সৌরভ দিয়্যা  চাকমা*
বাঙালি জাতি একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী/সাম্প্রদায়ীক জাতি। এ বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা যায় যে, অনেক বাঙালি আছেন, যারা উগ্র জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়ীক কোনোটিই নন; বরং তারা মানবতাবাদী এবং তাদেরকে আমরা আমাদের পাশে সব সময় পেয়েছি। এটি জুম্মদের (পাহাড়ি) মধ্যে মতদ্বৈততা বা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে দুঃখজনক সহিংস আক্রমনের পর এই প্রশ্নটি এখন আলোচনার আসছে। জুম্মদের এক অংশ বলছে, বাঙালি মাত্রই উগ্র জাতীয়তাবাদী/সাম্প্রদায়ীক। আবার অন্য অংশ বলছে, সবাই এ রকম নন। অনেক ভালো বাঙালিও আছেন।
আসুন, আমরা এই মতদ্বৈততার গভীরে যাই। কারণ এটি ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আরো বিভ্রান্তি বাড়াতে পারে, এমনকি তৈরি করতে পারে আদর্শশুন্যতা।
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা, গণধর্ষন, অত্যাচার, নিপীড়ন চলেছে, সেটি কী পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বাঙালি জাতিগোষ্ঠি আশা করেছিলো? অবশ্যই নয়। ১৯৭১ এ হত্যা-নিপীড়ন হয়েছে পাকিস্তান সামরিক জান্তা এবং তাদের দোসর একাংশ বাঙালি রাজাকার দ্বারাই। সে সময় অবশ্যই পাকিস্তানেও মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনেক সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী এমনকি সেনা কর্মকর্তারাও ছিলেন। তাহলে ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের দোষ দেওয়ার সময় আমরা পুরো পাকিস্তান জাতিকে দোষী করি কেনো? প্রত্যেক সমাজে বা জাতিতে ভালো-মন্দ এবং পক্ষ-বিপক্ষের মানুষ থাকেন। তাদের সবাইকে একসঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্র। ১৯৭১ এর প্রশ্নে আমরা আসলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে দোষারোপ করি।
রাষ্ট্র যদি জাতি বিদ্বেষ বা সাম্প্রাদায়ীক বা বৈষম্যমূলক আচরণ করে, যদি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ভাষাগত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠিগুলোর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলে, এর পরোক্ষ দায়ভার নির্যাতনকারী রাষ্ট্রের পুরো জাতির ওপর বর্তায়। কাজেই জাতিগত ও সাম্প্রাদায়ীক মনোভাবের কারণে জুম্ম আদিবাসী গোষ্ঠির ওপর চলে আসা রাষ্ট্রের অত্যাচার, গণহত্যা, গণধর্ষন, অবিচার, নির্যাতনের দায়ভার প্রত্যক্ষভাবে পুরো বাঙালি জাতিগোষ্ঠিকে নিতে হবে। তাদের সবাইকে নির্যাতনমূলক বাঙালি জনগোষ্ঠির সদস্য হওয়ায় লজ্জিত হতে হবে। বাঙালিদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রগতিশীল ও মানবিক হলেও এখানে এর ব্যত্যয় হয়না।
বাঙালিদের মধ্যে যারা মানবিক মানুষ, তারা সংকীর্ণমনা বা উগ্র জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়ীক বাঙালিদের উর্দ্ধে অবস্থান করেন; তারা মানবতাবাদী। মানবিক তাড়না থেকেই তাদের দায়িত্ব নিতে হবে, উগ্র জাত্যাভিমান ও সাম্প্রদায়ীকতা হটিয়ে দেশটিকে সব জাতি, ধর্ম, বর্ণের একটি বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়ীকতার আবাসভূমিতে রূপান্তর করতে। এটি ছিলো ১৯৭১ এর "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা"।
যতদিন জুম্মদের অধিকার, সন্মান ও আত্নমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে, ততদিন বাঙালি জাতি একটি উগ্র জাত্যাভিমানী ও সাম্প্রদায়ীক; নিপীড়ক, নির্যাতক, নির্লজ্জ, অশিক্ষিত ও অসভ্য জাতি হিসেবেই চিহ্নিত হবে। …
বাংলাদেশের রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় মনোভাব দুটি ধরণে প্রকাশিত: এক. উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং দুই. চরম মৌলবাদ। ১৯৭১ সালের ব্যপক নির্যাতন-নিপীড়ন-লুঠপাটে বাঙালিদের অংশ গ্রহণ ছিলো সামান্যই। বিতর্কের খাতিরে আমরা যদি পাকিস্তান ও ভারত প্রসঙ্গ আপাতত বাদ দেই, তাহলে নতুন প্রজন্মের কাছে একটি প্রশ্ন থাকে:
এটি যদি বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ হয়, তাহলে তখন বাঙালিরাই বাঙালিদের মেরেছিলো কেনো?
এর জবাবে বলতে হয়, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই রাজনীতির খেলায় দুই ভিন্ন পক্ষ উগ্র জাত্যাভিমান ও সাম্প্রাদায়ীকতার বীজ বপন করেছিলো; পরে সেই বীজ লালন করে পক্ষ দুটি যার যার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছিলো। ১৯৭১ এর যুদ্ধটি ছিলো এই দুটি শক্তির সরাসরি সম্মুখ অবস্থানের প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক চাপ এবং আরো বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে পাকিস্তান এতো সহজেই এ দেশ ছেড়ে চলে গেলো।গুঢ় অর্থে,  তার মানে এই নয় যে, তারা পরাজয় স্বীকার করেছে। তারা জানে যে, কতোটা শক্তপ্রাণের মৌলবাদী বীজ তারা এদেশে বপন করে গেছে; যা এখন বীষবৃক্ষ আকারে প্রকাশিত। ১৯৭১ এ শুরু হওয়া সেই যুদ্ধটি এখনো চলছে। জানিনা করে শেষ হবে।…
এই দুই পক্ষের যুদ্ধের বাইরে এদেশে যারা জাতিগতভাবে নিস্কৃয়তায় অবস্থান করছে, তারা হচ্ছি আমরা, পাহাড়ের জুম্ম আদিবাসী জনগোষ্ঠি। প্রকৃতিগতভাবে আমরা এই যুদ্ধের অংশ নই, কারণ আমরা কেউ বাঙালি নই, মুসলিমও নই। ১৯৭১ সালের পর থেকে উগ্র বাঙালিবাদ চেয়ে আসছে যে, আমরা যেনো বাঙালি হয়ে যাই; আর ধর্মীয় মৌলবাদীরা চেয়ে আসছে, আমরা যাতে মুসলিম হয়ে যাই। যখন তারা দেখেছে, আমরা কোনো পক্ষে নেই, বরং আমরা জুম্ম জাতীয়তাবাদের পক্ষে, তখন ওই দুই মতবাদীদের তাত্ত্বিক নেতারা চরম উদ্বিগ্নতায় পড়েছে। তারা ভেবে ভয় পেয়েছে, ওদের ময়দানে এ আবার কোন জাতীয়তাবাদ! এটি ওই দুই পক্ষেরই অভিন্ন শত্রু।
এর পর থেকেই বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মৌলাবাদ — এই দুটি পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জুম্ম জাতির অস্তিত্ব মুছে ফেলার জন্য।
বিষয়টি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, জুম্মদের যে কোনো একটি পক্ষ নিতে হবে, নইলে কেউই আর এদেশে থাকতে পারবে না।
জুম্ম জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত, প্রয়াত নেতা এমএন লারমা ছিলেন অতি দূরদর্শী। জুম্ম জাতিকে রক্ষা করতে তিনি সঠিক সময়ে জাতিগোষ্ঠিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ এবং পরে আত্নরক্ষামূলক সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিতও করেন।
সবশেষে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে অনুরোধ জানাই, অহেতুক এই চরমপন্থার রাজনীতির ফাঁদে পা না দিয়ে শিগগিরই এই দেশকে ওই একই ফাঁদ থেকে মুক্ত করুন। আশারাখি, বাঙালি জাতি কোনদিনই  বিশ্বের কাছে নাৎসি ফ্যাসিস্টদের মতো ঘৃন্যভাবে উপস্থাপিত হবে না।
ছবি: সেনা নিরাপত্তার বলয়ে লাঠিসোটা নিয়ে সশস্ত্র সেটেলাররা, রাঙামাটি সদর, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২, ফেবু থেকে সংগৃহিত।