েছে যেন ফুলেরা উঠেছে জিয়ে।
একপাশে আশে ফুলচাং ভাল বলা যায়নাক ত্বরা।
তার সাথে বাঁধা কেলী কদম্ব ফুল-ঝুরি শিকা আর,
আসমান-তারা শিকার রঙেতে সব রঙ মানে হার।
শিকায় ঝুলানো চিনের বাসন, নানান রঙের শিশি,
বাতাসের সাথে হেলিছে দুলিছে রঙে রঙে দিবানিশি।
তাহার নীচেতে মাদুর বিছায়ে মেয়েটি বসিয়া একা,
রঙিন শিকার বাঁধনে বাঁধনে রচিছে ফুলের লেখা।

মাথার উপরে আটনে ছাটনে বেতের নানান কাজ,
ফুলচাং আর শিকাগুলি ভরি দুলিতেছে নানা সাজ।
বনের শাখায় পাখিদের গান, উঠানে লতার ঝাড়
সবগুলো মিলে নির্জ্জনে যেন মহিমা রচিছে তার।
মেয়েটি কিন্তু জানে না এ সব, শিকায় তুলিছে ফুল,
অতি মিহি সুরে গান সে গাহিছে মাঝে মাঝে করি ভুল।
বিদেশী তাহার স্বামীর সহিত গভীর রাতের কালে,
পাশা খেলাইতে ভানুর নয়ন জড়াল ঘুমের জালে।

ঘুমের ঢুলুনী, ঘুমের ভুলুনী-সকালে ধরিয়া তায়,
পাল্কীর মাঝে বসাইয়া দিয়া পাঠাল স্বামীর গাঁয়।
ঘুমে ঢুলু আঁখি, পাল্কী দোলায় চৈতন হল তার,
চৈতন হয়ে দেখে সে ত আজ নহে কাছে বাপ-মার।
এত দরদের মা-ধন ভানুর কোথায় রহিল হায়,
মহিষ মানত করিত তাহার কাঁটা যে ফুটিলে পায়।
হাতের কাঁকনে আঁচড় লাগিলে যেত যে সোনারু বাড়ি,
এমন বাপেরে কোন দেশে ভানু আসিয়াছে আজ ছাড়ি।
কোথা সোহাগের ভাই-বউ তার মেহেদী মুছিলে হায়,
সাপন সীথার সিদুর লইত ঘষিতে ভানুর পায়।
কোথা আদরের মৈফল-ভাই ভানুর আঁচল ছাড়ি,
কি করে আজিকে দিবস কাটিছে একা খেলাঘরে তারি।

এমনি করিয়া বিনায়ে বিনায়ে মেয়েটি করিছে গান,
দূরে বন পথে বউ কথা কও পাখি ডেকে হয়রান।
সেই ডাক আরো নিকটে আসিল, পাশের ধঞ্চে-খেতে
তারপর এলো তেঁতুলতলায় কুটিরের কিনারেতে
মেয়েটি খানিক শিকা তোলা রাখি অধরেতে হাসি আঁকি,
পাখিটিরে সে যে রাগাইয়া দিল বউ কথা কও ডাকি।
তারপর শেষে আগের মতই শিকায় বসাল মন,
ঘরের বেড়ার অতি কাছাকাছি পাখি ডাকে ঘন ঘন।
এবার সে হল আরও মনোযোগী, শিকা তোলা ছাড়া আর,
তার কাছে আজ লোপ পেয়ে গেছে সব কিছু দুনিয়ার।
দোরের নিকট ডাকিল এবার বউ কথা কও পাখি,
বউ কথা কও, বউ কথা কও, বারেক ফিরাও আঁখি।
বউ মিটি মিটি হাসে আর তার শিকায় যে ফুল তোলে,
মুখপোড়া পাখি এবার তাহার কানে কানে কথা বলে।
যাও ছাড়-লাগে, এবার বুঝিনু বউ তবে কথা কয়,
আমি ভেবেছিনু সব বউ বুঝি পাখির মতন হয়।
হয়ত এমনি পাখির মতন এ ডাল ও ডাল করি,
বই কথা কও ডাকিয়া ডাকিয়া জনম যাইবে হরি,
হতভাগা পাখি! সাধিয়া সাধিয়া কাঁদিয়া পাবে না কূল,
মুখপোড়া বউ সারাদিন বসি শিকায় তুলিবে ফুল।
ইস্যিরে মোর কথার নাগর! বলি ও কি করা হয়,
এখনি আবার কুঠার নিলে যে, বসিতে মন না লয়?
তুমি এইবার ভাত বাড় মোর, একটু খানিক পরে,
চেলা কাঠগুলো ফাঁড়িয়া এখনি আসিতেছি ঝট করে।

কখনো হবে না, আগে তুমি বস, বউটি তখন উঠি,
ডালায় করিয়া হুড়ুমের মোয়া লইয়া আসিল ছুটি।
একপাশে দিল তিলের পাটালী নারিকেল লাড়ু আর
ফুল লতা আঁকা ক্ষীরের তক্তি দিল তারে খাইবার।
কাঁসার গেলাসে ভরে দিল জল, মাজা ঘষা ফুরফুরে
ঘরের যা কিছু মুখ দেখে বুঝি তার মাঝে ছায়া পূরে।
হাতেতে লইয়া ময়ূরের পাখা বউটি বসিল পাশে,
বলিল, এসব সাজায়ে রাখিনু কোন দেবতার আশে?
তুমিও এসো না! হিন্দুর মেয়ে মুসলমানের সনে
খাইতে বসিয়া জাত খোয়াইব তাই ভাবিয়াছ মনে?
নিজেরই জাতিটা খোয়াই তাহলেবড় গম্ভীর হয়ে,
টপটপ করে যা ছিল সোজন পুরিল অধরালয়ে।

বউ ততখনে কলিকার পরে ঘন ঘন ফুঁক পাড়ি,
ফুলকি আগুন ছড়াইতেছিল দুটি ঠোট গোলকরি।
দুএক টুকরো ওড়া ছাই এসে লাগছিল চোখে মুখে,
ঘটছিল সেথা রূপান্তর যে বুঝি না দুখে কি সুখে।
ফুঁক দিতে দিতে দুটি গাল তার উঠছিল ফুলে ফুলে,
ছেলেটি সেদিকে চেয়ে চেয়ে তার হাত ধোয়া গেল ভুলে।
মেয়ে এবার টের পেয়ে গেছে, কলকে মাটিতে রাখি,
ফিরিয়া বসিল ছেলেটির পানে ঘুরায়ে দুইটি আঁখি।

তারপর শেষে শিকা হাতে লয়ে বুনাতে বসিল ত্বরা,
মেলি বাম পাশে দুটি পাও তাতে মেহেদীর রঙ ভরা।
নীলাম্বরীর নীল সায়রেতে রক্ত কমল দুটি,
প্রথমভোরের বাতাস পাইয়া এখনি উঠিছে ফুটি।
ছেলেটি সেদিক অনিমেষ চেয়ে, মেয়েটি পাইয়া টের,
শাড়ীর আঁচলে চরণ দুইটি ঢাকিয়া লইল ফের।

ছেলেটি এবার ব্যস্ত হইয়া কুঠার লইল করে,
এখনি সে যেন ছুটিয়া যাইবে চেলা ফাড়িবার তরে।
বউটি তখন পার আবরণ একটু লইল খুলি,
কি যেন খুঁজিতে ছেলেটি আসিয়া বসিল আবার ভুলি।
এবার বউটি ঢাকিল দুপাও শাড়ীর আঁচল দিয়ে,
ছেলেটি সজোরে কলকে রাখিয়া টানিল হুকোটি নিয়ে।
খালি দিনরাত শিকা ভাঙাইবে? হুকোয় ভরেছ জল?
কটার মতন গন্ধ ইহার একেবারে অবিকল।
এক্ষুণি জল ভরিণু হুকায়। দেখ! রাগায়ো না মোরে,
নৈচা আজিকে শিক পুড়াইয়া দিয়েছিলে সাফ করে?
কটর কটর শব্দ না যেন মুন্ড হতেছে মোর,
রান্নাঘরেতে কেন এ দুপুরে দিয়ে দাও নাই দোর?
এখনি খুলিলে? কথায় কথায় কথা কর কাটাকাটি,
রাগি যদি তবে টের পেয়ে যাবে বলিয়া দিলাম খাঁটি!

মিছেমিছি যদি রাগিতেই সখ, বেশ রাগ কর তবে,
আমার কি তাতে, তোমারি চক্ষু রক্ত বরণ হবে।
রাগিবই তবে? আচ্ছা দাঁড়াও মজাটা দেখিয়া লও,
যখন তখন ইচ্ছা মাফিক যা খুশী আমারে কও!
এইবার দেখ! না! না! তবে আর রাগিয়া কি মোর হবে,
আমি ত তোমার কেউ কেটা নই খবর টবার লবে?

বউটি বসিয়াশিকা ভাঙাইতেছে, আর হাসিতেছে খালি,
প্রতিদিন সে ত বহুবার শোনে এমনি মিষ্ট গালি।

*******************************************************

পলায়ন

নমুর পাড়ায় বিবাহের গানে আকাশ বাতাস
উঠিয়াছে আজি ভরি,
থাকিয়া থাকিয়া হইতেছে উলু, ঢোল ও সানাই
বাজিতেছে গলা ধরি।
রামের আজিকে বিবাহ হইবে, রামের মায়ের
নাহি অবসর মোটে;
সোনার বরণ সীতারে বরিতে কোনখানে আজ
দূর্বা ত নাহি জোটে।
কোথায় রহিল সোনার ময়ূর, গগনের পথে
যাওরে উড়াল দিয়া,
মালঞ্চঘেরা মালিনীর বাগ হইতে গো তুমি
দূর্বা যে আনো গিয়া।

এমনি করিয়া গেঁয়ো মেয়েদের করুণ সুরের
গানের লহরী পরে,
কত সীতা আর রাম লক্ষণ বিবাহ করিল
দূর অতীতের ঘরে।
কেউ বা সাজায় বিয়েরে কনেরে, কেউ রাঁধে রাড়ে
ব্যস্ত হইয়া বড়,
গদাই নমুর বাড়িখানি যেন ছেলেমেয়েদের
কলরবে নড় নড়।
দূর গাঁর পাশে বনের কিনারে দুজন কাহারা
ফিস্ ফিস্ কথা কয়!
বিবাহ বাড়ির এত সমারোহ সেদিকে কাহারো
ভ্রক্ষেপ নাহি হায়!

সোজন, আমার বিবাহ আজিকে, এই দেখ আমি
হলুদে করিয়া স্নান,
লাল-চেলী আর শাঁখা সিন্দুর আলতার রাগে
সাজিয়েছি দেহখান।
তোমারে আজিকে ডাকিয়াছি কেন, নিকটে আসিয়া
শুন তবে কান পাতি,
এই সাজে আজ বাহির যেথা যায় আঁখি,
তুমি হবে মোর সাথী।

কি কথা শুনালে অবুঝ! এখনো ভাল ও মন্দ
বুঝিতে পারনি হায়,
কাঞ্চাবাঁশের কঞ্চিরে আজি যেদিকে বাঁকাও
সেদিকে বাঁকিয়ে যায়।

আমার জীবনে শিশুকাল হতে তোমারে ছাড়িয়া
বুঝি নাই আর কারে,
আমরা দুজনে একসাথে রব, এই কথা তুমি
বলিয়াছ বারে বারে।
এক বোঁটে মোরা দুটি ফুল ছিনু একটিরে তার
ছিঁড়ে নেয় আর জনে;
সে ফুলেরে তুমি কাড়িয়া লবে না? কোন কথা আজ
কহে না তোমার মনে?
ভাবিবার আর অবসর নাহি, বনের আঁধারে
মিশিয়াছে পথখানি,
দুটি হাত ধরে সেই পথে আজ, যত জোরে পার
মোরে নিয়ে চল টানি।
এখনি আমারে খুঁজিতে বাহির হইবে ক্ষিপ্ত
যত না নমুর পাল,
তার আগে মোরা বন ছাড়াইয়া পার হয়ে যাব
কুমার নদীর খাল।
সেথা আছে ঘোর অতসীর বন, পাতায় পাতায়
ঢাকা তার পথগুলি,
তারি মাঝ দিয়া চলে যাব মোরা, সাধ্য কাহার
সে পথের দেখে ধুলি।

হায় দুলী! তুমি এখনো অবুঝ, বুদ্ধি-সুদ্ধি
কখন বা হবে হায়,
এ পথের কিবা পরিণাম তুমি ভাবিয়া আজিকে
দেখিয়াছ কভু তায়?
আজ হোক কিবা কাল হোক, মোরা ধরা পড়ে যাব
যে কোন অশুভক্ষণে,
তখন মোদের কি হবে উপায়, এই সব তুমি
ভেবে কি দেখেছ মনে?
তোমারে লইয়া উধাও হইব, তারপর যবে
ক্ষিপ্ত নমুর দল,
মোর গাঁয়ে যেয়ে লাফায়ে পড়িবে দাদ নিতে এর
লইয়া পশুর বল;
তখন তাদের কি হবে উপায়? অসহায় তারা
না না, তুমি ফিরে যাও!
যদি ভালবাস, লক্ষ্মী মেয়েটি, মোর কথা রাখ,
নয় মোর মাথা খাও।

নিজেরি স্বার্থ দেখিলে সোজন, তোমার গেরামে
ভাইবন্ধুরা আছে,
তাদের কি হবে! তোমার কি হবে! মোর কথা তুমি
ভেবে না দেখিলে পাছে?
এই ছিল মনে, তবে কেন মোর শিশুকালখানি
তোমার কাহিনী দিয়া,
এমন করিয়া জড়াইয়াছিলে ঘটনার পর
ঘটনারে উলটিয়া?
আমার জীবনে তোমারে ছাড়িয়া কিছু ভাবিবারে
অবসর জুটে নাই,
আজকে তোমারে জনমের মত ছাড়িয়া হেথায়
কি করে যে আমি যাই!
তোমার তরুতে আমি ছিনু লতা, শাখা দোলাইয়া
বাতাস করেছ যারে,
আজি কোন প্রাণে বিগানার দেশে, বিগানার হাতে
বনবাস দিবে তারে?
শিশুকাল হতে যত কথা তুমি সন্ধ্যা সকালে
শুনায়েছ মোর কানে,
তারা ফুল হয়ে, তারা ফল হয়ে পরাণ লতারে
জড়ায়েছে তোমা পানে।
আজি সে কথারে কি করিয়া ভুলি? সোজন! সোজন!
মানুষ পাষাণ নয়!
পাষাণ হইলে আঘাতে ফাটিয়া চৌচির হত
পরাণ কি তাহা হয়?
ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে, তখনি তা মোছে
ঠোঁটেরি হাসির ঘায়,
কথার লেখা যে মেহেদির দাগ-যত মুছি তাহা
তত ভাল পড়া যায়।
নিজেরি স্বার্থ দেখিলে আজিকে, বুঝিলে না এই
অসহায় বালিকার,
দীর্ঘজীবন কি করে কাটিবে তাহারি সঙ্গে,
কিছু নাহি জানি যার।
মন সে ত নহে কুমড়ার ফালি, যাহারে তাহারে
কাটিয়া বিলান যায়,
তোমারে যা দেছি, অপরে ত যবে জোর করে চাবে
কি হবে উপায় হায়!
জানি, আজি জানি আমারে ছাড়িতে তোমার মনেতে
জাগিবে কতেক ব্যথা,
তবু সে ব্যথারে সহিওগো তুমি, শেষ এ মিনতি,
করিও না অন্যথা।
আমার মনেতে আশ্বাস রবে, একদিন তুমি
ভুলিতে পারিবে মোরে,
সেই দিন যেন দূরে নাহি রয়, এ আশিস আমি,
করে যাই বুক ভরে।
এইখানে মোরা দুইজনে মিলি গাড়িয়াছিলাম
বটপাকুড়ের চারা,
নতুন পাতার লহর মেলিয়া, এ ওরে ধরিয়া
বাতাসে দুলিছে তারা!
সরু ঘট ভরি জল এনে মোরা প্রতি সন্ধ্যায়
ঢালিয়া এদের গোড়ে
আমাদের ভালবাসারে আমরা দেখিতে পেতাম
ইহাদের শাখা পরে।
সামনে দাঁড়ায়ে মাগিতাম বর-এদেরি মতন
যেন এ জীবন দুটি,
শাখায় জড়ায়ে, পাতায় জড়ায়ে এ ওরে লইয়া
সামনেতে যায় ছুটি।
এ গাছের আর কোন প্রয়োজন? এসো দুইজনে
ফেলে যাই উপাড়িয়া,
নতুবা ইহারা আর কোনো দিনে এই সব কথা
দিবে মনে করাইয়া।
ওইখানে মোরা কদমের ডাল টানিয়া বাঁধিয়া
আম্রশাখার সনে,
দুইজনে বসি ঠিক করিতাম, কেবা হবে রব,
কেবা হবে তার কনে।
আম্রশাখার মুকুল হইলে, কদম গাছেরে
করিয়া তাহার বর,
মহাসমারোহে বিবাহ দিতাম মোরা দুইজনে
সারাটি দিবসভর।
আবার যখন মেঘলার দিনে কদম্ব শাখা
হাসিত ফুলের ভারে,
কত গান গেয়ে বিবাহ দিতাম আমের গাছের
নববধূ করি তারে।
বরণের ডালা মাথায় করিয়া পথে পথে ঘুরে
মিহি সুরে গান গেয়ে
তুমি যেতে যবে তাহাদের কাছে, আঁচল তোমার
লুটাত জমিন ছেয়ে।

দুইজনে মিলে কহিতাম, যদি মোদের জীবন
দুই দিকে যেতে চায়,
বাহুর বাঁধন বাঁধিয়া রাখিব, যেমনি আমরা
বেঁধেছি এ দুজনায়।
আজিকে দুলালী, বাহুর বাঁধন হইল যদিবা
স্বেচ্ছায় খুলে দিতে,
এদেরো বাঁধন খুলে দেই, যেন এই সব কথা
কভু নাহি আনে চিতে।
সোজন! সোজন! তার আগে তুমি, যে লতার বাঁধ
ছিঁড়িলে আজিকে হাসি,
এই তরুতলে, সেই লতা দিয়ে আমারো গলায়
পরাইয়ে যাও ফাঁসি।
কালকে যখন আমার খবর শুধাবে সবারে
হতভাগা বাপ-মায়,
কহিও তাদের, গহন বনের নিদারুণ বাঘে
ধরিয়া খেয়েছে তায়।
যেই হাতে তুমি উপাড়ি ফেলিবে শিশু বয়সের
বট-পাকুড়ের চারা,
সেই হাতে এসো ছুরি দিয়ে তুমি আমারো গলায়
ছুটাও লহুর ধারা।
কালকে যখন গাঁয়ের লোকেরা হতভাগিনীর
পুছিবে খবর এসে,
কহিও, দারুণ সাপের কামড়ে মরিয়াছে সে যে
গভীর বনের দেশে।
কহিও অভাগী ঝালী না বিষের লাড়ু বানাইয়া
খাইয়াছে নিজ হাতে;
আপনার ভরা ডুবায়েছে সে যে অথই গভীর
কূলহীন দরিয়াতে।

ছোট বয়সের সেই দুলী তুমি এত কথা আজ
শিখিয়াছ বলিবারে,
হায় আমি কেন সায়রে ভাসানু দেবতার ফুল-
সরলা এ বালিকারে!
আমি জানিতাম, তোমার লাগিয়া তুষের অনলে
দহিবে আমারি হিয়া,
এ পোড়া প্রেমের সকল যাতনা নিয়ে যাব আমি
মোর বুকে জ্বালাইয়া।
এ মোর কপাল শুধু ত পোড়েনি তোমারো আঁচলে
লেগেছে আগুন তার;
হায় অভাগিনী, এর হাত হতে এ জনমে তব
নাহি আর নিস্তার!
তবু যদি পার মোরে ক্ষমা কোরো, তোমার ব্যথার
আমি একা অপরাধী;
সব তার আমি পূরণ করিব, রোজ কেয়ামতে
দাঁড়াইও হয়ে বাদী।
আজকে আমারে ক্ষমা করে যাও, সুদীর্ঘ এই
জীবনের পরপারে-
সুদীর্ঘ পথে বয়ে নিয়ে যেয়ো আপন বুকের
বেবুঝ এ বেদনাবে।

সেদিন দেখিবে হাসিয়া সোজন খর দোজখের
আতসের বাসখানি,
গায়ে জড়াইয়া অগ্নির যত তীব্র দাহন
বক্ষে লইবে টানি।
আজিকে আমরে ক্ষমা করে যাও, আগে বুঝি নাই
নিজেরে বাঁধিতে হায়,
তোমার লতারে জড়ায়েছি আমি, শাখা বাহুহীন
শুকনো তরুন গায়।
কে আমারে আজ বলে দিবে দুলী, কি করিলে আমি
আপনারে সাথে নিয়ে,
এ পরিণামের সকল বেদনা নিয়ে যেতে পারি
কারে নাহি ভাগ দিয়ে।
ওই শুন, দূরে ওঠে কোলাহল, নমুরা সকলে
আসিছে এদিন পানে,
হয়ত এখনি আমাদের তারা দেখিতে পাইবে
এইভাবে এইখানে।

সোজন! সোজন! তোমরা পুরুষ, তোমারে দেখিয়া
কেউ নাহি কিছু কবে,
ভাবিয়া দেখেছ, এইভাবে যদি তারা মোরে পায়,
কিবা পরিণাম হবে?
তোমরা পুরুষ-সমুখে পিছনে যে দিকেই যাও,
চারিদেকে খোলা পথ,
আমরা যে নারী, সমুখ ছাড়িয়া যেদিকেতে যাব,
বাধাঘেরা পর্ব্বত।
তুমি যাবে যাও, বারণ করিতে আজিকার দিনে
সাধ্য আমার নাই,
মোরে দিয়ে গেলে কলঙ্কভার, মোর পথে যেন
আমি তা বহিয়া যাই,
তুমি যাবে যাও, আজিকার দিনে এই কথাগুলি
শুনে যাও শুধু কানে,
জীবনের যত ফুল নিয়ে গেলে, কন্টক তরু
বাড়ায়ে আমার পানে।
বিবাহের বধূ পালায়ে এসেছি, নমুরা আসিয়া
এখনি খুঁজিয়া পাবে,
তারপর তারা আমারে ঘিরিয়া অনেক কাহিনী
রটাবে নানানভাবে।
মোর জীবনের সুদীর্ঘ দিনে সেই সব কথা
চোরকাঁটা হয়ে হায়,
উঠিতে বসিতে পলে পলে আসি নব নবরূপে
জড়াবে সারাটি গায়।
তবু তুমি যাও, আমি নিয়ে গেনু এ পরিনামের
যত গাঁথা ফুল-মালা।
ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর মোরে, আকাশ সায়রে
তোমার চাঁদের গায়,
আমি এসেছিনু, মোর জীবনের যত কলঙ্ক
মাখাইয়া দিতে হায়!
সে পাপের যত শাসি-রে আমি আপনার হাতে
নীরবে বহিয়া যাই,
আজ হতে তুমি মনেতে ভাবিও, দুলী বলে পথে
কারে কভু দেখ নাই।

সোঁতের শেহলা, ভেসে চলে যাই, দেখা হয়েছিল
তোমার নদীর কূলে,
জীবনেতে আছে বহুসুখ হাসি, তার মাঝে তুমি
সে কথা যাইও ভুলে।
যাইবার কালে জনমের মত শেষ পদধূলি
লয়ে যাই তবে শিরে,
আশিস্ করিও, সেই ধূলি যেন শত ব্যথা মাঝে
রহে অভাগীরে ঘিরে।
সাক্ষী থাকিও দরদের মাতা, সাক্ষী থাকিও
হে বনের গাছপালা-
সোজন আমার প্রাণের সোয়ামী, সোজন আমার
গলার ফুলের মালা।
সাক্ষী থাকিও চন্দ্র-সূর্য, সাক্ষী থাকিও-
আকাশের যত তারা,
ইহকালে আর পরকালে মোর কেহ কোথা নাই,
কেবল সোজন ছাড়া।
সাক্ষী থাকিও গলার এ হার, সাক্ষী থাকিও
বাপ-ভাই যতজন
সোজন আমার পরাণের পতি, সোজন আমার
মনের অধিক মন।
সাক্ষী থাকিও সীথার সিদুর, সাক্ষী থাকিও
হাতের দুগাছি শাঁখা,
সোজনের কাছ হইতে পেলাম এ জনমে আমি
সব চেয়ে বড় দাগা।

দুলী! দুলী! তবে ফিরে এসো তুমি, চল দুইজনে
যেদিকে চরণ যায়,
আপন কপাল আপনার হাতে যে ভাঙিতে চাহে,
কে পারে ফিরাতে তায়।
ভেবে না দেখিলে, মোর সাথে গেলে কত দুখ তুমি
পাইবে জনম ভরি,
পথে পথে আছে কত কন্টক, পায়েতে বিঁধিবে
তোমারে আঘাত করি।
দুপুরে জ্বলিবে ভানুর কিরণ, উনিয়া যাইবে
তোমার সোনার লতা,
ক্ষুধার সময়ে অন্ন অভাবে কমল বরণ
মুখে সরিবে না কথা।
রাতের বেলায় গহন বনেতে পাতার শয়নে
যখন ঘুমায়ে রবে,
শিয়রে শোসাবে কাল অজগর, ব্যাঘ্র ডাকিবে
পাশেতে ভীষণ রবে।
পথেতে চলিতে বেতের শীষায় আঁচল জড়াবে,
ছিঁড়িবে গায়ের চাম,
সোনার অঙ্গ কাটিয়া কাটিয়া ঝরিয়া পড়িবে
লহুধারা অবিরাম।

সেদিন তোমার এই পথ হতে ফিরিয়া আসিতে
সাধ হবে না আর,
এই পথে যার এক পাও চলে, তারা চলে যায়
লক্ষ যোজন পার।
এত আদরের বাপ-মা সেদিন বেগানা হইবে
মহা-শত্রুর চেয়ে,
আপনার জন তোমারে বধিতে যেখানে সেখানে
ফিরিবে সদাই ধেয়ে।
সাপের বাঘের তরেতে এ পথে রহিবে সদাই
যত না শঙ্কাভরে,
তার চেয়ে শত শঙ্কা আকুলহইবে যে তুমি,
বাপ-ভাইদের ডরে।
লোকালয়ে আর ফিরিতে পাবে না, বনের যত না
হিংস্র পশুর সনে,
দিনেরে ছাপায়ে, রাতের ছাপায়ে রহিতে হইবে
অতীব সঙ্গোপনে।
খুব ভাল করে ভেবে দেখ তুমি, এখনো রয়েছে
ফিরিবার বসর,
শুধু নিমিষের ভুলের লাগিয়া কাঁদিবে যে তুমি,
সারাটি জনমভর।

অনেক ভাবিয়া দেখেছি সোজন, তুমি যেথা রবে,
সকল জগতখানি
শত্রু হইয়া দাঁড়ায় যদিবা, আমি ত তাদেরে
তৃণসম নাহি মানি।
গহন বনেতে রাতের বেলায় যখন ডাকিবে
হিংস্র পশুর পাল,
তোমার অঙ্গে অঙ্গ জড়ায়ে রহিব যে আমি,
নীরবে সারাটি কাল।
পথে যেতে যেতে ক্লান্ত হইয়া এলায়ে পড়িবে
অলস এ দেহখানি,
ওই চাঁদমুখ হেরিয়া তখন শত উৎসাহ
বুকেতে আনিব টানি।
বৃষ্টির দিনে পথের কিনারে মাথার কেশেতে
রচিয়া কুটির খানি,
তোমারে তাহার মাঝেতে শোয়ারে সাজাব যে আমি
বনের কুসুম আনি।
ক্ষুধা পেলে তুমি উচু ডালে উঠি থোপায় থোপায়
পাড়িয়া আনিও ফল,
নল ভেঙে আমি জল খাওয়াইব, বন-পথে যেতে
যদি পায়ে লাগে ব্যথা,
গানের সুরেতে শুনাইবে আমি শ্রানি- নাশিতে
সে শিশুকালের কথা।
তুমি যেথা যাবে সেখানে বন্ধু! শিশু বয়সের
দিয়ে যত ভালবাসা,
বাবুই পাখির মত উচু ডালে অতি সযতনে
রচিব সুখের বাসা।
দূরের শব্দ নিকটে আসিছে, কথা কহিবার
আর অবসর নাই,
রাতের আঁধারে চল এই পথে, আমরা দুজনে
বন-ছায়ে মিশে যাই।

সাক্ষী থাকিও আল্লা-রসুল, সাক্ষী থাকিও
যত পীর আউলিয়া
এই হতভাগী বালিকারে আমি বিপদের পথে
চলিলাম আজি নিয়া।
সাক্ষী থাকিও চন্দ্র-সূর্য! সাক্ষী থাকিও
আকাশের যত তারা,
আজিকার এই গহন রাতের অন্ধকারেতে
হইলাম ঘরছাড়া।
সাক্ষী থাকিও খোদার আরশ, সাক্ষী থাকিও
নবীর কোরানখানি,
ঘর ছাড়াইয়া, বাড়ি ছাড়াইয়া কে আজ আমারে
কোথা লয়ে যায় টানি।
সাক্ষী থাকিও শিশূলতলীর যত লোকজন
যত ভাই-বোন সবে,
এ জনমে আর সোজনের সনে কভু কোনখানে
কারো নাহি দেখা হবে।
জনমের মত ছেড়ে চলে যাই শিশু বয়সের
শিমূলতলীর গ্রাম,
এখানেতে আর কোনদিন যেন নাহি কহে কহে
সোজন-দুলীর নাম।

**********************************************

পুর্ব্বরাগ

দীঘিতে তখনো শাপলা ফুলেরা হাসছিলো আনমনে,
টের পায়নিক পান্ডুর চাঁদ ঝুমিছে গগন কোণে ।
উদয় তারার আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পুবের পথে,
ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে।
গোরস্থানের কবর খুঁড়িয়া মৃতেরা বাহির হয়ে,
সাবধান পদে ঘুরিছে ফিরিছে ঘুমন্ত লোকালয়ে।
মৃত জননীরা ছেলে মেয়েদের ঘরের দুয়ার ধরি,
দেখিছে তাদের জোনাকি আলোয় ক্ষুধাতুর আঁখি ভরি।
মরা শিশু তার ঘু্মন্ত মার অধরেতে দিয়ে চুমো,
কাঁদিয়া কহিছে, "জনম দুখিনী মারে, তুই ঘুমো ঘুমো।"
ছোট ভাইটিরে কোলেতে তুলিয়া মৃত বোন কেঁদে হারা,
ধরার আঙনে সাজাবে না আর খেলাঘরটিরে তারা।

দুর মেঠো পথে প্রেতেরা চলেছে আলেয়ার আলো বলে,
বিলাপ করিছে শ্মশানের শব ডাকিনী যোগীনি লয়ে।
রহিয়া রহিয়া মড়ার খুলিতে বাতাস দিতেছে শীস,
সুরে সুরে তার শিহরি উঠিছে আঁধিয়ারা দশধিশ।
আকাশের নাটমঞ্চে নাচিছে অন্সরী তারাদল,
দুগ্ধ ধবল ছায়াপথ দিয়ে উড়াইয়ে অঞ্চল।
কাল পরী আর নিদ্রা পরীরা পালঙ্ক লয়ে শিরে,
উড়িয়া চলেছে স্বপনপুরীর মধুবালা-মন্দিরে।

হেনকালে দুর গ্রামপথ হতে উঠিল আজান-গান ।
তালে তালে তার দুলিয়া উঠিল স্তব্ধএ ধরাখান।
কঠিন কঠোর আজানের ধবনি উঠিল গগন জুড়ে।
সুরেরে কে যেন উঁচু হতে আরো উঁচুতে দিতেছে ছুঁড়ে।
পু্র্ব গগনে রক্ত বরণ দাঁড়াল পিশাচী এসে,
ধরণী ভরিয়া লহু উগারিয়া বিকট দশনে হেসে।
ডাক শুনি তার কবরে কবরে পালাল মৃতের দল,
শ্মাশানঘাটায় দৈত্য দানার থেমে গেল কোলাহল।
গগনের পথে সহসা নিবিল তারার প্রদীপ মালা
চাঁদ জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে গেল ভরি আকাশের থালা।

তখনো কঠোর আজান ধ্বনিছে, সাবধান সাবধান!
ভয়াল বিশাল প্রলয় বুঝিবা নিকটেতে আগুয়ান।
ওরে ঘুমন্ত-ওরে নিদ্রিত-ঘুমের বসন খোল,
ডাকাত আসিয়া ঘিরিয়াছে তোর বসত-বাড়ির টোল।
শয়ন-ঘরেতে বাসা বাঁধিয়াছে যত না সিঁধেল চোরে,
কন্ঠ হইতে গজমতি হার নিয়ে যাবে চুরি করে।

শয়ন হইতে জাগিল সোজন, মনে হইতেছে তার
কোন অপরাধ করিয়াছে যেন জানে না সে সমাচার।
চাহিয়া দেখিল, চালের বাতায় ফেটেছে বাঁশের বাঁশী,
ইঁদুর আসিয়া থলি কেটে তার ছড়ায়েছে কড়িরাশি।
বার বার করে বাঁশীরে বকিল, ইদুরের দিল গালি,
বাঁশী ও ইঁদুর বুঝিল না মানে সেই তা শুনিল খালি।

তাড়াতাড়ি উঠি বাঁশীটি লইয়া দুলীদের বাড়ি বলি,
চলিল সে একা রাঙা প্রভাতের আঁকা-বাঁকা পথ দলি।
খেজুরের গাছে পেকেছে খেজুর, ঘনবন-ছায়া-তলে,
বেথুল ঝুলিছে বার বার করে দেখিল সে কুতুহলে।
ও-ই আগডালে পাকিয়াছে আম, ইসরে রঙের ছিরি,
এক্কে ঢিলেতে এখনি সে তাহা আনিবারে পারে ছিঁড়ি।
দুলীরে ডাকিয়া দেখাবে এসব, তারপর দুইজনে,
পাড়িয়া পাড়িয়া ভাগ বসাইবে ভুল করে গণে গণে।
এমনি করিয়া এটা ওটা দেখি বহুখানে দেরি করি,
দুলীদের বাড়ি এসে-পৌঁছিল খুশীতে পরাণ ভরি।
দুলী শোন্ এসে- একিরে এখনো ঘুমিয়ে যে রয়েছিস্?
ও পাড়ার লালু খেজুর পাড়িয়া নিয়ে গেলে দেখে নিস্!
সিঁদুরিয়া গাছে পাকিয়াছে আম, শীগগীর চলে আয়,
আর কেউ এসে পেড়ে যে নেবে না, কি করে বা বলা যায়।

এ খবর শুনে হুড়মুড় করে দুলী আসছিল ধেয়ে,
মা বলিল, এই ভর সক্কালে কোথা যাস্ ধাড়ী মেয়ে?
সাতটা শকুনে খেয়ে না কুলোয় আধেক বয়সী মাগী,
পাড়ার ধাঙড় ছেলেদের সনে আছেন খেলায় লাগি।
পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেতে পাড়ায় যে টেকা ভার,
চুন নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!
এ সব গালির কি বুঝিবে দুলী, বলিল একটু হেসে,
কোথায় আমার বসয় হয়েছে, দেখই না কাছে এসে।
কালকে ত আমি সোজনের সাথে খেলাতে গেলাম বনে,
বয়স হয়েছে এ কথা ত তুমি বল নাই তক্ষণে।
এক রাতে বুঝি বয়স বাড়িল? মা তোমার আমি আর
মাথার উকুন বাছিয়া দিব না, বলে দিনু এইবার।
ইহা শুনি মার রাগের আগুন জ্বলিল যে গিঠে গিঠে,
গুড়ুম গুড়ুম তিন চার কিল মারিল দুলীর পিঠে।

ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চাহিয়া সোজন দেখিল এ অবিচার,
কোন হাত নাই করিতে তাহার আজি এর প্রতিকার।
পায়ের উপরে পা ফেলিয়া পরে চলিল সমুখ পানে,
কোথায় চলেছে কোন পথ দিয়ে, এ খবর নাহি জানে।
দুই ধারে বন, লতায়-পাতায় পথেরে জড়াতে চায়,
গাছেরা উপরে ঝলর ধরেছে শাখা বাড়াইয়া বায়।
সম্মুখ দিয়া শুয়োর পালাল, ঘোড়েল ছুটিল দূরে,
শেয়ালের ছাও কাঁদন জুড়িল সারাটি বনানী জুড়ে।
একেলা সোজন কেবলি চলেছে কালো কুজঝটি পথ,
ভর-দুপুরেও নামে না সেথায় রবির চলার রথ।
সাপের ছেলম পায়ে জড়ায়েছে, মাকড়ের জাল শিরে,
রক্ত ঝরিছে বেতসের শীষে শরীরের চাম ছিঁড়ে।
কোন দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই রায়ের দীঘির পাড়ে,
দাঁড়াল আসিয়া ঘন বেতঘেরা একটি ঝোপের ধারে।
এই রায়-দীঘি, ধাপ-দামে এর ঘিরিয়াছে কালো জল,
কলমি লতায় বাঁধিয়া রেখেছে কল-ঢেউ চঞ্চল।
চারধারে এর কর্দম মথি বুনো শুকরের রাশি,
শালুকের লোভে পদ্মের বন লুন্ঠন করে আসি।
জল খেতে এসে গোখুরা সপেরা চিহ্ন এঁকেছে তীরে,
কোথাও গাছের শাখায় তাদের ছেলম রয়েছে ছিঁড়ে।
রাত্রে হেথায় আগুন জ্বালায় নর-পিশাচের দল,
মড়ার মাথায় শিস দিয়ে দিয়ে করে বন চঞ্চল।
রায়েদের বউ গলবন্ধনে মরেছিল যার শাখে,
সেই নিমগাছ ঝুলিয়া পড়িয়া আজো যেন কারে ডাকে!

এইখানে এসে মিছে ঢিল ছুঁড়ে নাড়িল দীঘির জল,
গাছেরে ধরিয়া ঝাঁকিল খানিক, ছিঁড়িল পদ্মদল।
তারপর শেষে বসিল আসিয়া নিমগাছটির ধারে,
বসে বসে কি যে ভাবিতে লাগিল, সেই তা বলিতে পারে।

পিছন হইতে হঠাৎ আসিয়া কে তাহার চোখ ধরি,
চুড়ি বাজাইয়া কহিল, কে আমি বল দেখি ঠিক করি?
ও পাড়ার সেই হারানের পোলা। ইস শোন বলি তবে
নবীনের বোন বাতাসী কিম্বা উল্লাসী তুমি হবেই হবে!
পোড়ামুখীরা এমনি মরুক- আহা, আহা বড় লাগে,
কোথাকার এই ব্রক্ষদৈত্য কপালে চিমটি দাগে।
হয়েছে হয়েছে, বিপিনের খুড়ো মরিল যে গত মাসে,
সেই আসিয়াছে, দোহাই! দোহাই! বাঁচি না যে খুড়ো ত্রাসে!
''ভারি ত সাহস!'' এই বলে দুলী খিল্ খিল্ করে হাসি,
হাত খুলে নিয়ে সোজনের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল আসি।
একি তুই দুলী! বুঝিবা সোজন পড়িল আকাশ হতে,
চাপা হাসি তার ঠোঁটের বাঁধন মানে না যে কোনমতে।
দুলী কহে, দেখ! তুই ত আসিলি, মা তখন মোরে কয়,
বয়স বুঝিয়া লোকের সঙ্গে আলাপ করিতে হয়।
ও পাড়ার খেঁদি পাড়ারমুখীরে ঝেঁটিয়ে করিতে হয়।
আর জগাপিসী, মায়ের নিকটে যা তা বলিয়াছে তারা।
বয়স হয়েছে আমাদের থেকে ওরাই জানিল আগে,
ইচ্ছে যে করে উহাদের মুখে হাতা পুড়াইয়া দাগে।
আচ্ছা সোজন! সত্যি করেই বয়স যদিবা হত,
আর কেউ তাহা জানিতে পারিত এই আমাদের মত?
ঘাড় ঘুরাইয়া কহিল সোজন, আমি ত ভেবে না পাই,
আজকে হঠাৎ বয়স আসিল? আসিলই যদি শেষে,
কথা কহিল না, অবাক কান্ড, দেখি নাই কোনো দেশে।

দুলালী কহিল, আচ্ছা সোজন, বল দেখি তুই মোরে,
বয়স কেমন! কোথায় সে থাকে! আসে বা কেমন করে!
তাও না জানিস! সোজন কহিল, পাকা চুল ফুরফুরে,
লাঠি ভর দিয়ে চলে পথে পথে বুড়ো সে যে থুরথুরে।
দেখ দেখি ভাই, মিছে বলিসনে, আমার মাথার চুলে,
সেই বুড়ো আজ পাকাচুল লয়ে আসে নাইতরে ভুলে?
দুলীর মাথার বেণীটি খুলিয়া সবগুলো চুল ঝেড়ে,
অনেক করিয়া খুঁজিল সোজন, বুড়োনি সেথায় ফেরে!
দুলীর মুখ ত সাদা হয়ে গেছে, যদি বা সোজন বলে,
বয়স আজিকে এসেছে তাহার মাথার কেশেতে চলে!
বহুখন খুঁজি কহিল সোজন-নারে না, কোথাও নাই,
তোর চুলে সেই বয়স-বুড়োর চিহ্ন না খুঁজে পাই!
দুলালী কহিল, এক্ষুণি আমি জেনে আসি মার কাছে
আমার চুলেতে বয়সের দাগ কোথা আজি লাগিয়াছে।
দুলী যেন চলে যায়ই আর কি, সোজন কহিল তারে,
এক্ষুণি যাবি? আয় না একটু খেলিগে বনের ধারে।

বউ-কথা কও গাছের উপরে ডাকছিল বৌ-পাখি,
সোজন তাহারে রাগাইয়া দিল তার মত ডাকি ডাকি।
দুলীর তেমনি ডাকিতে বাসনা, মুখে না বাহির হয়,
সোজনেরে বলে, শেখা না কি করে বউ কথা কও কয়?
দুলীর দুখানা ঠোঁটেরে বাঁকায়ে খুব গোল করে ধরে,
বলে, এইবার শিস দে ত দেখি পাখির মতন স্বরে।
দুলীর যতই ভুল হয়ে যায় সোজন ততই রাগে,
হাসিয়া তখনদুলীর দুঠোট ভেঙে যায় হেন লাগে।

ধ্যেৎ বোকা মেয়ে, এই পারলি নে, জীভটা এমনি করে,
ঠোটের নীচেতে বাঁকালেই তুই ডাকিবি পাখির স্বরে।
এক একবার দুলালী যখন পাখির মতই ডাকে,
সোজনের সেকি খুশী, মোরা কেউ হেন দেখি নাই তাকে।
দেখ, তুই যদি আর একটুকু ডাকিতে পারিস ভালো,
কাল তোর ভাগে যত পাকা জাম হবে সব চেয়ে কালো।
বাঁশের পাতার সাতখানা নথ গড়াইয়া দেব তোরে,
লাল কুঁচ দেব খুব বড় মালা গাঁথিস যতন করে!
দুলী কয়, তোর মুখ ভরা গান, দে না মোর মুখে ভরে,
এই আমি ঠোঁট খুলে ধরিলাম দম যে বন্ধ করে।
দাঁড়া তবে তুই, বলিয়া সোজন মুখ বাড়ায়েছে যবে,
দুলীর মাতা যে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল কলরবে।
ওরে ধাড়ী মেয়ে, সাপে বাঘে কেন খায় না ধরিয়া তোরে?
এতকাল আমি ডাইনি পুষেছি আপন জঠরে ধরে!
দাঁড়াও সোজন! আজকেই আমি তোমার বাপেরে ডাকি,
শুধাইব, এই বেহায়া ছেলের শাসি- সে দেবে নাকি?

এই কথা বলে দুলালীরে সে যে কিল থাপ্পড় মারি,
টানিতে টানিতে বুনো পথ বেয়ে ছুটিল আপন বাড়ি।
একলা সোজন বসিয়া রহিল পাথরের মত হায়,
ভাবিবারও আজ মনের মতন ভাষা সে খুঁজে না পায়?

******************************************************

বেদের বহর

মধুমতী নদী দিয়া,
বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে কূলে ঢেউ আছাড়িয়া।
জলের উপরে ভাসাইয়া তারা ঘরবাড়ি সংসার,
নিজেরাও আজ ভাসিয়া চলেছে সঙ্গ লইয়া তার।
মাটির ছেলেরা অভিমান করে ছাড়িয়া মায়ের কোল,
নাম-হীন কত নদী-তরঙ্গে ফিরিছে খাইয়া দোল।

দুপাশে বাড়ায়ে বাঁকা তট-বাহু সাথে সাথে মাটি ধায়,
চঞ্চল ছেলে আজিও তাহারে ধরা নাহি দিল হায়।
কত বন পথ সুশীতল ছায়া ফুল-ফল-ভরা গ্রাম,
শস্যের খেত আলপনা আঁকি ডাকে তারে অবিরাম!
কত ধল-দীঘি গাজনের হাট, রাঙা মাটি পথে ওড়ে,
কারো মোহে ওরা ফিরিয়া এলো না আবার মাটির ঘরে।
জলের উপরে ভাসায়ে উহারা ডিঙ্গী নায়ের পাড়া,
নদীতে নদীতে ঘুরিছে ফিরিছে সীমাহীন গতিধারা।
তারি সাথে সাথে ভাসিয়া চলেছে প্রেম ভালবাসা মায়া,
চলেছে ভাসিয়া সোহাগ, আদর ধরিয়া ওদের ছায়া।
জলের উপরে ভাসাইয়া তারা ঘরবাড়ি সংসার,
ত্যাগের মহিমা, পুন্যের জয় সঙ্গে চলেছে তার।

সামনের নায়ে বউটি দাঁড়ায়ে হাল ঘুরাইছে জোরে,
রঙিন পালের বাদাম তাহার বাতাসে গিয়াছে ভরে।
ছই এর নীচে স্বামী বসে বসে লাঠিতে তুলিছে ফুল,
মুখেতে আসিয়া উড়িছে তাহার মাথায় বাবরী চুল।
ও নায়ের মাঝে বউটিরে ধরে মারিতেছে তার পতি,
পাশের নায়েতে তাস খেলাইতেছে সুখে দুই দম্পতি।
এ নায়ে বেঁধেছে কুরুক্ষেত্র বউ-শাশুড়ীর রণে,
ও নায়ে স্বামীটি কানে কানে কথা কহিছে জায়ার সনে!
ডাক ডাকিতেছে, ঘুঘু ডাকিতেছে, কোড়া করিতেছে রব,
হাট যেন জলে ভাসিয়া চলেছে মিলি কোলাহল সব।
জলের উপরে কেবা একখানা নতুন জগৎ গড়ে,
টানিয়া ফিরিছে যেথায় সেথায় মনের খুশীর ভরে।

কোন কোন নায়ে রোদে শুখাইছে ছেঁড়া কাঁথা কয়খানা,
আর কোন নায়ে শাড়ী উড়িতেছে বরণ দোলায়ে নানা।
ও নাও হইতে শুটকি মাছের গন্ধ আসিছে ভাসি,
এ নায়ের বধূ সুন্দা ও মেথি বাঁটিতেছে হাসি হাসি।
কোনখানে ওরা সি'র নাহি রহে জ্বালাতে সন্ধ্যাদীপ,
একঘাট হতে আর ঘাটে যেয়ে দোলায় সোনার টীপ।

এদের গাঁয়ের কোন নাম নাই, চারি সীমা নাহি তার,
উপরে আকাশ, নীচে জলধারা, শেষ নাহি কোথা কার।
পড়শী ওদের সূর্য, তারকা, গ্রহ ও চন্দ্র আদি,
তাহাদের সাথে ভাব করে ওরা চলিয়াছে দল বাঁধি,
জলের হাঙর-জলের কুমীর- জলের মাছের সনে,
রাতের বেলায় ঘুমায় উহারা ডিঙ্গী-নায়ের কোণে।

বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে মধুমতী নদী দিয়া,
বেলোয়ারী চুড়ি, রঙিন খেলনা, চিনের সিদুর নিয়া।
ময়ূরের পাখা, ঝিনুকের মতি, নানান পুতিঁর মালা,
তরীতে তরীতে সাজান রয়েছে ভরিয়া বেদের ডালা।
নায়ে নায়ে ডাকে মোরগ-মুরগী যত পাখি পোষ-মানা,
শিকারী কুকুর রহিয়াছে বাঁধা আর ছাগলের ছানা।
এ নায়ে কাঁদিছে শিশু মার কোলে- এ নায়ে চালার তলে,
গুটি তিনচার ছেলেমেয়ে মিলি খেলা করে কৌতুহলে।

বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে, ছেলেরা দাঁড়ায়ে তীরে,
অবাক হইয়া চাহিয়া দেখিছে জলের এ ধরণীরে!
হাত বাড়াইয়া কেহ বা ডাকিছে- কেহ বা ছড়ার সুরে,
দুইখানি তীর মুখর করিয়া নাচিতেছে ঘুরে ঘুরে।
চলিল বেদের নাও,
কাজল কুঠির বন্দর ছাড়ি ধরিল উজানী গাঁও।
গোদাগাড়ী তারা পারাইয়া গেল, পারাইল বউঘাটা,
লোহাজুড়ি গাঁও দক্ষিণে ফেলি আসিল দরমাহাটা।
তারপর আসি নাও লাগাইল উড়ানখালির চরে,
রাতের আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে তখন মাথার পরে।

ধীরে অতি ধীরে প্রতি নাও হতে নিবিল প্রদীপগুলি,
মৃদু হতে আরো মৃদুতর হল কোলাহল ঘুমে ঢুলি!
কাঁচা বয়সের বেদে-বেদেনীর ফিস ফিস কথা কওয়া,
এ নায়ে ওনায়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া শুনিছে রাতের হাওয়া।
তাহাও এখন থামিয়া গিয়াছে, চাঁদের কলসী ভরে,
জোছনার জল গড়ায়ে পড়িছে সকল ধরণী পরে।
আকাশের পটে এখানে সেখানে আবছা মেঘের রাশি,
চাঁদের আলোরে মাজিয়া মাজিয়া চলেছে বাতাসে ভাসি।
দূর গাঁও হতে রহিয়া রহিয়া ডাকে পিউ, পিউ কাঁহা,
যোজন যোজন আকাশ ধরায় রচিয়া সুরের রাহা।

এমন সময় বেদে-নাও হতে বাজিয়া বাঁশের বাঁশী,
সারা বালুচরে গড়াগড়ি দিয়ে বাতাসে চলিল ভাসি,
কতক তাহার নদীতে লুটাল, কতক বাতাস বেয়ে,
জোছনার রথে সোয়ার হইয়া মেঘেতে লাগিল যেয়ে।
সেই সুর যেন সারে জাহানের দুঃসহ ব্যথা-ভার,
খোদার আরশ কুরছি ধরিয়া কেঁদে ফেরে বারবার।

****************************************************

বেদের বেসাতি

প্রভাত না হতে সারা গাঁওখানি
কিল বিল করি ভরিল বেদের দলে,
বেলোয়ারী চুড়ি চিনের সিদুর,
রঙিন খেলনা হাঁকিয়া হাঁকিয়া চলে।
ছোট ছোট ছেলে আর যত মেয়ে
আগে পিছে ধায় আড়াআড়ি করি ডাকে,
এ বলে এ বাড়ি, সে বলে ও বাড়ি,
ঘিরিয়াছে যেন মধুর মাছির চাকে।
কেউ কিনিয়াছে নতুন ঝাঁজর,
সবারে দেখায়ে গুমরে ফেলায় পা;
কাঁচা পিতলের নোলক পরিয়া,
ছোট মেয়েটির সোহাগ যে ধরে না।
দিদির আঁচল জড়ায়ে ধরিয়া
ছোট ভাই তার কাঁদিয়া কাটিয়া কয়,
"তুই চুড়ি নিলি আর মোর হাত
খালি রবে বুঝি ? কক্ষনো হবে নয়।"
"বেটা ছেলে বুঝি চুড়ি পরে কেউ ?
তার চেয়ে আয় ডালিমের ফুল ছিঁড়ে.
কাঁচা গাব ছেঁচে আঠা জড়াইয়া
ঘরে বসে তোর সাজাই কপালটিরে।"
দস্যি ছেলে সে মানে না বারণ,
বেদেনীরে দিয়ে তিন তিন সের ধান,
কি ছাতার এক টিন দিয়ে গড়া
বাঁশী কিনে তার রাখিতে যে হয় মান।
মেঝো বউ আজ গুমর করেছে,
শাশুড়ী কিনেছে ছোট ননদীর চুড়ি,
বড় বউ ডালে ফোড়ৎ যে দিতে
মিছেমিছি দেয় লঙ্কা-মরিচ ছুঁড়ি।
সেজো বউ তার হাতের কাঁকন
ভাঙিয়া ফেলেছে ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান,
মন কসাকসি, দর কসাকসি
করিয়া বৃদ্ধা শাশুড়ী যে লবেজান।

এমনি করিয়া পাড়ায় পাড়ায়
মিলন-কলহ জাগাইয়া ঘরে ঘরে,
চলে পথে পথে বেদে দলে দলে
কোলাহলে গাঁও ওলট পালট করে।
ইলি মিলি কিলি কথা কয় তারা
রঙ-বেরঙের বসন উড়ায়ে বায়ে,
ইন্দ্রজেলের জালখানি যেন
বেয়ে যায় তারা গাঁও হতে আর গাঁয়ে।
এ বাড়ি-ও বাড়ি-সে বাড়ি ছাড়িতে
হেলাভরে তারা ছড়াইয়া যেন চলে,
হাতে হাতে চুড়ি, কপালে সিঁদুর,
কানে কানে দুল, পুঁতির মালা যে গলে।
নাকে নাক-ছাবি, পায়েতে ঝাঁজর-
ঘরে ঘরে যেন জাগায়ে মহোৎসব,
গ্রাম-পথখানি রঙিন করিয়া
চলে হেলে দুলে, বেদে-বেদেনীরা সব।

"দুপুর বেলায় কে এলো বাদিয়া
দুপুরের রোদে নাহিয়া ঘামের জলে,
ননদীলো, তারে ডেকে নিয়ে আয়,
বসিবারে বল কদম গাছের তলে।"
"কদমের ডাল ফোটা ফুল-ভারে
হেলিয়া পড়েছে সারাটি হালট ভরে।"
"ননদীলো, তারে ডেকে নিয়ে আয়,
বসিবার বল বড় মন্টব ঘরে।"
"মন্টব ঘরে মস্ত যে মেঝে
এখানে সেখানে ইঁদুরে তুলেছে মাটি।"
"ননদীলো", তারে বসিবারে বল
উঠানের ধারে বিছায়ে শীতলপাটী।"
"শোন, শোন ওহে নতুন বাদিয়া,
রঙিন ঝাঁপির ঢাকনি খুলিয়া দাও,
দেখাও, দেখাও মনের মতন
সুতা সিন্দুর তুমি কি আনিয়াছাও।
দেশাল সিঁদুর চাইনাক আমি
কোটায় ভরা চিনের সিঁদুর চাই,
দেশাল সিঁদুর খস্ খস্ করে,
সীথায় পরিয়া কোন সুখ নাহি পাই।

দেশাল সোন্দা নাহি চাহি আমি
গায়ে মাখিবার দেশাল মেথি না চাহি,
দেশাল সোন্দা মেখে মেখে আমি
গরম ছুটিয়া ঘামজলে অবগাহি।"
"তোমার লাগিয়া এনেছি কন্যা,
রাম-লক্ষ্মণ দুগাছি হাতের শাঁখা,
চীন দেশ হতে এনেছি সিঁদুর
তোমার রঙিন মুখের মমতা মাখা।"
"কি দাম তোমার রাম-লক্ষ্মণ
শঙ্খের লাগে, সিঁদুরে কি দাম লাগে,
বেগানা দেশের নতুন বাদিয়া
সত্য করিয়া কহগো আমার আগে।"

"আমার শাঁখার কোন দাম নাই,
ওই দুটি হাতে পরাইয়া দিব বলে,
বাদিয়ার ঝালি মাথায় লইয়া
দেশে দেশে ফিরি কাঁদিয়া নয়ন-জলে।
সিঁদুর আমার ধন্য হইবে,
ওই ভালে যদি পরাইয়া দিতে পারি,
বিগানা দেশের বাদিয়ার লাগি
এতটুকু দয়া কর তুমি ভিন-নারী।"
"ননদীলো, তুই উঠান হইতে
চলে যেতে বল বিদেশী এ বাদিয়ারে।
আর বলে দেলো, ওসব দিয়ে সে
সাজায় যেন গো আপনার অবলারে।"
"কাজল বরণ কন্যালো তুমি,
ভিন-দেশী আমি, মোর কথা নাহি ধর,
যাহা মনে লয় দিও দাম পরে
আগে তুমি মোর শাঁখা-সিঁদুর পর।"

"বিদেশী বাদিয়া নায়ে সাথে থাক,
পসরা লইয়া ফের তুমি দেশে দেশে।
এ কেমন শাঁখা পরাইছ মোরে,
কাদিঁয়া কাঁদিয়া নয়নের জলে ভেসে?
সীথায় সিঁদুর পরাইতে তুমি,
সিঁদুরের গুঁড়ো ভিজালে চোখের জলে।
ননদীলো, তুই একটু ওধারে
ঘুরে আয়, আমি শুনে আসি, ও কি বলে।"
"কাজল বরণ কণ্যালো তুমি,
আর কোন কথা শুধায়ো না আজ মোরে,
সোঁতের শেহলা হইয়া যে আমি
দেশে দেশে ফিরি, কি হবে খবর করে।
নাহি মাতা আর নাহি পিতা মোর
আপন বলিতে নাহি বান্ধব জন,
চলি দেশে দেশে পসরা বহিয়া
সাথে সাথে চলে বুক-ভরা ক্রদন।
সুখে থাক তুমি, সুখে থাক মেয়ে-
সীথায় তোমার হাসে সিঁদুরের হাসি,
পরাণ তোমর ভরুক লইয়া,
স্বামীর সোহাগ আর ভালবাসাবাসি।"

"কে তুমি, কে তুমি ? সোজন ! সোজন!
যাও-যাও-তুমি। এক্ষুণি চলে যাও।
আর কোনদিন ভ্রমেও কখনো
উড়ানখালীতে বাড়ায়ো না তব পাও।
ভুলে গেছি আমি, সব ভুলে গেছি
সোজন বলিয়া কে ছিল কোথায় কবে,
ভ্রমেও কখনো মনের কিনারে
অনিনাক তারে আজিকার এই ভবে।
এই খুলে দিনু শঙ্খ তোমার
কৌটায় ভরা সিন্দুর নিয়ে যাও,
কালকে সকালে নাহি দেখি যেন
কুমার নদীতে তোমার বেদের নাও।"

"দুলী-দুলী-তুমি এও পার আজ !
বুক-খুলে দেখ, শুধু ক্ষত আর ক্ষত,
এতটুকু ঠাঁই পাবেনাক সেথা
একটি নখের আঁচড় দেবার মত।"

"সে-সব জানিয়া মোর কিবা হবে ?
এমন আলাপ পর-পুরুষের সনে,
যেবা নারী করে, শত বৎসর
জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে নরকের কোণে।
যাও-তুমি যাও এখনি চলিয়া
তব সনে মোর আছিল যে পরিচয়,
এ খবর যেন জগতের আর
কখনো কোথাও কেহ নাহি জানি লয়।"
"কেহ জানিবে না, মোর এ হিয়ার
চির কুহেলিয়া গহন বনের তলে,
সে সব যে আমি লুকায়ে রেখেছি
জিয়ায়ে দুখের শাঙনের মেঘ-জলে।
তুমি শুধু ওই শাঁখা সিন্দুর
হাসিমুখে আজ অঙ্গে পরিয়া যাও।
জনমের শেষ চলে যাই আমি
গাঙে ভাসাইয়া আমার বেদের নাও।"
"এই আশা লয়ে আসিয়াছ তুমি,
ভাবিয়াছ, আমি কুলটা নারীর পারা,
তোমার হাতের শাঁখা-সিন্দুরে
মজাইব মোর স্বাসীর বংশধারা ?"
"দুলী ! দুলী ! মোরে আরো ব্যথা দাও-
কঠিন আঘাত-দাও-দাও আরো-আরো,
ভেঙ্গে যাক বুক-ভেঙে যাক মন,
আকাশ হইতে বাজেরে আনিয়া ছাড়।
তোমারি লাগিয়া স্বজন ছাড়িয়া
ভাই বান্ধব ছাড়ি মাতাপিতা মোর,
বনের পশুর সঙ্গে ফিরেছি
লুকায়ে রয়েছি খুঁড়িয়া মড়ার গোর।
তোমারি লাগিয়া দশের সামনে
আপনার ঘাড়ে লয়ে সব অপরাধ,
সাতটি বছর কঠিন জেলের
ঘানি টানিলাম না করিয়া প্রতিবাদ।"

"যাও-তুমি যাও, ও সব বলিয়া
কেন মিছেমিছি চাহ মোরে ভুলাইতে,
আসমান-সম পতির গরব,
আসিও না তাহে এতটুকু কালি দিতে।
সেদিনের কথা ভুলে গেছি আমি,
একটু দাঁড়াও ভাল কথা হল মনে-
তুমি দিয়েছিলে বাঁক-খাড়ু পার,
নথ দিয়েছিলে পরিতে নাকের সনে।
এতদিনও তাহা রেখেছিনু আমি
কপালের জোরে দেখা যদি হল আজ,
ফিরাইয়া তবে নিয়ে যাও তুমি-
দিয়েছিলে মোরে অতীতের যত সাজ।

আর এক কথা-তোমার গলায়
গামছায় আমি দিয়েছিনু আঁকি ফুল,
সে গামছা মোর ফিরাইয়া দিও,
লোকে দেখে যদি, করিবারে পারে ভুল।
গোড়ায়ের ধারে যেখানে আমরা
বাঁধিয়াছিলাম দুইজনে ছোট ঘর,
মোদের সে গত জীবনের ছবি,
আঁকিয়াছিলাম তাহার বেড়ার পর।
সেই সব ছবি আজো যদি থাকে,
আর তুমি যদি যাও কভু সেই দেশে ;
সব ছবিগুলি মুছিয়া ফেলিবে,
মিথ্যা রটাতে পারে কেহ দেখে এসে।
সবই যদি আজ ভুলিয়া গিয়াছি,
কি হবে রাখিয়া অতীতের সব চিন,
স্মরণের পথে এসে মাঝে মাঝে-
জীবনেরে এরা করিবারে পারে হীন ।"

"দুলী, দুলী, তুমি ! এমনি নিঠুর !
ইহা ছাড়া আর কোন কথা বলে মোরে-
জীবনের এই শেষ সীমানায়
দিতে পারিতে না আজিকে বিদায় করে?
ভুলে যে গিয়েছ, ভালই করেছ, -
আমার দুখের এতটুকু ভাগী হয়ে,
জনমের শেষ বিদায় করিতে
পারিতে না মোরে দুটি ভাল কথা কয়ে ?
আমি ত কিছুই চাহিতে আসিনি!
আকাশ হইতে যার শিরে বাজ পড়ে,
তুমি ত মানুষ, দেবের সাধ্য,
আছে কি তাহার এতটুকু কিছু করে ?
ললাটের লেখা বহিয়া যে আমি
সায়রে ভাসিনু আপন করম লায়ে ;
তারে এত ব্যথা দিয়ে আজি তুমি
কি সুখ পাইলে, যাও-যাও মোরে কয়ে।
কি করেছি আমি, সেই অন্যায়
তোমার জীবনে কি এমন ঘোরতর।
মরা কাষ্টেতে আগুন ফুঁকিয়া-
কি সুখেতে বল হাসে তব অন্তর ?
দুলী ! দুলী ! দুলী ! বল তুমি মোরে,
কি লইয়া আজ ফিরে যাব শেষদিনে।
এমনি নিঠুর স্বার্থ পরের
রুপ দিয়ে হায় তোমারে লইয়া চিনে ?
এই জীবনেরো আসিবে সেদিন
মাটির ধরায় শেষ নিশ্বাস ছাড়ি,
চিরবন্দী এ খাঁচার পাখিটি
পালাইয়া যাবে শুণ্যে মেলিয়া পাড়ি।
সে সময় মোর কি করে কাটিবে,
মনে হবে যবে সারটি জনম হায়
কঠিন কঠোর মিথ্যার পাছে
ঘুরিয়া ঘুরিয়া খোয়ায়েছি আপনায়।
হায়, হায়, আমি তোমারে খুঁজিয়া
বাদিয়ার বেশে কেন ভাসিলাম জলে,
কেন তরী মোর ডুবিয়া গেল না
ঝড়িয়া রাতের তরঙ্গ হিল্লোলে ?
কেন বা তোমারে খুঁজিয়া পাইনু,
এ জীবনে যদি ব্যথার নাহিক শেষ
পথ কেন মোর ফুরাইয়া গেল
নাহি পৌঁছিতে মরণের কালো দেশ।

পীর-আউলিয়া, কে আছ কোথায়
তারে দিব আমি সকল সালাম ভার,
যাহার আশীষে ভুলে যেতে পারি
সকল ঘটনা আজিকার দিনটার।
এ জীবনে কত করিয়াছি ভুল।
এমন হয় না ? সে ভুলের পথ পরে,
আজিকার দিন তেমনি করিয়া
চলে যায় চির ভুল ভরা পথ ধরে।
দুলী-দুলী আমি সব ভুলে যাব
কোন অপরাধ রাখিব না মনে প্রাণে ;
এই বর দাও, ভাবিবারে পারি
তব সন্ধান মেলে নাই কোনখানে।
ভাটীয়াল সোঁতে পাল তুলে দিয়ে
আবার ভাসিবে মোর বাদিয়ার তরী,
যাবে দেশে দেশে ঘাট হতে ঘাটে,
ফিরিবে সে একা দুলীর তালাশ করি।
বনের পাখিরে ডাকি সে শুধাবে,
কোন দেশে আছে সোনার দুলীর ঘরম,
দুরের আকাশ সুদুরে মিলাবে
আয়নার মত সাদা সে জলের পর।
চির একাকীয়া সেই নদী পথ,
সরু জল রেখা থামে নাই কোনখানে ;
তাহারি উপরে ভাসিবে আমার
বিরহী বাদিয়া, বন্ধুর সন্ধানে।
হায়, হায় আজ কেন দেখা হল
কেন হল পুন তব সনে পরিচয় ?
একটি ক্ষণের ঘটনা চলিল
সারাটি জনম করিবারে বিষময় ।'

"নিজের কথাই ভাবিলে সোজন,
মোর কথা আজ ? না-না- কাজ নাই বলে
সকলি যখন শেষ করিয়াছি-
কি হইবে আর পুরান সে কাদা ডলে।
ওই বুঝি মোর স্বামী এলো ঘরে,
এক্ষুনি তুমি চলে যাও নিজ পথে,
তোমাতে-আমাতে ছিল পরিচয়-
ইহা যেন কেহ নাহি জানে কোনমতে।
আর যদি পার, আশিস করিও
আমার স্বামীর সোহাগ আদর দিয়ে,
এমনি করিয়া মুছে ফেলি যেন,
যে সব কাহিনী তোমারে আমারে নিয়ে ।"
"যেয়ো না-যেয়ো না শুধু একবার
আঁখি ফিরাইয়া দেখে যাও মোর পানে,
আগুন জ্বেলেছ যে গহন বনে,
সে পুড়িছে আজ কি ব্যথা লইয়া প্রাণে?

ধরায় লুটায়ে কাঁদিল সোজন,
কেউ ফিরিল না, মুছাতে তাহার দুখ ;
কোন সে সুধার সায়রে নাহিয়া
জুড়াবে সে তার অনল পোড়া এ বুক ?
জ্বলে তার জ্বালা খর দুপুরের
রবি-রশ্মির তীব্র নিশাস ছাড়ি,
জ্বলে-জ্বলে জ্বালা কারবালা পথে,
দমকা বাতাসে তপ্ত বালুকা নাড়ি।
জ্বলে-জ্বলে জ্বালা খর অশনীর
ঘোর গরজনে পিঙ্গল মেঘে মেঘে,
জ্বলে-জ্বলে জ্বালা মহাজলধীর
জঠরে জঠরে ক্ষিপ্ত ঊর্মি বেগে।
জ্বলে-জ্বলে জ্বালা গিরিকন্দরে
শ্মশানে শ্মশানে জ্বলে জ্বালা চিতাভরে ;
তার চেয়ে জ্বালা-জ্বলে জ্বলে জ্বলে
হতাশ বুকের মথিত নিশাস পরে ।

জ্বালা-জ্বলে জ্বালা শত শিখা মেলি,
পোড়ে জলবায়ু-পোড়ে প্রান্তর-বন ;
আরো জ্বলে জ্বালা শত রবি সম,
দাহ করে শুধু পোড়ায় না তবু মন।
পোড়ে ভালবাসা-পোড়ে পরিণয়
পোড়ে জাতিকুল-পোড়ে দেহ আশা ভাষা,
পুড়িয়া পুড়িয়া বেঁচে থাকে মন,
সাক্ষী হইয়া চিতায় বাঁধিয়া বাসা।
জ্বলে-জ্বলে জ্বালা-হতাশ বুকের
দীর্ঘনিশাস রহিয়া রহিয়া জ্বলে ;
জড়ায়ে জড়ায়ে বেঘুম রাতের
সীমারেখাহীন আন্ধার অঞ্চলে।
হায়-হায়-সে যে কিজ দিয়ে নিবাবে
কারে দেখাইবে কাহারে কহিবে ডাকি,
বুক ভরি তার কি অনল জ্বালা
শত শিখা মেলি জ্বলিতেছে থাকি থাকি।
অনেক কষ্টে মাথার পসরা
মাথায় লইয়া টলিতে টলিতে হায়,
চলিল সোজন সমুখের পানে
চরণ ফেলিয়া বাঁকা বন-পথ ছায়।

--


পদাতিকের সোজন বাদিয়ার ঘাট

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ২২-০১-২০১০

১৯৭৮ সালের ২১ জানুয়ারি পদাতিক নাট্য সংসদের যাত্রা শুরু। দলের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে ২০০৬ সালে পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশ ও পদাতিক নাট্য সংসদ টিএসসি নামের পৃথক দুটি দল হয়ে যায়। গতকাল পদাতিক নাট্য সংসদ টিএসসি নাটক সরণিতে প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর উদ্যাপন করেছে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ উদ্যাপন হলেও অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল শোকের আবহ। বরেণ্য নাট্যকার সাঈদ আহমেদের প্রয়াণে সমবেত ব্যক্তিরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করেন শুরুতে। বাতিল করা হয় শোভাযাত্রা।
বিকেল চারটায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সৈয়দ শামসুল হক। স্বাগত বক্তব্য দেন দলের সহসভাপতি নিহাদ কবির। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ম. হামিদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন ঝুনা চৌধুরী ও হাসান আরিফ। আলোচনার পরে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটকের গান, স্মৃতিচারণা। সবশেষে ছিল পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট নাটকের মঞ্চায়ন।
জাভেদ জলিলের প্রদর্শনী
সন্ধ্যা নেমেছে তখন। রাজপথের যানজট আর যানবাহনের কর্কশ শব্দ এড়িয়ে স্বস্তি মিলল ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের লা গ্যালারিতে গিয়ে। দেয়ালে সাজানো ১০টি চিত্রকর্ম। অনেক বড় আকারের ক্যানভাস। বরেণ্য শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন ছবিগুলো। একসময় মন্তব্য করলেন, 'অল্প ছবি দিয়ে গ্যালারি সাজানোর কারণে বেশি ভালো লাগছে। ছবির প্রসার পায় এতে।'
গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে এখানে শুরু হয়েছে শিল্পী জাভেদ জলিলের এই একক চিত্র প্রদর্শনী। 'টিয়ার দ্য স্কিন অব রিয়েলিটি' নামের এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের পরিচালক জ্যঁক বুনা।
জাভেদ জলিলের ছবিতে বিষয় মুখ্য নয়। রং ও রেখার মাধ্যমে তিনি বিশেষ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেন। বর্ণ, ছন্দ ও কালির মধ্য দিয়ে তিনি অন্তরের সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন ক্যানভাসে। শালীন, সুশীল ও কোমল প্রকৃতির নারীর সঙ্গে শিল্পী পৌরাণিক আবহের সমন্বয় করেছেন। শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া তাঁর ছবি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, 'বেশ গোছানো জাভেদ জলিলের কাজ। রং স্বচ্ছ, রেখা স্পষ্ট। বিষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখেই ছবিতে ব্যবহার করেন রং। এ কারণে ছবিগুলো ভালো লেগেছে।' শিল্পী জানান, দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু তাঁর চোখে পড়ে, সেসবের খণ্ড খণ্ড চিত্র রেখা ও রঙের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। প্রদর্শনীর শেষ হবে ১ ফেব্রুয়ারি। খোলা থাকবে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।


প্রমার 'সোজন বাদিয়ার ঘাট'

আলোকিত প্রতিবেদক | তারিখ: ১৪-০২-২০১০

গ্রামের মানুষের জীবন, তাঁদের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা প্রকৃতির মতোই অকৃত্রিম। ভালোবাসা সর্বজনীন, নেই কোনো জাতি-বর্ণ ভেদ। আর সেই জাতি-ধর্মকে উপেক্ষা করে গড়ে ওঠে সোজন-দুলির প্রেম। তাঁদের অমর প্রেম কাহিনি নিয়ে পল্লিকবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন অমর গাথা সোজন বদিয়ার ঘাট। এর শ্রুতি প্রযোজনা অনুষ্ঠিত হলো ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যে সাতটায় নগরের জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে। প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের আয়োজনে এ প্রযোজনা গ্রন্থনা করেছেন শর্মিষ্ঠা বড়ুয়া। নির্দেশনা দিয়েছেন কংকন দাশ। এক ঘণ্টাব্যাপী প্রযোজনা ছিল গ্রামীণ পটভূমিতে গড়া। মঞ্চেও এর ছোঁয়া ছিল স্পষ্ট। তবে একক ও সমবেত পরিবেশনার সময় শিল্পীদের সমন্বয়ে দীনতা চোখে পড়েছে। অবশ্য আবহ সংগীত আর বাঁশির ব্যবহার ছিল দারুণ। সোজন ও দুলি চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন তাজুল ইসলাম ও কাঁকন। দর্শকদের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠেছে ভালোলাগা। 
এ নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' মঞ্চস্থ করলো প্রমা।

জসীমউদ্দীন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পল্লী কবি জসীমউদ্দীন

জসীমউদ্দীন (পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা) (জানুয়ারি ১১৯০৩ - মার্চ ১৩১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বাংলাদেশে পল্লী কবি হিসেবে পরিচিত। তার লেখা কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য অবদান।

[সম্পাদনা]জীবন বৃত্তান্ত

তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার় তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার বাড়ি ছিলো একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগদেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে সমাধিস্থ করা হয়।

[সম্পাদনা]পুরস্কার

  • প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরমেন্স ১৯৫৮
  • একুশে পদক ১৯৭৬
  • স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৮ (মরণোত্তর)
  • ১৯৭৪ সনে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
  • রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি (১৯৬৯)

[সম্পাদনা]রচনাবলী

"কাব্যগ্রন্থ"

  • রাখালী (১৯২৭)
  • নকশী কাথার মাঠ (১৯২৯)
  • বালু চর (১৯৩০)
  • ধানখেত (১৯৩৩)
  • সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪)
  • হাসু (১৯৩৮)
  • রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৩৫)
  • রুপবতি (১৯৪৬)
  • মাটির কান্না (১৯৫১)
  • সকিনা (১৯৫৯)
  • সুচয়নী (১৯৬১)
  • ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
  • মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)
  • হলুদ বরণী (১৯৬৬)
  • জলে লেখন (১৯৬৯)
  • কাফনের মিছিল ((১৯৮৮)

"নাটক"

  • পদ্মাপার (১৯৫০)
  • বেদের মেয়ে (১৯৫১)
  • মধুমালা (১৯৫১)
  • পল্লীবধূ (১৯৫৬)
  • গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯)
  • ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮)
  • আসমান সিংহ (১৯৮৬)

"আত্মকথা"

  • যাদের দেখেছি ((১৯৫১)
  • ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১)
  • জীবন কথা ( ১৯৬৪)
  • স্মৃতিপট (১৯৬৪)

"উপন্যাস"

  • বোবা কাহিনী (১৯৬৪)

"ভ্রমণ কাহিনী"

  • চলে মুসাফির (১৯৫২)
  • হলদে পরির দেশে ( ১৯৬৭)
  • যে দেশে মানুশ বড় (১৯৬৮)
  • জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)

"সঙ্গীত"

  • জারি গান (১৯৬৮)
  • মুর্শিদী গান (১৯৭৭)

"অন্যান্য"

  • বাঙালির হাসির গল্প
  • ডালিমকুমার (১৯৮৬)


অধ্যাপক বিশ্বজিৎ সিংহ



কবি জসীমউদ্দীন ও লোকনাট্য

Bookmark and Share

পল্লী আমাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। আধুনিক কবিরা প্রায়শ পল্লীকেন্দ্রিক জীবনের আকর্ষণকে উপেক্ষা করে নাগরিক জীবনের ক্লান্তিঅবসাদযন্ত্রণা-বেদনাকে সত্য বলে গ্রহণ করেছেন। কাব্যের অঙ্গন থেকে পল্লীর বিদায়ের সুর যখন বেজে উঠেছে তখন যুগ ও জীবনের সকল ঘাত প্রতিঘাত পরিহার করে বাংলা কাব্যের পুরনো ঐতিহ্যভিত্তিক কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন কবি জসীম উদ্দীন। তিনি পল্লীকে দেখেছেন অন্তরের সহানুভূতি দিয়ে। বাংলা কাব্যে পল্লীর হারানো জিনিস পুনঃ প্রতিষ্ঠাই তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান। উপেক্ষিত পল্লীকে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে কাব্যকে জনোচিত্তের ঘনিষ্ঠ করে তুলতে পেরেছেন বলে তিনি পল্লী কবি আখ্যায় ভূষিত হয়েছেন।

পল্লীর পরিবেশেই কবি লালিতপালিতবর্ধিত। তাঁর সমগ্র ব্যক্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন পল্লীর স্নিগ্ধ নিরাভরণ রূপ এর স্নেহ ও মমত্বময় পরিবেশ। নর নারীর প্রেমতৃষাসুখদুঃখ আর আনন্দ বেদনার কথা। পল্লী যেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অজস্র বৈচিত্র্যপূর্ণ পল্লীগীতির বিশাল ভাণ্ডারের সাথে তাঁর গভীর পরিচয়। সেই সূত্রে একদিকে লোক সাহিত্যের ঐশ্বর্যের সাক্ষাত পেয়েছেন। অপরদিকে অসংখ্য পল্লী নর নারীর জীবনের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন। ফলে তাদের জীবন ও চরিত্রে অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হয়েছেন। শত দুঃখ দৈন্যআঘাত-বেদনাদারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতলাঞ্ছনা ও অপমানের মুখে দাঁড়িয়েও দেশের গণমানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে তিনি কাব্যে রূপায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন।

তাঁর কাব্য মূলত পল্লী কেন্দ্রিক। গ্রাম্যজীবন ও গ্রাম্য পরিবেশ মনের বিচিত্র ক্যানভাসে রংয়ে রেখায় উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে কবির বাল্যকৈশোর ও যৌবনের অনেকটা কেটেছে পল্লীতে। মাঠেঘাটেনদী তীরেবালুচরে সাধারণ মানুষের সাথে। পল্লী তাঁর জীবনেরণর্ণ ভলর্রণ তমর ট যমর্ণধড ডদধফঢ-কবি পুত্রের উপযুক্ত ধাত্রীর কাজ করেছে। জীবনের যাত্রা পথে বাংলার পল্লীতে ঘুরে ঘুরে অজস্র সম্পদ আহরণ করেছেন। জারী গানগীতি গাথার মধ্যে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ,আশা-আকাঙক্ষাস্নেহপ্রেম প্রভৃতি অনুভব করেছেন। এই চেতনার বিকাশে সব ঘটনাই তাঁর লেখনীতে রূপ পরিগ্রহ করেছেন।

কবির সাহিত্য সাধনা শুধু কাব্যের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনিনাটকের ক্ষেত্রেও আপন প্রকাশ খুঁজে পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রতিষ্ঠা অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে তাঁর রচিত লোক জীবনাশ্রয়ী নাটকগুলোর ওপর। 'রাখালী', 'নকসী কাঁথার মাঠ' ও 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' এর কবির শিল্প পরিচয়কে যথার্থই পূর্ণতা দিয়েছে তার 'পদ্মাপার', 'মধুমালা', 'বেদের মেয়ে', 'পল্লীবধূ'ইত্যাদি।

লোক-জীবনাশ্রয়ী নাটকগুলো। বাংলার বিভিন্ন জেলার মেয়েলী গানরাখালী গানছেলে ভুলানো ছড়া এবং কথোপকথনের মধ্যে যে সব দেখা যায়তারই মধ্যে তিনি লোক নাট্যগুলোর উন্মেষ লক্ষ্য করেছেন।

সোনাই যাত্রা', 'বলাই গান'বোস্টমবাদিয়া', 'হুমরা বাইদ্যা', 'ময়নামতির গান' প্রভৃতি বিভিন্ন লোক নাট্যের অভিনয় প্রত্যক্ষ করে পরবর্তীকালে লোক জীবন ভিত্তিক নাটক রচনায় তাঁকে সাহায্য করেছে। ৃলর ্রষণর্ণর্ণ্র ্রমভথ্র টরণর্ দম্রণর্ দর্টর্ ণফফ মত ্রটঢঢর্ণ্রর্ দমলথর্দ্র সেই হেতুই করুন রসের সৃজনের লোক নাট্যগুলোতে সার্থকতা অর্জন করেছে বেশি। তাঁর ভাষায় কোন বিশেষ ব্যক্তির রচনায় নয়দেশের সকল লোকের রচনায় রূপায়িত হয় বলেই এগুলো লোকনাট্য। লোক নাট্যগুলো লোক জীবন ও লোক মানসের অন্তরঙ্গ পরিচয়ে সমৃদ্ধ বলেই এগুলোর মধ্য দিয়ে গ্রাম বাংলার মানুষকে জানা যায়। তিনি যে লোক নাট্যের নবদিগন্ত উন্মোচন করেছেনতা তাঁর লোক সাহিত্যের ঐতিহ্যাশ্রয়ী সাহিত্য সাধনারই ব্যাক্তি ও গভীরতা সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধান্বিত করে তোলে লোকনাট্যের দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাখালী'র অন্তর্ভুক্ত 'সিঁদুরের বেগতি' নামক গীতি নাট্যাংশটি উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর 'রঙিলা নায়ের মাঝির কিছু কিছু গানে লোক নাট্যের উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। 'পদ্মাপার' লোকনাট্য সহজ রূপকের আবরণে ভবপথিক অনন্ত সঙ্গলিঞ্ঝু মানুষের সংকট ও সাধনার কথা প্রকাশ করেছেন। আধ্যাত্মভাবনার তাত্ত্বিক রূপ জটিল হোক না কেনলোক কবিরা লোকজীবন থেকে রূপক তৈরি করে দুরূহ তত্ত্বভাবনাকে সাধুতা দান করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে লোকমুখে প্রচলিত মদন কুমার ও মধুমালার রূপকথা অবলম্বনে রচিত 'মধুমালা' লোকনাট্য। বহুকাল নিঃসন্তান এক রাজা ও রানীর অনেক তপস্যা ও সাধনার ফল একমাত্র পুত্রের যৌবন-স্বপ্নমত্ততার এক আকুল করা কাহিনী। তাঁর বিখ্যাত লোকনাট্য 'বেদের মেয়ে'। এ নাটকেই কবি প্রথম বাংলাদেশের লোকজীবনকে আশ্রয় করেছেন। পল্লী বাংলার নর নারীর স্নেহ-ভালোবাসা সিক্ত অথচ বিয়োগ ব্যথা কণ্ঠকিত জীবনে বেদের মেয়ে চম্পার ট্র্যাজেটিকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে নাট্যকার বেদে সমাজের একটি বাস্তবানুগ ছবি উপহার দিয়েছেন। নাটকে বেদের মেয়ে চম্পার নারী আত্মার ক্রন্দন ধ্বনি প্রথম থেকেই বেজে ওঠেছে। গয়া বেদেকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে সুখের প্রেম স্নিন্ধ জীবনের। হতভাগিনী নারী এক গ্রাম্য মোড়লের কাছে আত্মসমর্পণ করে কিছুকাল পর পরিত্যক্ত হয়ে আবার ফিরে আসে পূর্ব প্রনয়ী স্বামী বেদের কাছে। গয়া বেদে তখন নতূন বেদেনী নিয়ে ঘর বেঁধেছে। চম্পাকে গ্রহণ না করায় অভিমানে যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে সর্পদষ্ট গয়া বেদেকে নিজের জীবন দিয়ে সে তার প্রেমের মহিমাকেই স্পষ্ট করে তুলে গিয়েছে। নাটকের সংলাপ রচনায় ও চরিত্র চিত্রনে জসীম উদ্দীন সত্যই প্রশংসনীয়। কবির 'পল্লী বধূ' নাটকটি পল্লী জীবনের একটি বাস্তব আলেখ্য। পল্লী নর নারীর সুখদুঃখআনন্দবেদনাক্রোধের অনুভুতি প্রকাশে তিনি পল্লীর নিজস্ব বাক ভঙ্গীকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছে। 'গ্রাম্য কাইজ্যার' ভাষার রূপটিকে গ্রাম্য জীবনের সাথে একেবারে মিশিয়ে দিয়েছেন। জীবনের সাথে স্বাভাবিক যোগে বিধৃত বলেই তাঁর লোক নাট্যগুলোর জনপ্রিয়তা অনস্বীকার্য। 'বদল বাঁশী', 'করিম খাঁর বাড়ি', 'জীবনের পণ্য' ইত্যাদিতে গ্রাম্য দরিদ্র মানুষের অসহায়তার ছবি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। লোক জীবনকে নিবিড়তর করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলেই কাব্যের ন্যায় কবির লোক নাট্যগুলোর জনপ্রিয়তা বহুল পরিমাণে সার্থক হয়েছে।

http://www.dainikazadi.org/shahitto_details.php?news_id=357

ফরিদপুরে জসীমউদ্দীন সংগ্রহশালা'র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত PDF Print E-mail

পিটিবি নিউজ ডটকম, ২১ জানুয়ারি, ফরিদপুর : শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ পল্লী কবি জসীমউদ্দীন সংগ্রহশালা'র ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। শুক্রবার ফরিদপুর শহরতলীর অম্বিকাপুরে তারা এই ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন 

করা হয়। 

ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম মন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের গর্ব পল্লীকবিসহ সকল জ্ঞানী-গুনীর স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

তথ্য মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার অমর কথাশিল্পী পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অমর রচনাবলী সংরক্ষণসহ সকল বরেণ্য ব্যক্তির স্মৃতি সংরক্ষণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। 

তিনি বলেন, জসীম উদ্দীন মাটি ও মানুষের কবি ছিলেন। তার লেখনীতে অসাম্প্রদায়িকতা ও পল্লী মানুষের সুখ দুঃখের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। কবির নানা স্মৃতি এ অঞ্চলের নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। তিনি এ গ্রামের রাস্তায় হেটেছেন, গাছের ছায়ায় বসে কবিতা রচনা করেছেন। কবি'র গ্রামসহ এর আশপাশের গ্রামগুলোই একটি বড় সংগ্রহ শালা। 

এ সময় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের এ প্রচেষ্টাকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। 

প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ও কবি'র জামাতা ড. তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, প্রযত্ন বোর্ডের সভাপতি এম আজিজুর রহমান, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সুরাইয়া বেগম এনডিসি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক প্রকাশ দন্দ্র দাস অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।  

উল্লেখ্য, শহরতলীর অম্বিকাপুরে কবির বাসভবন সংলগ্ন চার একর জমির ওপর ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীণ এ সংগ্রহশালার কাজ আগামী জুন মাসে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে প্রশাসনিক ভবন, মিউজিয়াম, লাইব্রেরী কাম রিসার্চ সেন্টার, ডরমেটরী কাম সাব ষ্টেশন ও উন্মুক্ত মঞ্চ স্থাপন করা হবে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে এ নির্মাণ কাজ পরিচালিত হচ্ছে। 


নক্সী-কাঁথার মাঠ - পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীন (১)

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:২৬

শেয়ার করুনঃ
010

নক্সী-কাঁথার মাঠ রচয়িতা শ্রীমান্‌ জসীমউদ্‌দীন নতুন লেখক, তাতে আবার গল্পটি একেবারে নেহাৎই যাকে বলে-ছোট্ট এবং সাধারণ পল্লী-জীবনের। শহরবাসীর কাছে এই বইখানি সুন্দর কাঁথার মতো করে বোনা লেখার কতটা আদর হবে জানি না। আমি এইটিকে আদরের চোখে দেখেছি, কেন না এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লী-জীবন আমার কাছে চমৎকার একটি মাধুর্য্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে। এই কারণে আমি এই নক্সী-কাথাঁর কবিকে এই বইখানি সাধারণের দরবারে হাজির করে দিতে উৎসাহ দিতেছি। জানি না, কিভাবে সাধারণ পাঠক এটিকে গ্রহণ করবে; হয়তো গেঁয়ো যোগীর মতো এই লেখার সঙ্গে এর রচয়িতা এবং এই গল্পের ভূমিকা-লেখক আমিও কতকটা প্রত্যাখান পেয়েই বিদায় হব। কিন্তু তাতেও ক্ষতি নেই বলেই আমি মনে করি, কেননা ওটা সব নতুন লেখক এবং তাঁদের বন্ধুদের অদৃষ্টে চিরদিনই ঘটে আসতে দেখেছি।

শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৬
জোড়াসাঁকো, কলিকাতা।



এক
***

বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ী মধ্যে ক্ষীর নদী,
উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি।
-রাখালী গান

এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও - মধ্যে ধু ধু মাঠ,
ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।
এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ;
গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলো সব দাঁড়ায় তারি পাছ।
ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল-কায়া,
ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় ঘরের মায়া।

এ-গাঁও যেন ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে,
কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে!
মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল,
বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল।
এ-গাঁও ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে,
জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে!
কেউবা বলে-আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী,
ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি;
এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে,
ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!
এই খানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়,
জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়।
কেইবা জানে হয়ত তাদের মাল্য হতেই খসি,
শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি।



মাঠের মাঝে জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ,
জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ!
বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি,
মিলায় সেথা নূতন জগৎ নানান সুরে ডাকি।
সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি এ-গাঁও পানে ধায়,
ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল-ছায়।
এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকও আসে
জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে।

এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর - শুধুই জলের ডাক,
তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নাইক কোন ফাঁক।
ও-গাঁর বধূ ঘট ভরিতে সে ঢেউ জলে জাগে,
কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয়ে এসে লাগে।
এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাশেঁর বাশীর সুরে,
ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে!
এগাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান,
ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান।
এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে;
অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে।

এ-গাঁর লোকে দল বাধিঁয়া ও-গাঁর লোকের সনে,
কাইজা ফ্যাসাদ্‌ করেছে যা জানেই জনে জনে।
এ-গাঁর লোকও করতে পরখ্‌ ও গাঁর লোকের বল,
অনেক বারই লাল করেছে জলীর বিলের জল।
তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ,
মাঝখানে তার ধুলায় দোলে দুখান দীঘল বাট;
দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা,
এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা।

দুই
***

এক কালা দাতের কালি যা দ্যা কল লেখি
আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি
- ও কালা, ঘরে রইতে দিলি না আমারে।
- মুর্শিদা গান

এই গায়েঁর এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল।
কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু,
গা খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু।
বাদল-ধোয়া মেঘে কেগো মাখিয়ে দেছে তেল,
বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।
কচি ধানের তুল্‌তে চারা হয়ত কোনো চাষী,
মুখে তাহার জড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।



কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,
কালো দাতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি।
জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়;
চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করছে জয়।
সোনায় যে-জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার'
রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার।
কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,
তারির পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।
সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ,
কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক।
যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও!
সেই কালোতে সিনান্‌ করি উজল তাহার গাঁও।

আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী,
খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি।
জারীর গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে,
"শাল-সুন্দী-বেত" যেন ও, সকল কাজেই লাগে।
বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল* লোহা যেন,
রুপাই যেমন বাপের বেটা কেউ দেখেছ হেন?
যদিও রুপা নয়কো রুপাই, রুপার চেয়ে দামী,
এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামী।

*পাগাল - ইস্পাত

তিন
***

চন্দনের বিন্দু বিন্দু কাজলের ফোঁটা
কালিয়া মেঘের আড়ে বিজলীর ছটা
- মুর্শিদা গান

ওই গাঁখানি কালো কালো, তারি হেলান দিয়ে,
ঘরখানি যে দাঁড়িয়ে হাসে ছোনের ছানি নিয়ে;
সেইখানে এক চাষীর মেয়ে নামটি তাহার সোনা,
সাজু* বলেই ডাকে সবে, নাম নিতে যে গোনা।
লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী,
ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি।
মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে,
রাঙা ঠোটেঁর লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে।
ফুল ঝর-ঝর জন্তি গাছে জড়িয়ে কেবা শাড়ী,
আদর করে রেখেছে আজ চাষীদের ওই বাড়ী।
যে ফুল ফোটে সোনের খেতেম ফোটে কদম গাছে,
সকল ফুলের ঝলমল গা-ভরি তার নাচে। 

*সাজু - পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো জেলায় বাপের বাড়িতে মুসলমান মেয়েদের নাম ধরিয়া ডাকা হয় না। বড় মেয়েকে বড়, মেঝ মেয়েকে মাজু, সেজ মেয়েকে সাজু এইভাবে ডাকে। শ্বশুরবাড়ির লোকে কিন্তু এ 
নামে ডাকিতে পারে না।


কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা,
তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা।
গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি,
চাষী মেয়ের রুপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি?
রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ,
পাটের বনের বউ-টুবাণী*, নাইক দেখার লোভ।
দেখেছি এই চাষীর মেয়ের সহজ গেঁয়ো রুপ,
তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ!
দু-একখানা গয়না গায়ে, সোনার দেবালয়ে,
জ্বলছে সোনার পঞ্চ প্রদীপ কার বা পূজা বয়ে!
পড়শীরা কয় - মেয়ে ত নয়, হল্‌দে পাখির ছা,
ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ।

*বউ-টুবাণী - মাঠের ফুল



এমন মেয়ে - বাবা ত' নেই, কেবল আছেন মা;
গাঁওবাসীরা তাই বলে তায় কম জানিত না।
তাহার মতন চেকন 'সেওই' কে কাটিতে পারে,
নক্‌সী করা 'পাকান পিঠায়' সবাই তারে হারে।
হাঁড়ির উপর চিত্র করা শিকেয় তোলা ফুল,
এই গাঁয়েতে তাহার মত নাইক সমতুল।
বিয়ের গানে ওরই সুরে সবারই সুর কাঁদে,
"সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে" - বলে কি লোকে সাধে?

চার
***

কানা দেয়ারে, তুই না আমার ভাই,
আরও ফুটিক ডলক* দে, চিনার ভাত খাই।
- মেঘরাজার গান

*ডলক - বৃষ্টি

চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে
এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামলা না গাঁর বাটে।
ডোলের বেছন* ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে,
লাঙল জোয়াল ধুলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে,
কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাটা আগুন লয়ে খেলে,
বাউকুড়াণী* উড়ছে তারি ঘুর্ণী ধূলি মেলে।
মাঠখানি আজ শূনো খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে,
জন্‌-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে;
শুক্‌নো চেলা কাঠের মত শুক্‌নো মাঠের ঢেলা,
আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা।
দর্‌গা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নী আসে ভারে
নৈলা গানের* ঝঙ্কারে গাঁও কান্‌ছে বারে বারে।
তবুও গাঁয়ে নামলা না জল, গগনখানা ফাঁকা;
নিঠুর নীলের পক্ষে আগুন করছে যেন খাঁ খাঁ।
উচ্চে ডাকে বাজপক্ষী 'আজরাইলে'র ডাক,
'খর-দরজাল' আসছে বুঝি শিঙায় দিয়ে হাঁক।

*বেছন - বীজ। *বাউকুড়াণী - ঘূর্ণিবায়ু। *নৈলা গান - বৃষ্টি নামাইবার জন্য চাষীরা এই গান গাহিয়া থাকে।

এমন সময় ওই গাঁ হতে বদনা-বিয়ের গানে,
গুটি কয়েক আস্‌ল মেয়ে এই না গাঁইয়ের পানে।
আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে পাঁচটি রঙে ফুল,
মাঝের মেয়ে সোনার বরণ, নাই কোথা তার তুল।
মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল,
তেল-হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল।
মেয়ের দলে বেড়িয়ে তারে চিকন সুরের গানে,
গাঁয়ের পথে যায় যে বলে বদনা-বিয়ের মানে।
ছেলের দলে পড়ল সাড়া, বউরা মিঠে হাসে,
বদনা-বিয়ের গান শুনিতে সবাই ছুটে আসে।
পাঁচটি মেয়ের মাঝের মেয়ে লাজে যে যায় মরি,
বদনা হতে ছলাৎ ছলাৎ জল যেতে চায় পড়ি।
এ-বাড়ি যায় ও-বাড়ি যায়, গানে মুখর গাঁ,
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন রাম-শালিকে ছা।

কালো মেঘা নামো নামো, ফুল-তোলা মেঘ নামো,
ধুলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সব ঘামো!
কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই,
আরও ফুটিল ডলক দিলে চিনার ভাত খাই!
কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া,
তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া।
আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি,
নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি।
কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়,
আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়!

দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো।
দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো।
ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল;
দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড়।
ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল;
দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো।'

বারো মেঘের নামে নামে এমনি ডাকি ডাকি,
বাড়ি বাড়ি চল্‌ল তারা মাঙন হাঁকি হাঁকি।
কেউবা দিল এক পোয়া চাল, কেউবা ছটাকখানি,
কেউ দিল নুন, কেউ দিল ডাল, কেউবা দিল আনি।
এমনি ভাবে সবার ঘরে মাঙন করি সারা,
রূপাই মিঞার রুশাই-ঘরের* সামনে এল তারা।
রূপাই ছিল ঘর বাঁধিতে, পিছন ফিরে চায়,
পাঁচটি মেয়ের রূপ বুঝি ওই একটি মেয়ের গায়!
পাঁচটি মেয়ে, গান যে গায়, গানের মতই লাগে,
একটি মেয়ের সুর ত নয় ও বাঁশী বাজায় আগে।
ওই মেয়েটির গঠন-গাঠন চলন-চালন ভালো,
পাঁচটি মেয়ের রুপ হয়েছে ওরির রুপে আলো।

*রুশাই-ঘরের - রন্ধন শালার



রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান,
রূপাই বলে, "এই দিলে মা থাকবে না আর মান।"
ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল,
সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল।
মাঙন সেরে মেয়ের দল চল্‌ল এখন বাড়ি,
মাঝের মেয়ের মাথার বোঝা লাগে যেন ভারি।
বোঝার ভারে চলতে নারে, পিছন ফিরে চায়;
রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়।

(পরের পর্ব)

 

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১০ রাত ১২:১২

 



জসীমউদ্দীন : এক আধুনিক 'পল্লীকবি' -মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্

প্রত্যেক প্রতিভাবান ও সৃষ্টিধর্মী কবিরই কিছু না কিছু স্বাতন্ত্র্য এবং স্বকীয়তা থাকে। এমনকি, যারা তেমন প্রতিভাধর ও সৃষ্টি ক্ষমতার অধিকারী নন, যারা অনুসারী বা অনুকারী হিসাবে চিহ্নিত, তাদের রচনার মধ্যেও তা যত অস্পষ্ট কিংবা ক্ষীণরেখায়ই হোক না কেন, স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার পরিচয় খুঁজে পাওয়া কঠিন বা দুরূহ নয়। এ জন্য দরকার পাঠক ও সমালোচক এবং গবেষকের অনুসন্ধানী চোখ, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ সনাক্তকরণের ক্ষমতা। মনে রাখতে হবে, কোনো কবির কোনো কবিতাই অন্য কবির কবিতার সম্পূর্ণ অনুরূপ কিংবা হুবহু প্রতিরূপ নয়, তাতে প্রভাব অথবা পরিগ্রহণের পরিচয় যতই থাকুক না কেন। কবিতা মনোজ সৃষ্টি এবং ব্যক্তিমানসের ও প্রতিভার অবদান, কোনো মেশিনে উৎপাদিত পণ্য নয়। এ কারণে প্রত্যেক কম্ফবির প্রতিটি কবিতাই আলাদা, স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। প্রত্যেক কবিই তার পূর্বসূরি কবিদের রচনার সঙ্গে, বৃহত্তর অর্থে পূর্ববর্তী এমনকি পরবর্তী কাব্যধারার সঙ্গে কোনো না কোনো সূত্রে সংযোগ রেখে এবং তা অধিগত, আত্মস্থ আর স্বীকরণ করেই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা নিজের রচনায় জারি করে দেন। কবিতার উপজীব্য বিষয়, ভাষা, ছন্দ, আঙ্গিক ও রূপরীতির মধ্যে অর্থাৎ শিল্পীরূপ নির্মাণের মধ্যেই স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বিধৃত।
বাংলা সাহিত্যে অনেক প্রতিভাবান ও সৃষ্টিধর্মী কবি রয়েছেন, যাদের রচনায় স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার পরিচয় চিহ্ন নানাভাবে বিধৃত। তবে স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তার নিরিখে এবং সামগ্রিক বিচারে যুগস্রষ্টা বা নতুন ধারার প্রবর্তক কবির সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়। আধুনিক বাংলা কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম- এই তিনজনকে প্রধানতঃ যুগস্রষ্টা কবি প্রতিভা বা যুগপ্রবর্তক কবি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কবিতার ভাষায়, ছন্দে, উপমা-চিত্রকল্পে এবং আঙ্গিক ও রূপরীতিতে নতুনত্ব এনে এবং বৈচিত্র্যধর্মী ও বিপুল সম্ভারের কারণে এবং দেশ, সমাজ জীবন ও জগতের বিচিত্র বিষয়ক উপজীব্য করার দরুন ও নতুন রূপ নির্মাণের মাধ্যমেই তারা যুগস্রষ্টা কবি প্রতিভা ও মহৎ শিল্পী এবং জীবনের ভাষ্যকার হিসাবে পরিকীর্তিত। শিল্প-সাহিত্যে সম্পূর্ণ মৌলিক বলে কিছু নেই, বিষয়বস্তু বা উপজীব্যের ক্ষেত্রে তো নয়ই। কবিতার ভাষা, ছন্দ, উপমা-চিত্রকল্প এবং আঙ্গিক ও রূপরীতির স্বাতন্ত্র্য আর কবির সৃজন ক্ষমতাই পুরনো বিষয়কেও নতুন করে তোলে। বাংলা সাহিত্যে যুগস্রষ্টা বা যুগ প্রবর্তক কবি হিসেবেব চিহ্নিত নন, অথচ নতুন ধারার স্রষ্টা এমন কবিও রয়েছেন। জসীমউদ্দীন তেমন একজন আধুনিক 'পল্লীকবি'- যিনি রবীন্দ্র যুগে জন্মগ্রহণ করে এবং রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সমসাময়িককালে কাব্যচর্চায় নিবেদিত থেকেও এবং ত্রিশের কবিকুলের বিশেষতঃ পঞ্চরথী সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাস, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের সতীর্থ ও কাব্য সহযাত্রী হওয়া সত্ত্বেও, গ্রামীণ জীবন, পল্লী পরিবেশ নিয়ে এবং 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' ও 'ময়মনসিংহ গীতিকা' ইত্যাদির আদল ও আঙ্গিকে কাহিনী কাব্য, খন্ড কবিতা, গীতি কবিতা রচনা করে এবং ভাষায়, ভঙ্গীতে আর আঙ্গিক ও রূপরীতিতে এবং মনোভাবে ও জীবনবোধে আধুনিকতা চারিয়ে দিয়ে আধুনিক বাংলা কাব্যে স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার পরিচয় চিহ্নিত করেছেন। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো জসীমউদ্দীন সমসাময়িক ও উত্তরসূরিদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি, যদিও তাঁর অনুসারী কবিও বাংলা সাহিত্যে রয়েছেন, সংখ্যায় তারা যত কমই হোন না কেন। এ কালে আখ্যান কাব্য রচনার প্রবণতা কমে যাওয়ায়, গ্রামীণ জীবনের রূপকার আধুনিক কবিরাও প্রধানত খন্ড কবিতাই লিখছেন।
জসীমউদ্দীনের কবি-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য ও তাঁর রচনার স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ অনুধাবন করতে হলে, বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যের পটভূমিকার দিকে কিছুটা ফিরে তাকাতে হবে। আধুনিক বাংলা কাব্যে জসীমউদ্দীন বাংলাদেশের গ্রাম-জীবন ও পল্লী-প্রকৃতির একনিষ্ঠ এবং অনন্য রূপকার হলেও এক্ষেত্রে তিনি একক কিংবা পথিকৃৎ নন। বাংলা সাহিত্যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই পল্লীজীবনের চিত্র এবং গ্রামীণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ছবি নানারূপে ও রেখায় অংকিত হয়েছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে পল্লী জীবনের চিত্র রূপায়িত হয়েছে বিভিন্ন আখ্যান কাব্যে, লোক কাহিনীতে, গীতিকায়, ছড়ার ছন্দে, বারোমাস্যায়, লোক-সঙ্গীতে ও পল্লীগীতিতে। ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকায় এ দেশের গ্রাম-জীবন ও গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিরহ বেদনা ও চিরন্তন রোমান্সের সজীব চিত্র অংকিত হয়েছে।
কিন্তু আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যান-কাব্যের এই ঐতিহ্যের ধারায় জসীম উদ্দীন ছাড়া আর কারো রচনায় বাংলাদেশের গ্রাম-জীবন ও পল্লীপ্রকৃতি এমন ব্যাপকতর ও সুন্দরতররূপে চিত্রিত হয়নি। মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আধুনিককালে যাঁরা আখ্যান-কাব্য রচনা করেছেন, তারা প্রধানত কাহিনী সংগ্রহের জন্যে হাত পেতেছেন রামায়ন-মহাভারত ও লোক-পুরানের কাছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জসীম উদ্দীনই প্রথম ময়মনসিংহ-গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকার ঐতিহ্যের ধারায় সমকালীন গ্রাম-জীবনের পটভূমিকায় আখ্যান-কাব্য রচনা করেন।
উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা, গানে বাংলাদেশের রূপ-প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক রূপৈশ্বর্য বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন। নদী-নালা পরিবৃত বাংলাদেশের ছায়া-ঢাকা, পাখি ডাকা গ্রামের নৈসর্গিক রূপ তাঁর কবিতায় নানা মহিমায় ধরা দিয়েছে। তিনি কল্পনার জগতে যেমন প্রাচীন উজ্জয়িনী নগরী এবং কালিদাসের কালের পটভূমিকায় ফিরে গেছেন, তেমনি বর্তমানের পটভূমিকায় ফিরে এসেছেন বাংলার-বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জগতে। এখানকার ছায়া ঢাকা গ্রাম, পদ্মা-মেঘনা-যমুনার খরস্রোত, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, উদাসী প্রান্তর-তার কবিতায় রূপ পেয়েছে। পদ্মা ও পদ্মাচরের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক রূপচিত্র তিনি অংকন করেছেন এইভাবে :
-ভেসে যায় তরী
প্রশান্ত পদ্মার স্থির বক্ষের উপর
তরল কল্লোলে। অর্ধমগ্ন বালুচর
দূরে আছে পড়ি, যেন দীর্ঘ জলচর
রৌদ্র পোহাইছে শুয়ে। ভাঙা উচ্চতীর, 
ঘনছায়া পূর্ণ তরু; প্রচ্ছন্ন কুটির
বক্র শীন পথখানি দূর গ্রাম হতে
শস্যক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়াছে স্রোত
তৃষিত জিহবার মতো। ....
[সুখ, চিত্রা]
নদী-নালা পরিবৃত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বাঙ্ময় হলেও, এখানকার গ্রামীণ পরিবেশ ও গ্রামীণ মানুষের জীবনধারা-তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম-সাধনার চিত্র রূপায়িত হয়নি বললেই চলে। যদিও রবীন্দ্রনাথের কবি-কল্পনায় ও অনুভূতিতে ধরা পড়েছে এই চিত্র :
চাষি ক্ষেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।
নজরুলের কবিতা গানেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক রূপমহিমা বাঙ্ময় হয়েছে। কিন্তু তার রচনায়ও ব্যাপক পটে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ও গ্রামীণ মানুষের সুখ-সুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা তেমন প্রতিফলিত হয়নি। নির্যাতিত-নিপীড়িত গণমানুষের দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম-সাধনার নিপুণ রূপকার নজরুলের কাব্যে সর্বহারা কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরদের গান বাস্তবতার পটে প্রজ্বলন্ত ভাষা পেয়েছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও, নজরুলের রচনায় গ্রামীণ মানুষের বৃহত্তর জীবন উপজীব্য হয়নি।
প্রাকৃতিক পরিবেশ, নৈসর্গিক রূপমহিমা কোন না কোনভাবে প্রায় সব কবির রচনায়ই বিধৃত হয়। শুধু রোমান্টিক কবিরাই নন, ক্লাসিক কবিরাও মানস-যাত্রায়, আত্মসত্তার আবিষ্কারে বর্ণনায়-বিশ্লেষণে, উপমা চিত্রকল্পে প্রকৃতি-আশ্রয়ী হন। বৃহত্তম গ্রাম-জীবন ও গ্রামীণ মানুষের সংগ্রামশীলতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনা, সমাজবদ্ধ জীবনের অভি≈v-এক কথায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের বাস্তব জীবনের প্রতিফলন যার রচনায় প্রত্যক্ষভাবে ঘটে না, তিনিও উপজীব্য আহরণে, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের সন্ধানে গ্রামীণ জীবন, সামাজিক পরিবেশ ও প্রকৃতিতে ফিরে যান। এমনকি যিনি নাগরিক জীবনকেই কবিতার পট হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁর রচনায়ও রূপপ্রতীক ইত্যাদির পথ ধরে স্মৃতিচারণায়, নষ্টালজিয়ায় গ্রামীণ জীবন, সামাজিক পরিবেশ ও প্রকৃতি হানা দেয়।
বাংলা কবিতার ঐশ্বর্যময় রূপের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ, নৈসর্গিক সৌন্দর্য-মহিমা ও ঋতুরঙের বৈচিত্র্য। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশের কবিরা নানাভাবে প্রকৃতিকে রচনার উপজীব্য করেছেন। কখনও কবিতায় নৈসর্গিক সৌন্দর্য-মহিমা ও ঋতুরঙের বৈচিত্র্য রূপ পেয়েছে বর্ণনায়, কখনও বা বিশ্লেষণে। স্বপ্ন ও কল্পনার প্রকাশে, মনের অন্তর্গূঢ় বেদনা ও আর্তি-আকুলতা ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রকৃতিকে করেছেন উপজীব্য। কিন্তু সব যুগে, সব কবির রচনায়ই গ্রামীণ পরিবেশ ও গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার চিত্ররূপ পায়নি।
রবীন্দ্র যুগের কবিদের মধ্যে যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুদুমরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, করুণানিধান বন্দোপাধ্যায় প্রমুখের রচনায় গ্রাম-বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নৈসর্গিক রূপচিত্রের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার খন্ড ছবিও রূপ পেয়েছে। তবে এঁদের পল্লী-জীবন-নির্ভর কবিতায় স্মৃতিচারণা, নষ্টালজিয়ারই প্রাধান্য। রোমান্টিক-মানসযাত্রায় এবং কবি-কল্পনায় তারা মাঝে মাঝে ফিরে গেছেন আশৈশব পরিচিত গ্রামে, গ্রামীণ-জীবনে। গ্রামীণ-জীবন-পরিবেশ, বৈষ্ণব কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা, প্রাচীন সংস্কার কখনও কখনও গ্রাস করেছে তাঁদের মন। বিশেষজ্ঞদের মতে, রবীন্দ্র প্রভাবের ফলে বাংলা কাব্যে যখন ক্রান্তিপাত ঘটছিল তখন এঁরা প্রাচীন কাব্য সংস্কারকে সাধ্যানুসারে সজীব রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। রবীন্দ্র-প্রভাব সত্ত্বেও, এই প্রাচীন সংস্কার ও ঐতিহ্যপ্রীতি এবং গ্রাম ও গ্রাম-জীবনের প্রতি ভালবাসা তাঁদের কিছুটা স্বতন্ত্র পথে পদচারণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
রবীন্দ্রানুসারী এই কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্য ও কবিমানসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে : 'প্রাচীন কাব্যধারার মধ্যে নবীনত্বের উদঘাটন, প্রাচীন ও নবীনদের মধ্যে নবীনত্বের উদঘাটন, প্রাচীন ও নবীনের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ স্থাপন, সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তন ধারাকে বহনোপযোগী সংবেদনশীলতা ও চরিত্রদান এবং গ্রাম-জীবনের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও মমতা প্রকাশ। বাংলা কাব্যের প্রাচীন ও নবীন যুগের এঁরা সেতুবন্ধন করেছেন। এখানেই এদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। কিন্তু জসীম উদ্দীনের মতো এরা কেউই আখ্যান-কাব্য কিংবা লোক-ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাব্যরীতির অনুসরণ ও অনুকরণ যখন প্রায় গতানুগতিকতায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তখন জসীম উদ্দীন প্রাচীন আখ্যান-কাব্য ও লোক-ঐতিহ্যের ধারায় গ্রাম-জীবনের আখ্যান রচনায় আত্মনিবেদিত হন। সাহিত্য ক্ষেত্রে জসীম উদ্দীনের আবির্ভাবকালে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের প্রভাবই ছিল প্রবল। রবীন্দ্র-কাব্যধারায় শুধু তার সমসাময়িক কবিরাই নন, সে সময় বহু পূর্বসূরী এবং উত্তরসূরী কবিও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই প্রভাব বর্তেছে ভাবে, ভাষায়, আঙ্গিক-প্রকরণ ও রীতিভঙ্গিতে। অনুরূপভাবে, জসীম উদ্দীনের আবির্ভাবকালে নজরুলের কাব্যধারা ও বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল তাঁর বহু সমসাময়িক, উত্তরসুরী এবং পূর্বসূরী কবির রচনায়। ভাবে, ভাষায়, আঙ্গিক-প্রকরণ ও রীতিভঙ্গিতে এই প্রভাব ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য। কিন্তু জসীমউদ্দীন এই দুই কবির কারো কাব্যধারায়ই তেমন প্রভাবিত হননি।
রবীন্দ্রনাথ তার পূর্বসূরীদের প্রভাবকে আত্মস্থ করে, সমগ্র বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে, নিজের সাধনা ও সৃষ্টিধর্মী প্রতিভায় আধুনিক বাংলা কাব্যে স্বতন্ত্র রাবীন্দ্রিক ধারার প্রবর্তন করেন। নজরুল ইসলামও সমগ্র বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে পূর্বসূরীদের বিশেষ করে রবীন্দ্র-কাব্যরীতিকে আত্মস্থ করে তার সাধনা ও সৃষ্টিধর্মী প্রতিভায় রবীন্দ্রোত্তর বাংলাকাব্যে সৃষ্টি করেন ভিন্ন ধারা। জসীমউদ্দীন তার কাব্যসাধনায় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার মেনে নিয়েছেন, তিনিও আত্মস্থ করেছেন লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। কিন্তু রবীন্দ্র ও নজরুলের মত জসীমউদ্দীনকে তার আধুনিক পূর্বসূরীদের কাব্যধারাকে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসাবে তেমন গ্রহণ করতে কিংবা আত্মস্থ করে নিতে হয়নি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার সমসাময়িকদের মধ্যে জসীমউদ্দীনই একমাত্র ব্যতিক্রম। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রবল প্রভাবের সময়ে আবির্ভূত হয়েও যিনি এই দুই কবির প্রভাব এড়াতে পেরেছেন। 
এই প্রভাব এড়াতে গিয়ে জসীমউদ্দীনকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল কারো কাব্যপ্রভাবের বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হয়নি। রবীন্দ্র-রোমান্টিকতা ও 'ললিত গীত কল্লোলতা'র বিরুদ্ধে চাপা বিদ্রোহ অবশ্য জসীমউদ্দীনের আবির্ভাবের অনেক আগেই সূচিত হয়ে গিয়েছিল। 'দুঃখবাদী' কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের রচনায় ব্যঙ্গ, কৌতুকে ভাষা পেয়েছিল এই রোমান্টিকতা-বিরোধী ও বাস্তব-সচেতন মনোভাব। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন : মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ/মিথ্যা রঙিন সুখ/সত্য সহস্র গুণ/সত্য জীবনের দুঃখ (মরুশিখা)। সনাতন রোমান্টিকতা, প্রচলিত আদর্শবাদ, ভাবালুতা এবং আধ্যাত্মিক ভাব-ব্যঞ্জনার বিরুদ্ধে মোহিতলালেও ধ্বনিত হয়েছিল অনাস্থার সুর। রবীন্দ্র-রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে গিয়ে 'অঘোর-পন্থী'তে মোহিতলাল বলেছিলেন : 'কতদিন ভুলাইবে মর্ত্য জনে বিলাইয়া মোহন আসব/হে কবি বাসব? (অঘোরপন্থী)। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রভাবের আওতায়ই অবস্থান করতে হয়েছে।
জসীমউদ্দীনের আবির্ভাবকালেই কল্লোল-যুগে রবীন্দ্র-কাব্যধারার বিরুদ্ধে পুনরায় বিদ্রোহ সূচিত হয়েছিল। মোহিতলালের জীবন সম্ভোগবাদ, নজরুলের বাঁধ ভাঙা তারুণ্যের দুর্দম আবেগ, যতীন্দ্রনাথের আত্মদ্রোহী দুঃখবাদ কল্লোল-যুগের কবিদের বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাছাড়া আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব, পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার অভিঘাত এবং যুদ্ধোত্তর-যুগের অকল্যাণবোধ, হতাশা-বিষাদ ও মনোবিকলনের প্রভাব তো ছিলই। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রভাব অতিক্রমেচ্ছু কবির রবীন্দ্র-রোমান্টিকতা ও আধ্যাত্মিক ভাবব্যঞ্জনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও তারা ভাবে, ভাষায়, আঙ্গিক-প্রকরণ ও রীতিভঙ্গীতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথেরই অনেকখানি অন্তর্গত। আঙ্গিক-প্রকরণ ও। 'বিদ্রোহী'র নিশেন উড়িয়ে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাবের পর, কল্লোল-যুগের কবিদের অনেকেই 'বিদ্রোহী'র কবির কাব্যধারায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের অনেক রচনায়ই এর স্বাক্ষর আছে। নজরুল ইসলামকেও সচেতন-প্রচেষ্টায় রবীন্দ্র কাব্যধারার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হয়নি। প্রতিভার স্বাতন্ত্র্য এবং ঐতিহাসিক পটভূমির ভিন্নতার দরুনই সচেতন বিদ্রোহ ঘোষণা না করেও নজরুল রবীন্দ্রোত্তর যুগে এক স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। কল্লোল যুগের কবিরা বাংলা কাব্যের মোড় ফেরানো এবং রচনার বিষয়বস্তু, ভাষা, আঙ্গিক ও রীতিপ্রকরণের দিক থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও, রবীন্দ্রনাথের সর্বাতিশায়ী প্রভাব সম্পুর্ণ অতিক্রম করতে পারেননি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় : 'রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সক্রিয় তথা সর্বতোমুখ সাহিত্যিক বাংলাদেশে ইতঃপূর্বে জন্মাননি এবং পরবর্তীরা আত্মশ্লাঘায় যতই প্রাগ্রসর হোক না কেন, অনুভূতির রাজ্যে সুদ্ধ তারা এমন কোনও পথের সন্ধান পায়নি যাতে রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্ন নেই। বস্তুত, তার দিগ্বিজয়ের পরে বাংলা সাহিত্যের যে অবস্থান্তর ঘটেছে, তা এই : তাঁর অসীম সাম্রাজ্যের অনেক জমি জোতদারদের দখলে এসেছে; এবং তাদের মধ্যে যারা পরিশ্রমী তারা নিজের এলাকার শস্যের পরিমাণ বাড়িয়েছে মাত্র; ফসলের জাত বদলাতে পারেনি।' (পৃ : ৮' কুলায় ও কালপুরুষ')
কিন্তু রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে জসীমউদ্দীনের কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে এই বক্তব্য সর্বতোভাবে প্রযোজ্য নয়। কল্লোল-যুগের কবিদের সমসাময়িক হয়েও, জসীমউদ্দীন সম্পূর্ণ ভিন্ন পদে পদচারণা করেছেন। বাংলা কাব্যে তার নিজস্ব ক্ষেত্রে জসীমউদ্দীন শুধু কাব্যফসলের পরিমাণই বাড়াননি, ফসলের জাতও অনেকটা বদল করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : 'জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের।' রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা তার সমসাময়িক কবিদের কাব্যরীতির অনুসরণ-অনুকরণ না করে জসীমউদ্দীন অবলম্বন করেছেন লোক-ঐতিহ্যের ধারা। নাগরিক-জীবনধারার বদলে তিনি উপজীব্য করেছেন প্রধানত গ্রামীণ পরিবেশ ও গ্রাম-জীবন। উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশের গ্রাম-জীবনের-বিশেষ করে পদ্মাতীরের মানুষের জীবনালেখ্য রচনায় বন্দে আলী মিয়া জসীমউদ্দীনের অগ্রণী। তার 'ময়নামতীর চর' কাব্যগ্রন্থেই পদ্মাতীরের মানুষের জীবনচিত্র এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রথম রূপ পায়। রবীন্দ্রনাথ 'ময়নামতীর চর' পড়ে লিখেছিলেন : 'তোমার 'ময়নামতীর চর' কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গীতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি তাতে করে কবিতাগুলি আরও সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনা কবিতায় পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।'
কিন্তু বন্দে আলী মিয়া একনিষ্ঠভাবে এই রচনারীতি ও ধারা অনুসরণ করেননি। তিনি রবীন্দ্র-নজরুলের কাব্যধারায় প্রভাবিত হয়েছেন। জসীমউদ্দীনের গ্রামীণ-পরিবেশ ও গ্রাম-জীবননির্ভর কাব্য রচনা কোনো সাময়িক কিংবা আকস্মিক ব্যাপার নয়। জসীমউদ্দীনের সমস্ত অস্তিত্বই নোঙর বেঁধে রেখেছে গ্রাম-জীবন ও গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে। তার অভিজ্ঞতায়, আবেগ-আর্তিতে, স্বপ্ন ও ধ্যান-কল্পনায় গ্রামীণ পরিবেশ, গ্রামজীবন এবং বাংলার জীবনধারা বাঙময়। তিনি গ্রামের মানুষ ও তাদের জীবনধারা সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে, চিরায়ত দৃশ্যরূপকে শুধু নিকট থেকেই দেখেননি, একাত্মভাবেও দেখেছেন। পল্লী-জীবন ও প্রাকৃতিক পরিবেশনির্ভর কবিতা যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কালিদাস রায়, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক প্রমুখ রবীন্দ্র-যুগের কবিদের রচনায় কিছুটা ভিন্নতর ও বৈচিত্র্যের স্বাদ এনেছে সত্য, কিন্তু জসীমউদ্দীনের মতো এই ধারাটি তাঁদের মৌল কবি স্বভাবের অন্তর্গত হয়নি।
কালিদাস রায় তার একটি কবিতায় লিখেছেন : বহু বছর পরে/ গ্রামে গেলাম গ্রামটি শুধু চোখে দেখার তরে/ (রূপান্তর, পূর্ণাহুতি)। পল্লী মায়ের কাছে কবির ব্যাকুল আত্মসমর্পণের কারুণ্য ও বেদনা ধ্বনিত হয়েছে কালিদাস রায়ের 'প্রত্যাবর্তন' শীর্ষক কবিতায় : ভাঙ্গা বাঁশী জোড়া দিয়ে বীণা ফেলে তাই নিয়ে ফিরিয়ে এলাম/ বহু অপরাধ জমা, স্নেহভরে কর ক্ষমতা লও না প্রণাম/তিরিশ বছর পরে চিনিতে পারিবে তারে? বৃথাই শুধু/ এ দগ্ধ ললাটতট স্নিগ্ধ করি দিক বটচ্ছায়ার প্রসাদ/ পাখীর ডানায় গায়ে বকুল ঝরায়ে গায়ে কর আশীর্বাদ (হৈমন্তী)। 
কিন্তু জসীমউদ্দীন স্মৃতিচারণায়, নষ্টালজিয়ায় গ্রামে ফিরে যাননি, এভাবে শুধু চোখে দেখার জন্যে তার গ্রামে প্রত্যাবর্তন নয়। তিনি তার সমগ্র হৃদয়মানস ও প্রাণসত্তাকেই গ্রামে সংস্থাপিত রেখেছেন। তাই, জসীমউদ্দীনকে কখনও গ্রামের কাছে গিয়ে ব্যাকুল আত্মসমর্পণের কারুণ্য ও বেদনা প্রকাশ করতে হয়নি।
জসীমউদ্দীনকে কখনো স্বদেশে এবং স্বগ্রামে অপরিচয়ের বিস্ময় নিয়ে তাকাতে হয়নি, তাকাতে হয়নি স্বদেশে পরিব্রাজকের দৃষ্টিতে। গ্রাম, গ্রামীণ পরিবেশ ও সেখানকার জনজীবনের সাথে গভীর মানসসাযুজ্য এবং একাত্ম অনুভূতিতে সম্পৃক্ত বলেই জসীমউদ্দীন প্রায়শই তার কবিতায় গ্রামের প্রসঙ্গে 'আমাদের' 'মোদের' কথাটি ব্যবহার করেছেন। গ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে যাওয়ার 'নিমন্ত্রণ' জানিয়ে বলেছেন: তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়। (নিমন্ত্রণ)। জসীমউদ্দীন যখন বলেন: পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সংকেত/সবুজে হলুদে সোহাগ ভুলায়ে আমার ধানের খেত/(ধানখেত)/কিংবা, ও বাজান, চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে/গরুর কাঁধে লাঙ্গল দিয়া/ঠেলতে ঠেলতে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না গ্রাম-জীবন ও গ্রামীণ মানুষের সাথে তার আত্মীয়বোধ এবং একাত্মতা কি সুনিবিড়। বস্তুত, জসীমউদ্দীন তার বহু কবিতায় গ্রামের মানুষ-অর্থাৎ চাষা-ভূষা ও কৃষাণ-কৃষাণীরই প্রতিনিধি।
যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ কবিরা গ্রাম-জীবন নির্ভর ও লোককাহিনী ভিত্তিক খন্ড-কবিতা লিখেছেন বটে, কিন্তু তারা কেউই দীর্ঘ আখ্যান-কাব্য লিখেননি। আধুনিক বাংলাকাব্যে জসীমউদ্দীনই ময়মনসিংহ-গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকার ঐতিহ্যের ধারায় আখ্যানকাব্য রচনা করেন।
প্রাচীন আখ্যাতা-কাব্যের ধারা অনুসরণ করলেও, জসীমউদ্দীন ময়মনসিংহ-গীতিকা, কিংবা পূর্ববঙ্গ-গীতিকা থেকে কাহিনী সংগ্রহ করেননি : তিনি গ্রাম-জীবন ও সেখানকার মানুষের সাথে তার আশৈশব অন্তরঙ্গ পরিচয়ের পটভূমিতে নিজের সৃজনী-প্রতিভায় কাব্যের কাহিনী সৃষ্টি করে নিয়েছেন। তাঁর 'নকসী কাঁথার মাঠ' 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' 'সখিনা ইত্যাদি কাহিনী কাব্য এদিক থেকে সম্পূর্ণ নতুন। উল্লেখ্য, আধুনিক বাংলা কাব্যে যারা আখ্যান-কাব্যের রচয়িতা তারা কেউই জসীমউদ্দীনের মতো এভাবে মৌলিক কাহিনী নির্মাণ করেননি। মাইকেল থেকে ফররুখ আহমদ পর্যন্ত সবাই কাহিনী সংগ্রহের জন্যে হাত পেতেছেন পুরাণে রামায়ণ-মহাভারতে, ইতিহাসের ভান্ডারে, লোক-সাহিত্য ও পুঁথি-সাহিত্যে। জসীমউদ্দীন লোক-সাহিত্য ও লোক-ঐতিহ্যের অনুরাগী হওয়া সত্ত্বেও, কাহিনী সংগ্রহের জন্য তিনি তাকিয়েছেন তার সমকালীন গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের দিকে। 
যদিও কাহিনী বিন্যাসে, চরিত্র-চিত্রণ রীতিতে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্যে, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীত যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।
লোক-কাহিনী, লোকগীতি, পল্লী সঙ্গীত ও বাংলার চিরায়ত লোক-সংস্কৃতির সাথে ছিল জসীমউদ্দীনের আবাল্য অন্তরঙ্গ পরিচয়। লোক-সাহিত্যে রয়েছে অকৃত্রিম জীবনচিত্র, গণ-মানুষের দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও হাসি-কান্নার প্রকাশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, 'গীতি সম্পদ গাঁথা বা আখ্যান সম্পদ এবং কথাসম্পদ মিলিয়ে যে বাংলা লোক-সাহিত্য সত্যই যেমন তা বিচিত্র, তেমনি অপূর্ব তার রসসম্পদ।' ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকার কাহিনীগুলোতে রয়েছে প্রেম-পরিণয়ের দ্বনদ্বমুখর ও করুণাঘন আলেখ্য, তেমনি পুঁথি-সাহিত্যে রূপায়িত হয়েছে রোমান্টিক প্রেম, শৌর্য-বীর্যের মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্য ও রসবোধের পরিচয়। শুধু লোককাব্য নয়, বাংলার লোকগীতিও ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যে মনোহর। জারীসারি, ভাটিয়ালী-বাউল, মারফতী,-মুর্শিদী বাংলা লোকসঙ্গীত ও সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। 
জসীমউদ্দীন শুধু এই কথাসম্পদ-গীতিসম্পদের সাথে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিতই ছিলেন না, তিনি এর রসধারাও আকণ্ঠ পান করেছিলেন। ঐতিহ্যের এই উত্তরাধিকারকেই তিনি কাজে লাগিয়েছেন তার রচনাকর্মে। তার রচনার বহিরাঙ্গিক রূপে, অন্তরঙ্গরূপে লোক-কাহিনী ও লোকগীতি কাজ করেছে। তিনি আখ্যান-কাব্য ও পুঁথি-সাহিত্য থেকে অনেক উপাদান আহরণ করেছেন, ভাষায়, উপমায়, চিত্রকল্পে সে সব ব্যবহার করেছেন সৃজনী-কৌশলে। জনজীবনের আলেখ্য রচনা, বাস্তব পরিবেশের বর্ণনা' ও ঐতিহ্যের পটভূমি নির্মাণে তিনি স্মরণ নিয়েছেন পুঁথি, পুরাণ ও লোক-কাব্যের। 'বিবাহের আসরে' পুঁথি পাঠের একটি মনোরম বর্ণনা দিয়েছেন জসীমউদ্দীন এইভাবে: 
কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুনছে পেতে কান,
জমজুমেরি পানি যেন করছে তারা পান।
দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়,
লাল ঘোড়া তার উড়ছে যেন লাল পাখীটির পায়।
কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ,
মেষের পালে পড়েছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ।
কখন দেখে জয়গুণ বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে,
মেঘের বরণ চুলগুলো তার পড়ছে এসে ভুয়ে।
আকাশের চাঁদ সুরুষে মুখ দেখে পায় লাজ,
সেই কনেরে চোখের কাছে দেখেছে চাষী আজ।
দেখছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে,
রক্ত যাহার জমছে আজও সন্ধ্যা মেঘের গোরে;
কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান,
সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান।
পুঁথির কাহিনী ও বর্ণনারীতির সাথে জসীমউদ্দীনের অন্তরঙ্গ পরিচয় এখানে ব্যঙ্গময় হয়েছে। পুঁথিতে আছে : লাখে লাখে মরে সৈন্য কাতারে কাতারে/একুন করিয়া দেখি চল্লিশ হাজার কিংবা, দুই দিকে দুই ফৌজ খাড়া হৈল যদি/তরঙ্গিত হইল যেন বালুচর নদী, অথবা : ইমামের লহু যবে ছিটকাইয়া পড়িল/সিদুঁরিয়া মেঘ হইয়া আসমানে লাগিল/সেই মেঘ আজ তক জাগে সে আসমানে/। পুঁথি পাঠের ও পুঁথিকাব্য শ্রবণের অভিজ্ঞতা জসীমউদ্দীনের কবিকল্পনাকে উদ্দীপিত করেছে। নজরুলেও পুঁথি কাব্যপাঠ ও পুঁথিকাব্য শ্রবণের অভিজ্ঞতার ব্যাপক পরিচয় আছে : আসমান জমিন আদি পাহাড় বাগান/কাঁপিয়া অস্থির কৈল কারবালা ময়দান/আফতাব মাহতাব আদি কালা হইয়া গেল/জানওয়ার হরিণ পাখী কাঁদিতে লাগিল/... মালি ও মালিনী কাঁদে এলো করি চুল/হায় হায় এমাম গেল কারে দেব ফুল/যত মোছলমান ছিল এজিদ/লস্করে/জারে জারে হৈয়া কাঁদে এমাম খাতেরে/।- (জঙ্গনামা, মুহম্মদ এয়াকুব)। নজরুলের হাতে ভাষা, বিষয় ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার স্বাতন্ত্র্যের পটে কারবালার এই মর্মান্তিক ট্রাজেডির চিত্রটিই বাঙ্গময় হয়ে উঠেছে এইভাবে নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া/আম্মা লাল তেরি খুনকিয়া খুনিয়া/কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/সে কাঁদনে অাঁসু আনে সীমারের ছোরাতে/রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে/জয়নালে পরালো এ কুনিয়ারা বেশ কে?
নজরুল বিষয়ানুসারে তাঁর রচনায় হিন্দু-মুসলিম উভয় ঐতিহ্যই ব্যবহার করেছেন। পরিবেশ-বর্ণনায়, ভাষা-ব্যবহারে, উপমহা-উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে তাঁর উজ্জ্বল পরিচয় রয়েছে। জসীমউদ্দীনের রচনায়ও হিন্দু-মুসলিম উভয় ঐতিহ্যের ব্যবহার আছে। বিষয়ানুসারে তিনি যেমন পুঁথি থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন তেমনি হাত পেতেছেন পুরাণে-প্রাচীনে, বৈষ্ণব কাবা-ঐতিহ্যের ভান্ডারে : কালিন্দী-লতা গলায় জড়ায়ে সোনার গোকুল কাঁদে/ব্রজের দুলাল বাঁধা নাহি পড়ে যেন মথুরার ফাঁদে/সমাজ-পরিবেশ, চরিত্রের ধর্মীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-অনুসারে তাই তিনি উপমা দিতে গিয়ে বলেন : হ্যাচড়া পূজোর ছড়ার মত ফুরফুরিয়ে ঘোরে/হেথায় হোথায় যথায় তথায় মনের খুশী ভরে/(নমুদের কালো মেয়ে)। অন্যত্র পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে কারুণ্য মিশ্রিত ভাষায় লিখেছেন : দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীরে খোঁজ করি, মন্দিরে আজ বাজে নাক শাঁখ সন্ধ্যা-সকাল ভরি। তুলসীতলা সে জঙ্গলে ভরা, সোনার প্রদীপ লয়ে/রচেনা প্রণাম গাঁয়ের রূপসী মঙ্গলকথা কয়ে (বাস্তুত্যাগী)।
নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন ছাড়া আধুনিক বাংলা কাব্যে আর কারো রচনায় হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের এমন ব্যবহার নেই। গ্রাম বাংলার মানুষের বাস্তব জীবনের রূপকার জসীমউদ্দীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের পটভূমিতে অতীত-চারণ করে লিখেছেন : বেহুলার শোকে কাঁদিয়াছি মোরা, গংকিনী নদী সোঁতে/কত কাহিনীর ভেলায় ভাসিয়া গেছি দেশে দেশ হতে/এমাম হোসেন, সকিনার শোকে ভেসেছে হলুদপাটা/রাধিকার পার নূপুরে মুখর আমাদের পার-ঘাটা (বাস্তুত্যাগী)। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে, ময়মনসিংহ-গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকায় বিষয়ানুসারে পরিবেশ রচনায়, চরিত্র-চিত্রণে হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের ব্যাপক ব্যবহারের পরিচয় আছে। নজরুল ও জসীমউদ্দীন সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। তাঁর রচিত বহু পল্লীগীতি ও লোক-সঙ্গীতে জসীমউদ্দীন লোক-কবিদের রচনার অংশ ব্যবহার করেছেন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসাবে। চিরায়ত সাহিত্যের এই সম্পদকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন নতুন কৌশলে, অধিকতর পরিশীলিত রূপে আধুনিক ভাষায় ও ভঙ্গীতে। 
জসীমউদ্দীনের কাহিনী-কাব্য 'নকশী কাঁথার মাঠ' 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' 'সকিনা' ইত্যাদি কাহিনী-কাব্যে যেমন গ্রাম-জীবনের ছবি রূপায়িত, তেমনি 'রাখালী' 'বালুচর' 'ধানখেত' ইত্যাদি কাব্য-গ্রন্থের খন্ড কবিতায়ও গ্রাম-জীবন নানা রূপ ও রেখায় বিধৃত। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনের ছবি ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি তিনি এঁকেছেন যাযাবর বেদেদের জীবনধারার চিত্রও। শুধু রোমান্টিক দৃষ্টিতে নয়, জসীমউদ্দীন রূঢ় বাস্তবতার আলোকেও গ্রাম-জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন। ফুটিয়ে তুলেছেন শোষণ-নিপীড়নের চিত্র। এর বিরুদ্ধে ধ্বনিত হয়েছে তার প্রতিবাদী কণ্ঠ। গ্রামের রূঢ় বাস্তব জীবনের আলেখ্য তিনি এঁকেছেন এইভাবে :
রাত থম থম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর ঘোর আন্ধার
নিশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায়,
নাই কোথা সাড়া কার। 
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জলে
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরান দোলে।
[পল্লী-জননী]
গ্রামীণ জীবনের আরেকটি অতিপরিচিত চিত্র :
গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়
গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে কেউ পাকাইছে রসি
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি
কেউবা তুলিছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ করুণ ভাটির সুরে,
আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।
কিন্তু পল্লী জীবনের অমন আয়াসী চিত্র অধুনা আর তেমন লক্ষ্যযোগ্য নয়। এখন পল্লীর মানুষও কঠিন জীবন সংগ্রামের শিকার। তারাও নানা সমস্যার জালে বন্দী।। জসীমউদ্দীনের কবি অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব সচেতন জীবনদৃষ্টি এ সত্যও প্রত্যক্ষ করেছে। তার 'মাটির কান্না' ও 'সকিনা' কাব্যগ্রন্থে রয়েছে এই মানস সজাগতা এবং চেতনার পরিচয়। 'দেশ' শীর্ষক কবিতায় তিনি বলেছেন :
ক্ষেতের পরে ক্ষেত চলেছে, ক্ষেতের নাহি শেষ
সবুজ হাওয়ায় দুলছে ও কার এলোমাথার কেশ।
তারি মাথায় থোকা থোকা দোলে ধানের ছড়া,
মার অাঁচলের পরশ যেন সকল অভাব-হরা।
সেই ফসলে আসমানীদের নেইকো অধিকার
জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে হাহাকার।
অন্যত্র তিনি লিখেছেন :
মোরা লাঙল খুঁড়ে ফসল আনি
পাতাল পাথার হইতে,
সব দুনিয়ার আহার যোগাই
সেই না ফসল হইতে;
আর আমরা কেন খাইতে না পাই
পারো কি কেউ কইতে।
শোষণ-বঞ্চনার এই অনুভূতি, জনজীবনের সাথে একাত্মবোধ এবং গরীব-দুঃখীর সাথে সমমর্মিতা জসীমউদ্দীন ছাড়া আর কারো পল্লী জীবননির্ভর কবিতায় এমন সহজ ও আন্তরিক নয়। তাঁর কবিতা পড়ে একদা রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন : 'প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লিখিবার ক্ষমতা নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তাঁরা লিখিতে পারে না।' জসীমউদ্দীন প্রত্যক্ষ করেছেন : অত্যাচারীর পীড়নের ঘায়/কত ব্যথাতুর কাঁদে নিরালায়/তাদের অশ্রু গড়িয়ে পড়িছে/খোদার মাটির' পরে। কালচেতনা, বাস্তবতাবোধ এবং সমাজ চেতনা জসীমউদ্দীনকে লোক-কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
জসীমউদ্দীনের পূর্বসূরি কিংবা সমসাময়িক কোনো কবি সমকালীন জীবন নির্ভর কাব্য রচনায় লোক কাব্য ও লোকগীতির ঐশ্বর্যময় অংশকে তাঁর মতো কাজে লাগাননি। ভাষা ব্যবহার, উপমা, চিত্রকল্পনা রচনায় তাঁরা হাত পাতেননি লোক কাব্য ও লোকগীতির ঐশ্চর্যময় ভান্ডারে। জসীমউদ্দীন তাঁর কাব্যভাষার জন্যে লোক কাব্য ও লোক সঙ্গীতের স্মরণ নিয়েছেন, হাত পেতেছেন জনজীবনের কাছে। চরিত্রে কথোপকথনে, সংলাপের ভাষায়ই তিনি গ্রাম্য বাকভঙ্গী অধিক ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের জনগণের মুখের বুলির যে সাধুরীতি অর্থাৎ ক্রিয়াপদে সাধুভাষার ব্যবহার, জসীমউদ্দীনের রয়েছে তার বহুল অনুসৃতি। কথ্যভাষা ও সাধুভাষার ক্রিয়াপদকেও তিনি পাশাপাশি সংস্থাপন করেছেন দক্ষতার সাথে। তৎসম ও তদ্ভব শব্দকেও ব্যবহার করেছেন নৈপুণ্যে। জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষা জনজীবন ও লোক-কাব্যের ভাষায় আধুনিক বিবর্তিত রূপ হলেও তার আখ্যানমূলক কবিতার ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই সাযুজ্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। পূর্ববঙ্গ-গীতিকার ভাষায় বাংলাদেশের জনগণের কথ্য বুলির ক্রিয়াপদের সাধুরীতি আবৃত, জসীমউদ্দীনও একই রীতি অনুসরণ করেছেন তার কবিতার ভাষায। লোকজ শব্দ ব্যবহার এবং গ্রামীণ কথ্যরীতির অনুসরণই তার কবিতাকে বিষয়ানুসারে সহজ ও প্রাণময় করে তুলেছে। ময়মনসিংহ গীতিকার 'মহুয়া'র ভাষা: 
জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছে ঢেউ
হাসি মুখে কওনা কথা, সঙ্গে নাই মোর কেউ।
কেবা তোমার মাতা কন্যা কেবা তোমার পিতা
এই দেশে আসিবার আগে পূর্বে ছিল কোথা।
জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষা:
যাওরে বৈদেশী বন্ধু যাও হাপন ঘরে,
অভাগী অবলার কথা রাইখ মনে করে
তোমার দেশেতে বন্ধু! ফুটবে কদম কলি
আমার দেশে কাজলা মেঘা লাগবে ঢলি ঢলি।
[বৈদেশী বন্ধু]
'মহুয়া' ও জসীমউদ্দীনের 'বৈদেশী বন্ধু'র ভাষার মধ্যে প্রকৃতিগত দিক থেকে তেমন দুস্তর কোনো পার্থক্য নেই। তবে, জসীমউদ্দীনের ভাবমূলক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক বর্ণনাধর্মী কবিতার ভাষায় আধুনিক পরিশীলিত রূপ অনেক বেশি স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল। কাহিনীমূলক খন্ড পূর্ণাঙ্গ কবিতায় জসীমউদ্দীন ভাষা-ব্যবহারে লোক-কাব্য লোকগীতির রীতিভঙ্গী অনুসরণ করেছেন। কিন্তু তার খন্ড-কবিতার ভাষা অনেকখানি ভিন্ন:
উড়ানীর চর ধূলায় ধূসর
যোজন জুড়ি'
জলের উপরে ভাছিসে ধবল
বালুর পুরী
কিংবা
বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে
বালুর চরে
কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া
গাঁয়ের ঘরে।
এই ভাষা একেবারেই স্বতন্ত্র। তবুও, জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষায়- এর আধুনিক পরিশীলিত-বিবর্তিত রূপ সত্ত্বেও, লোক-কাব্যের ভাষার ঐতিহ্যের স্বাক্ষর মেলে। লোক-সাহিত্যের ধারার সাথে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখার ফলেই তা ঘটেছে। কাব্যবেত্তারা বলেন, 'রসনির্ঝরের দু'টি ধারা পাশাপাশি প্রবাহিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। একটির নাম সাহিত্য, অপরটি লোক-সাহিত্য। ধারা দুটি কখনো ভিন্ন কখনো অভিন্ন। কখনো বিচ্ছিন্ন কখনো অবিচ্ছিন্ন। সাহিত্যের গৌরবময় যুগে দেখেছি লোক-সাহিত্যের সম্পর্ক নিগুঢ়। হোমারের ইলিয়াড, কালিদাসের শকুন্তলা, শেক্সপীয়রের হ্যামলেট, গ্যেটের ফাউস্ট লোক-সাহিত্যনির্ভর। লোক-সাহিত্যের সঙ্গে যোগসূত্র ক্ষীণ হলে সাহিত্যের রসসঞ্চয় ক্ষয়ে আসে।'
জসীমউদ্দীন লোক-সাহিত্য থেকে সরাসরি কাহিনী সংগ্রহ করেননি, নবনির্মাণ করেননি প্রাচীন কোনো আখ্যায়নের। সমকালীন সমাজ থেকে কাহিনী আহরণ করলেও লোক-সাহিত্যের সঙ্গে তিনি রেখেছেন যোগসূত্র। এবং সৃজনী প্রতিভায় লোক-সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানকে কাজে লাগিয়েছেন তার রচনায়। ফলে তার সৃষ্টিকর্ম শুধু জীবনের অন্তরঙ্গ আলেখ্যই হয়ে ওঠেনি, রসসম্পদেও হয়েছে সমৃদ্ধ। এখানেই জসীমউদ্দীনের স্বাতন্ত্র্য -ও সাফল্য।


জীবন ছন্দের সুরেলা বাঁশিঃ কবি জসীমউদদীন

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

  
নদীর গতি প্রকৃতির মতই মানুষের জীবন। ঋতুর পরিবর্তনের ভঙ্গিতে এ জীবনে আসে শীত-বসন্ত, জীবন সেতারায় বেঁজে ওঠে নানা ঢঙয়ের সুর। ছন্দহীন জীবনের বেসুরাতালেও উপভোগের সাথে সাথে উপলব্ধির গান উচ্চারিত হয় বসন্তের কোকিল কিংবা ঝোপ-ঝাড়ে আচমকা গেয়ে ওঠা কোন অচেনা পাখির মতো। এ ডাকের সাথে সাথে কেউ কেউ চিনে ফেলে গানের পাখিটিকে। আর কেউবা বেখেয়ালে সেই পথ মারিয়ে এগিয়ে যায়। চেনা সুরের অচেনা পাখিকে হৃদয় খাঁচায় বন্দি করে উপলব্ধির শিকলে কাছে টেনে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন সৃজনশীল লেখকগণ। কথাসাহিত্যিক ও কবি-ছাড়াকারগণই এ যাত্রায় নাবিকের ভুমিকায় নিজেকে চিত্রিত করেন। আবহমান বাংলার চিরচেনা পল্লী জীবনের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হাজার কবির ভিড়ে স্বকীয় সুরের ঢেউয়ে ছলাৎ ছলাৎ দ্যোৎনায় বিজয়ী কান্ডারীর স্থায়ী আসন তৈরি করেছেন পল্লীকবি জসীমউদদীন (১৯০৩-১৯৭৩)। রাখাল বাঁশিয়াল থেকে শীর্ষ বুদ্ধিজীবির হৃদয়ে তিনি মাটির মমতা ছড়িয়ে দিয়েছেন অবলিলায়। জীবন ছন্দের সুরে সুরে বেজে উঠে তাঁর বাঁশির মমতাময়ী হৃদয়কাড়া সুর। তাইতো তিনি অমর, সকলের ভালবাসায় অবিস্মৃত কবিপুরুষ। 

কবি জসীমউদদীন জীবনকে উপলদ্ধি করেছেন জীবনের অস্থিমজ্জায় অনুসন্ধানী ডুবুরীর বেশে। হৃদয়কে আত্মস্থ করেছেন হৃদয় জমিনে আদর্শ চাষীর মতো চাষবাস করে। সমাজের অবহেলিত মানুষকে বিশ্লেষণ করেছেন নিজের জীবনের গাণিতিক ছন্দে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা ভাষাভাষী গ্রামীণ মানুষকে হৃদয়ের আয়নায় চিত্রিত করে আপনার সাথে একাকার করেছেন। তাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, সুখ-সাচ্ছন্দ, আনন্দ-বিনোদন সব কিছুর ব্যারোমিটারে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন তিনি। তাইতো তাঁর কাব্যভাষা, উপমা এমনকি কাহিনীর পাত্র-পাত্রীকে পর্যন্ত খুঁজে নিয়েছেন গ্রাম-গঞ্জ, মাঠ- ঘাট এবং সবুজের সমারোহ থেকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও কুমুদরঞ্জন মল্লিক, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কালিদাস রায়, করুনানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, কিংবা গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ শাহাদাত হোসেন, ফররুখ আহমদ, এমনকি জীবনানন্দ দাশও গ্রামীণ পথে নিজেদের মতো করে হেঁটেছেন। তবে জসীমউদ্দীন গ্রামীণ জীবন বোধকে চিত্রিত করেছেন একান্তই গ্রামীণ ঢঙে, গ্রামীণ পরিবেশকে তিনি জীবনের সাথে একান্ত করে নিয়ে কলমের ভাষায় ছবি এঁকেছেন দক্ষ শিল্পীর মত। সঞ্জয় ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, 'নজরুল ইসলামের পর জসীমউদদীনের আর্বিভাব যেন গায়কের পর চিত্র শিল্পীর অভূøদয়।' এ শিল্পীত কারুকাজ এক চক্ষু হরিনের মত নয়। তিনি ছবি এঁকেছেন কাজী নজরুল ইসলামের মতোই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান তালে। একই ক্যানভাসে। এ প্রসঙ্গে কবি কালিদাশ রায় বলেন, 'যতীন্দ্রনাথ ও কুমুদরঞ্জন বঙ্গের পল্লী প্রকৃতিকে দেখিয়েছেন হিন্দু চোখে, শ্রীমান জসীমউদদীন তাহাকে বাঙ্গালীর চোখে দেখিয়েছেন অর্থøাৎ হিন্দু-মুসলিম উভয়ের।' সত্যিকার অর্থেই তিনি কাজী নজরুল ইসলামের মতোই ইসলামী আদর্শের উদারতার ছোঁয়ায় সাম্প্রদায়িক গণ্ডি ভেদ করে মানবতার গান গাইতে সক্ষম হয়েছেন। 
কবি জসীমউদদীন ছিলেন ভীষণ রকম আবেগ প্রবণ শিশু মনের সরল মানুষ। লোক সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল অসাধারণ। প্রবাদ প্রবচন, লোককথা, যাত্রাগান, গাঁথার প্যাচালি, কবিয়ালের আসর প্রভৃতির প্রতি তিনি নিজেকে বিলীন করে দিতে চাইতেন। 'যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই' গ্রামীণ সংস্কৃতির সম্মানে তিনি এভাবেই খুঁজে বেড়িয়েছেন মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ আবহ। এমন আগ্রহের কারণেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই ড· দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতুনলাহিড়ী সহকারী গবেষক রূপে লোকসাহিত্য সংগ্রহায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। ফরিদপুর জেলার 'গোবিন্দপুর' গ্রামের জন্ম নিয়ে কলকাতা পর্যন্ত গোটা বাংলার পল্লী কুঠিরকে চষে বেড়িয়েছেন শেকড়ের সন্ধানে। তাঁর জীবন আচরণও পল্লীর সাথে সাদৃশ্য করে ফেলেছিলেন। রাজধানীর পুরাণ ঢাকায় বসবাস করেও তিনি পল্লী প্রকৃতিকে ভুলে যাননি মুহুর্তের জন্য। বেশভূষা, চলাচল এমনকি নিজ বাড়িটাও গরু ছাগল ও গাছ গাছালিতে গ্রামীণ ঢঙ্গে সাজিয়ে রেখেছিলেন তিনি। 

পল্লী জীবন চিত্রের গতিময়তা ও বাক মোহনাকে বিশ্লেষণ করেই জসীমউদদীন কাব্যের চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। প্রকৃতি, প্রেম, আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-দারিদ্র, সৌন্দর্য-ধর্মানুভূতি, বিপ্লব-সংগ্রাম সব কিছুরই চিত্রকল্প নির্মাণে তিনি ভীষণভাবে সফল হয়েছিলেন। রাখাল ছেলে কবিতায় তিনি প্রকৃতিকে চিত্রিত করেছেন এভাবে- 
সরসে বালা নুইয়ে গলা হলদে হাওয়ার সুখে 
মটর বোনের ঘোমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে। 
ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশি পউষ-পাগল বুড়ী- 
আমরা সেথা চষতে লাঙ্গল মুর্শীদা-গান জুড়ি। 

ধান কাটার মৌসুমে এক গ্রামের মানুষ কাজের সন্ধানে অন্য গ্রামে যায়। ফসল কাটা শেষ করে পারিশ্রমিক নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। যে সময়টা সে অবস্থান করে এ সময়ে সে যে শুধু ধানই কাটেনি মনও কেটে নেয় অনেক সময়। তাইতো কবির পল্লী প্রেমের স্বার্থক চিত্ররূপ 
আমার দেশে ধান কাটতে মন কাটিয়া গেলে 
ধানের দামই নিয়ে গেলে মনের দামটা ফেলে। 
(বৈদেশী বন্ধু) 
কিংবা 
ওপারে গোকুল এপারে মথুরা মাঝে যমুনার জল 
নীল নয়নেও তোর ব্যথা বুঝি বয়ে যায় অবিরল। 
(তরুণ কিশোর) 

হৃদয় ছোয়া উপমা উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি, অনুপ্রাস, প্রতীক ও রূপকল্পের বৈচিত্রময়তাই মুলত আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবি জসীমউদদীন তাঁর কাব্যের ছত্রে ছত্রে এসবের ব্যবহার করেছেন অসাধারণ দক্ষতার সাথে। তাঁর সৌন্দর্য চেতনা ও ্‌উপমার গাণিতিক প্রয়োগ কাব্যভাষাকে জীবন্ত করে রেখেছে। তাই তিনি গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি থেকে কবিতার গল্প নির্মাণ করলেও তাঁর ভাষার প্রয়োগ কৌশল গ্রামীণ আধুনিকতার মননশীল পাঠককে যেমন মুগ্ধ করে তেমনি গ্রামীণ জনগণকে মাটির গন্ধে প্রেমময় করে রাখে। এ দক্ষতার শিল্পী হিসেবে শুধু জসীমউদদীনকেই মানায়। 
কাঁচা ধানের পাতার মত কচিমুখের মায়া 
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া। 
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, 
গা-খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু। 
(নকশী কাঁথার মাঠ) 
কিংবা 
লাল মোরগের পাখার মতো ওড়ে তাহার শাড়ি 
ভোরের হাওয়ায় যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি। 
(নকশী কাঁথার মাঠ) 

এছাড়াও ফুল তোলা মেঘ, দুধের নবনী মেঘে, বিজলীর লতা, পাখীরা দোলাবে ছায়া, সবুজে হলুদে সোহাগ দোলায়ে, বকের মেয়েরা, দূর দেশীয়া মেঘ কনেরা, জল-শাপলা পরী, লাল নটেশাক মেলিছে রঙ্গের ঢেউ, কলমী ফুলের নোলক দেব, ও অঙ্গ বেয়ে ঝরিবে সজল সোনা, আমার দুনিয়া রঙিন করিব তোমারে মেহেদী করি। এমন সব অসাধারণ প্রেমময় সৌন্দর্য মন্ডিত পংক্তি রচনা করে যেমন অলংকারময় জীবন চিত্রিত করেছেন, তেমনি জসীমউদদীন ধমীর্য় চেতনা-বোধকেও জীবন্ত তুলির টানে চিত্রিত করেছেন অবলিলায়। 
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ-দাদু, 'আয় খোদা দয়াময়, 
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়। 
(কবর) 
কিংবা 
আড়ঙের দিনের পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই 
বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই 
(পল্লী জননী) 

কবিতা শব্দের খেলা হলেও জসীমউদদীন শব্দ হিসেবি ছিলেন না। কবিতার একই পংক্তিতে সাধু চলিত মিশ্রন লক্ষনীয়, যেমন- কেঁদে ভাসাইত বুক, ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা, মুখে তাহার জড়িয়ে গেছে, বাঁশ কাটিতে যেয়ে প্রভৃতি; কিংবা অবলিলায় প্রথাগত কাব্যিক শব্দের ব্যবহার করেছেন, যেমন অবিরল, নারে, হিয়া, বাটে, উচ্ছাস, পানে, বালা, লাগি, তরে, বহিছে, সেথা, তাহে, দেখি, করিছে, ঘোটিছে, একাকিয়া, আখর প্রভৃতি। অন্যদিকে মুসলিম সংস্কৃতির সাথে গ্রন্থিত শব্দমালাও ব্যবহার করেছেন স্বাভাবিকতার ঢঙে। কলমা, আলী, ইস্রাফিল, বেগান, আরশ, নওসা, কাফন, গোর, বুনিয়াদী, মজিদ (মসজিদ), আজান, মোনাজাত, ভেস্ত, জাহান্নাম, দরগা, ফজর, নেকী-বদী, জেয়ারত, গোরস্থান, শবে বরাত, ঈদ, খোদার আরশ, কেতাব, শাদী প্রভৃতি। আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারেও তাঁর পরমঙ্গতার দৃষ্টান্ত রয়েছে। সপ,্‌ বু-জী, হাউস, সোনারু, কান্দন, পাও, পালান, কাউয়ার ঠুট্টী, ছাও, পোলা, ডোলের বেছন, পাগল, কইজা-ফ্যাসাদ, কাটাল, সিকা, বগীলা প্রভৃতি। 

শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জসীমউদদীন কোন চাতুর্যতা কিংবা জোর জবরদস্তী করেননি। গ্রামীণ জীবনের চিত্রকে অংকিত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও কবিতার গল্প নির্মণের প্রয়োজনেই তিনি এসব শব্দকে অতি সহজ সরল ভাবেই প্রয়োগ করেছেন। মূলত শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বাছ বিচার করেননি। তাইতো সাহিত্য সমালোচক তিতাস চৌধুরী বলেন, "জসীমউদদীনের কাব্যশরীর নির্মাণের জন্য শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে কোন শুচিবায়ু ছিলনা। চলিত, দেশি-বিদেশী, লোকজ প্রভৃতি শব্দকেও তিনি কাব্যে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন। জসীমউদদীনের সহজ শব্দচয়ন কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তার বিচিত্র উপমা ও চিত্রকল্পের নতুনত্ব এবং ভাষা ব্যবহার কৌশল আমাদেরকে একদিকে যেমন একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে জাগিয়ে তুলেছে আমাদের চিরন্তন আগ্রহ ও কৌতুহল"। প্রকৃত পক্ষে জসীমউদদীনের কবিতার শরীর নির্মিত হয়েছে সাধু রীতিতে, সেই সাথে কবিতার ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়ে রেখেছেন তৎসম ও তদ্‌ভব শব্দের ফুলকুলি। 

গণমানুষের হৃদয়ের কথাগুলি কবিতার ফুল হিসেবে ফুটে তোলাই কবি জসীমউদদীনের কৃতিত্ব। গ্রাম বাংলার বিশ্বাস, রীতি-নীতি এবং জীবন পরিক্রমার শিরা উপশিরায় সফল পরিব্রাজকের নাম জসীমউদদীন। বিখ্যাত চেক লোকবিজ্ঞানী দুসান জাবেতিল জসীমউদদীনের সাহিত্য সর্ম্পকে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, 'সবচেয়ে বড় কবির পায়ের কাছে তিনি বসে ছিলেন, যার নাম জনসাধারণ। আমার বিশ্বাস, সেখান থেকে তিনি তাঁর নক্‌শী কাঁথার মাঠ, সোজন বদিয়ার ঘাট, সকিনা ইত্যাদি বইগুলির বাহিরের রূপ পেয়েছেন।' কবির প্রকৃতি প্রেমের অপরূপ নমুনা বর্নণা করেছেন বাংলা সাহিত্যের আরেক নক্ষত্র আহম্‌দ ছফা। তিনি বলেন, আমি তাঁর (জসীমউদদীনের) দিকে না তাকিয়ে বাগানে ঢুকে বললাম 'কবি সাহেব জলপানতো করলাম এখন আপনার বাগান থেকে কিছু ফুল নেই? তিনি ফুল নেয়ার কথা শুনে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, আমরা ফুলকে পুজা করি, ছিঁড়িনে। আমি বললাম, কবি সাহেব ফুলের ব্যাপারে আমার একটা আলাদা থিওরি আছে। আমরা গাছ লাগাই, জল দেই, সার দেই, ফুলের বাবার সাধ্য নেই যে না ফুটে। একথা বলে আমি একটা একটা করে বাগানের সবকটা ফুল ছিঁড়ে চাদরে ভরে নিয়েছিলাম। কবি সাহেব অবাক বিহব্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোন কথা বললেন না। আমি যখন ফুল নিয়ে চলে আসছি, তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি সারা চোখ পানিতে ভরে গেছে। আরো একটা নতুন পরিচয় পেলাম। ইনি হলেন কবি জসীমউদদীন। ফুলের শোকে যিনি শিশুর মতো কাঁদতে পারেন। তাঁর কাব্য লোকে ভালবাসবে না কেন?' সত্যিকার অর্থে জসীম উদ্দীন শুধু কলমের ডগায় নয়, গ্রাম বাংলার ভালবাসাকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন গোটা অঙ্গে-ভিতরে বাইরে। তাইতো তিনি পল্লী বাংলার অমর কবি, জীবন ছন্দের সুরেলা বাঁশি।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/DrMahfuzurRahmanAkanda

পল্লীকবির ভিটে-মাটিতে

২৯ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১১:১৪

শেয়ার করুনঃ
00

প্রচুর বই পড়া হয় কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি আমার তেমন একটা আগ্রহ কোনকালেই ছিলো না। তবে একজনের বেলায় ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা- তিনি হলেন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন। নক্সীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট সহ জসীমউদ্দিনের অনেক বই পড়েছি, কিন্তু কখনো বিরক্তবোধ করিনি। অনেকদিনের ইচ্ছা ছিলো ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে কবির ভিটে-মাটি দেখতে যাওয়ার। কিন্তু মাঝখানে প্রতিবন্ধক হিসেবে ছিলো পদ্মা নদী এবং আরো অনেক অদেখা বাঁধা। তো গত ষোলই এপ্রিল আকস্মিক ডিসিশান নিয়েই নিলাম যে করেই হোক অম্বিকাপুর ঘুরে আসব। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস-স্টীমার-বাস এভাবে ভেংগে ভেংগে ফরিদপুর পৌঁছালাম। স্টীমারে পদ্মা পার হওয়ার সময় খুব ভয়ে ছিলাম সাঁতার না জানার কারণে। তবে অম্বিকাপুর পৌঁছানোর পর মনে হলো কষ্ট সার্থক হয়েছে। ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। ঘুরে দেখলাম জসীমউদ্দিনের স্মৃতি বিজড়িত সব স্থান এবং তাঁর বইয়ে বর্ণিত জায়গাগুলো। এই ভ্রমণের কিছু ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম--- 

কবি বাড়ির প্রধান ফটক
 

 

বাড়ির সামনেই কুমার নদী(খাল), যে নদীর সাথে জড়িয়ে আছে জসীমউদ্দিনের শৈশবের অনেক সোনালি মুহূর্ত
 





 

কুমার নদীর তীরেই আছে প্রশস্ত খোলা সবুজ মাঠ, যেখানে বসলে মনে হবে সারাজীবন ধরে বসেই থাকি। বসার জন্য সুন্দর কিছু পাকা ঘর বানিয়ে দেয়া হয়েছে। 




 



মাঠ থেকে রাস্তায় ওঠার সিঁড়িটাও অপরূপ।
 



জসীমউদ্দিনদের আদি বাড়ি






ছেলের কাছে লেখা কবির চিঠির অংশবিশেষ
 

বাড়ির পেছনের অংশ। বসার জন্য এখানে বেন্চ আছে। যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্য ফসলের মাঠ। এখানটায় প্রাণ জুড়ানো যে চমৎকার বাতাসটা পাওয়া যায় তার দাম কোটি টাকা। 


 



কবির বাড়ির আংগিনায় বেলগাছে বেল ধরেছে 


জসীমউদ্দিনের স্মৃতিচিহ্ণ নিয়ে মিনি যাদুঘর।






কবিকন্যা হাস্না জসীমউদ্দিন, বিএনপি নেতা ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদের সহধর্মিণী


কবিদের পারিবারিক কবরস্থান- এখানে শুয়ে আছেন কবির পিতা আনসার উদ্দিন, মা রাঙাছুটু, বড়ছেলে, কবিপত্নী ও ভাইয়েরা। 




গ্রামের ছায়া সুনিবিড় শান্ত পরিবেশে শুয়ে আছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন


কবির কবরের পেছনেই আছে ডালিম গাছ যেটা মনে করিয়ে দেয় কালজয়ী কবিতার দুটি লাইন--
" এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দু'নয়নের জলে। " 


যারা জসীমউদ্দিনের 'সোজন-বাদিয়ার ঘাট' পড়েছেন তাঁদের কাছে এই নাম অপরিচিত নয়। পল্লীকবির অন্যতম সেরা রচনা এটি। একটি হিন্দু মেয়ে ও মুসলমান ছেলের প্রেম-বিরহ নিয়ে গড়ে উঠেছে এর কাহিনী। তো সেই সোজন-বাদিয়ার ঘাটের ছবি দেখুন-- 






অম্বিকাপুরের শ্মশাণ, কবির লেখায় এটির বর্ণনা এসেছে অনেকবার




বড়ু নামের হলুদ-বরণ এক মেয়েকে কবি খুব পছন্দ করতেন। অম্বিকাপুরেই ছিলো মেয়েটির বাড়ী। কিন্তু মেয়েটির অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। জসীমউদ্দিন তাঁর আত্মজীবনী "জীবনকথায়" মেয়েটির কথা বলেছেন। বড়ুদের বাড়ী সোজন বাদিয়ার ঘাটের কাছেই। সবাই চেনে রহিম মল্লিকের বাড়ী নামে।


বিদায় অম্বিকাপুর!! ফরিদপুর শহরের পথে
 


এবার আপনাদের কাছ থেকেও বিদায় নেয়ার পালা। সবাই ভালো থাকবেন। আমার প্রিয় কয়েকটি ছত্র আবৃত্তি করে বিদায় নিচ্ছি----

(১) 
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই,
যেন গোরে থেকেও মুয়ায্যিনের আযান শুনতে পাই।
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই জান্নাতীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
( কাজী নজরুল ইসলাম)

(২)
মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেন ভাই
এরচেয়ে মধুর ধ্বনি ত্রিভুবনে নাই।
( অজানা )

 

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১০ 

http://www.somewhereinblog.net/blog/talhatitumir/29144635

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors