Twitter

Follow palashbiswaskl on Twitter

Friday, June 28, 2013

নিছক সহবাস করে যাবে পুরুষ? পিতৃত্বের দায় এড়িয়ে আর কত দিন

নিছক সহবাস করে যাবে পুরুষ? পিতৃত্বের দায় এড়িয়ে আর কত দিন

নিছক সহবাস করে যাবে পুরুষ?  পিতৃত্বের দায় এড়িয়ে আর কত দিন
মাদ্রাজ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায় হয়তো বদলে দেবে ভারতে লিঙ্গ-বৈষম্যের গোটা ছবিটাই৷ অন্তত এমনটা আশা করার ইঙ্গিত যথেষ্ট৷ লিখছেনরুচিরা গুপ্ত

সত্তরের দশকের সেই বচ্চন-যুগ৷ একের-পর-এক সুপারহিট ছবির মূল কাহিনি-কাঠামোটি ঠিক কী রকম ছিল? চিরকালীন মাতৃরূপা নিরুপা রায়৷ স্বামী বা প্রেমিকের দ্বারা প্রতারিতা বা পরিত্যক্তা৷ দুই সন্তানের জননী তিনি৷ এবং 'বাবা'টি যেহেতু পলাতক, সন্তানদের দায়িত্ব বর্তেছে একা মায়েরই উপর৷ মুখে রক্ত তুলে মা মানুষ করেন দুই পুত্রকে৷ একজন বনে যায় দুষ্কৃতী, অন্য জন পুলিশ অফিসার৷ সমাজের কাছে দু'জনেই দু'পথে ন্যায়প্রার্থী৷ এ সেই সমাজ, যে একজনকে পুরুষকে স্বেচ্ছায় চূড়ান্ত শক্তি দিয়েছে, যে শক্তির উপর ভর করে সেই পুরুষ সন্তান তো উত্‍পাদন করে, কিন্ত্ত সন্তানদের লালন-পালনের ভার এড়িয়ে যায়৷

এই সব ছবির মূল কাহিনি সেই সব মায়ের গল্প বলে, যাদের অপরাধ, তারা কোনও না কোনও সময়ে পুরুষ সঙ্গীটির উপর ভরসা করেছিল৷ বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে অথবা বিয়ের অপেক্ষা না-রেখেই সেই পুরুষের সন্তানের মা হয়েছে৷ তারপর থেকে সন্তান-সহ পরিত্যক্তা সেই সব মা৷ পুরুষটির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মূল্য চুকিয়ে যেতে হয় মেয়েটিকেই৷ এই দেশে আজও কত মা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়, সমাজও তাদের পাশে দাঁড়ায় না৷ আর্থিক, সামাজিক দু'দিক থেকেই বিপন্ন এই মেয়েরা কুণ্ঠিত ভাবে বেঁচে থাকে, কোনওক্রমে৷ অথচ মূল অপরাধী যে পুরুষ, যে 'বিয়ে' নামক স্বীকৃতিটিও দেয় না, সন্তানের দায়ভারও অস্বীকার করে, সে বেঁচে থাকে মাথা উঁচু করে৷

এই চিরকালীন সামাজিক ব্যাধিটির মূলে প্রথম সে ভাবে আঘাত হানল মাদ্রাজ হাইকোর্ট৷ এক মহিলা, প্রেমিকের সন্তান গর্ভে ধারণ করেন, দু'টি সন্তানও হয়, যথারীতি এরপর 'বাবা'টি দায় নিতে অস্বীকার করে৷ রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি সি এস কারনান নির্দেশ দেন, ওই পুরুষটিকে সন্তান রক্ষণাবেক্ষণের দায় নিতে হবে৷ পাশাপাশি, নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে তাকে বিয়ের সমতুল ঘোষণা করার কথাও এই রায়ে বলা হয়৷ তা হলে অন্তত সন্তানের দায় নিতে পুরুষটিকে বাধ্য করা যাবে৷ এবং এই রায় এই কথা আরও একবার প্রমাণ করল, যৌন সম্পর্কে যেমন নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতি জরুরি, একই ভাবে সন্তান লালনের দায়িত্বও বাবা-মা দু'জনেরই৷ এবং সেই দায় এড়িয়ে যাওয়া আইনের চোখে অপরাধই৷

সেই ভাবে জাতীয় পরিসংখ্যান কিছু পাওয়া না-গেলেও কেরলের তফশিলি জাতি ও উপজাতি বিভাগের করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে রাজ্যে অবিবাহিত মায়ের সংখ্যা কম করে ৫৬৩৷ অন্য দিকে, কেরল মহিলা কমিশনের হিসেব বলছে এই সংখ্যাটি দু'হাজারেরও বেশি৷ ডেপুটি পুলিশ ইন্সপেক্টর-জেনারেল এস শ্রীজিত একটি তদন্ত চালিয়ে দেখেছেন ওই রাজ্যের উপজাতি এলাকায় রয়েছেন হাজারেরও বেশি সংখ্যক অবিবাহিত মা৷ কেরল মহিলা কমিশনের পর্যবেক্ষণ, অবিবাহিত মায়েদের অধিকাংশের বয়সই ১৪ থেকে ২০-এর মধ্যে৷ এবং বাস্তব এটাও, এই মায়েরা নিজেদের এবং সন্তানদের বাঁচাতে অধিকাংশই 'বেশ্যাবৃত্তি' বেছে নিতে বাধ্য হয়৷

বাস্তবের আরও একটি দিক রয়েছে৷ দেখা গিয়েছে, অবিবাহিত মায়েদের অনেকেই দলিত অথবা উপজাতি সম্প্রদায়ের৷ ঐতিহাসিক ভাবেই এটা সত্য৷ আজও৷ এর মূলে রয়েছে জাতপাতের চূড়ান্ত বৈষম্য৷ কারণ, এই দলিত বা উপজাতি মেয়েদের শরীর ভোগ করে উচ্চবর্ণের পুরুষেরা৷ যারা এই মেয়েদের কখনওই বিয়ে করে না, সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া তো দূরস্থান৷ ভোগশেষে এই মেয়েরা নিক্ষিপ্ত হয়, নিজেদের টিকিয়ে রাখতে তারপর দেহব্যবসা ভিন্ন আর কোনও পথ খোলা থাকে না৷ আর তাদের ছেলেমেয়েরা? তারাই হল দেশের সবথেকে সস্তায় পাওয়া শ্রমিক! বলা যায়, এর উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের তামাম অর্থনীতি৷

মেয়েদের এই সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি কারনানের রায়টি গভীর সমবেদনার পরিচয় দেয়৷ ভারতের প্রাচীন সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ঘরানার চিন্তা-ভাবনার দ্বন্দ্ব, সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী কোনও সত্যে পৌঁছবার চেষ্টা রয়েছে৷ রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ কিংবা উপনিষদে বিবিধ সংস্কৃতি ও বিভিন্ন আদর্শের এই সংঘাত বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়৷ পিতৃতান্ত্রিক, উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, ঠিক করা হয়েছে, কোনটি ঠিক, কোনটিই বা ভুল, একই ভাবে বিভিন্ন দলিত ও উপজাতি তথা নিম্নবর্গীয়দের জায়গায় দাঁড়িয়েও উচিত-অনুচিত স্থির করা হয়েছে৷ দেখা গিয়েছে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন আইন কিংবা নীতিশাস্ত্রকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ একটা আইন ভেঙে তৈরি হয়েছে অন্য একটি আইন৷ এই ভাঙাগড়ার পর্ব যুগে যুগে অব্যাহত থেকেছে৷

উপনিষদে যেমন ঋষি গৌতম কুমারী মাতা জাবালাকে রীতিমতো শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেছেন৷ জাবালা-পুত্র সত্যকামের বড়ো হয়ে ওঠার যাবতীয় সামাজিক দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন গৌতম৷ শুধু তা-ই নয়, মাতা-পুত্র যাতে সচ্ছল ভাবে, স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে পারে, সে জন্য জাবালাকে ঋষি ১০০টি গাভী দান করেন৷ অন্য দিকে, তুলসী রামায়ণে রামচন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করতেই চাননি, কারণ, রাজ্যবাসীদের একজন সীতাপুত্র লব-কুশের পিতা কে, এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন৷ তফাতটা এখানেই৷ দৃষ্টিভঙ্গির তফাত৷ বিচারপতি কারনানের রায়টি নানা দিক থেকে মেয়েদের পক্ষে স্বস্তিজনক, প্রগতিশীলও৷ কোনও মেয়ে যদি চায়, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে জন্ম নেওয়া সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব প্রেমিকটিও নিক, তা হলে আইন মেয়েটির পাশেই রয়েছে৷ অন্য দিকে, এমন হতেই পারে, সে সন্তান চাইল, প্রেমিককেও চাইল সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে, কিন্ত্ত কোনও কারণে ওই পুরুষটিকে 'বিয়ে' করতে চাইল না৷ আইন তখনও মেয়েটির পাশেই থাকবে৷

আমাদের দেশে এ রকমও ঘটে৷ কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হলে পারিবারিক চাপাচাপিতে মেয়েটি অনেক সময় তার ধর্ষককেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়৷ পুরুষতন্ত্র এমন জাল বিছিয়ে রেখেছে, এখনও অনেক ক্ষেত্রে মনে করা হয়, কোনও মেয়ের 'কৌমার্য' যে পুরুষ প্রথম 'হরণ' করে, সেই পুরুষেরই অধিকার তৈরি হয় মেয়েটির শরীরের উপর৷ আর মেয়েদের আত্মার খবর কে কবে রেখেছে! এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই ধন্য হয়ে যান অভিভাবকরা৷ পুরুষটিও সমাজে দিব্যি মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়৷ কারণ এর উল্টো ছবিটাও সমান মর্মান্তিক৷ 'একা মা' সমাজে সন্তানকে মানুষ করতে হিমশিম খেতে থাকেন, দারিদ্র এক দিকে, অন্য দিকে সামাজিক কলঙ্ক৷ সব মিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মায়ের জীবন৷

আজকের সমাজে কোনও যৌন সম্পর্কে পুরুষের দায়িত্ব কতটুকু? এক, বিয়ের মাধ্যমে থাকার জায়গা করে দেওয়া মেয়েটিকে, বড়জোর যৌন সম্পর্কের সময়ে কন্ডোম ব্যবহার করা৷ আজকের দিনেও মনে করা হয়, প্রাক্-বিবাহ যৌন সম্পর্কের পর 'বিয়ে' হল মেয়েটির কাছে সেই অসামান্য ঘটনা, যা কি না, পুরুষটি তাকে 'উপহার' দিচ্ছে৷ বিয়েতে সম্মত হওয়া মানে পুরুষটির চূড়ান্ত বদান্যতা প্রকাশ পাওয়া৷ কারণ বিয়ের মাধ্যমেই স্বামীর বাড়ি ও সম্পত্তির প্রতি আইনি অধিকার জন্মায় মেয়েটির৷ নিজের টিকে থাকার জন্য এবং সন্তানদের বড়ো করে তোলার জন্য যা জরুরি৷ বহু সন্তান ও তাদের মায়েদের কাছে বিয়ের সঙ্গে বৈধতার সম্পর্কটা একেবারেই প্রত্যক্ষ৷ হয়তো বিয়ের প্রয়োজনীয়তাও সেইখানেই৷ বিয়েতে পুরুষের সম্মতি তাই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় একটি ব্রহ্মাস্ত্র৷ যা দিয়ে পুতুলের মতো খেলানো যাবে মেয়েদের৷

বিচারপতি কারনানের নির্দেশ অবশ্য ভিন্ন ধরনের নজিরও সৃষ্টি করতেই পারে৷ অন্তত সেই নজির তৈরির আশঙ্কা একটা থেকেই যায়৷ বহু মহিলা এর অপপ্রয়োগ ঘটাতে পারেন৷ বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে বা ভিতরে থেকে পুরুষদের উপর অন্যায় অভিযোগ করারও একটা আশঙ্কা তৈরি হয়৷ কিন্ত্ত সেই আশঙ্কা সত্ত্বেও কোনও একটা জায়গা থেকে শুরু তো করতে হবে! মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব- দুই-ই যাতে সমান ভার পায়, সেই ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে৷ প্রগতির, উন্নততর সমাজের চাবিকাঠিটি সেখানেই লুকনো আছে৷ পিতৃত্ব মানে নিছক আর্থিক ভার বহনই নয়, সন্তান লালনের সঙ্গে আরও সরাসরি যুক্ত থাকা৷ শিশুর যত্নে বাবারা যত বেশি সময় ব্যয় করবেন, ততই সহিষ্ণুতা, সহানুভূতির মতো মানবিক হৃদয়বৃত্তি বিকাশ পাবে৷ শিশুরা একটি অনুকূল পরিবেশ পাবে, যেখানে মানসিক শান্তি মিলবে, অকারণ হিংসার প্রবণতা দূর হবে৷ পরিবারের মধ্যেও নিগ্রহ ও অশান্তির পরিমণ্ডল থাকবে না৷

অনেক সময়েই কোনও আইনি পরিবর্তন বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়৷ আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে সামাজিক বহু ছোটখাটো বিষয় কখনও কখনও বৈধতা পায়৷ আবার অনেক বৈধ বিষয়ও অবৈধ বলে ঘোষিত হয়৷ ব্রিটিশ আইনে সমকামিতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল৷ তার জেরে আজও নানা রকম সামাজিক হয়রানির মধ্যে কাটাতে হয় সমকামীদের৷ পাশাপাশি, এই যে দেহব্যবসায়ীদের সম্পর্কে আমাদের একটা সাধারণ ধারণা কাজ করে যে তারা 'খারাপ', সেটাও আইনেরই অবদান৷ অথচ যে পুরুষেরা ওই মেয়েদের কাছে যান, তাঁরা নিছকই পুরুষ৷ 'ভালো', 'মন্দ' কোনও তকমা সমাজ তাঁদের গায়ে এঁটে দেয় না৷ প্রকাশ্যে সেই মেয়েদের অপমানজনক ভাবে গ্রেফতার করা হয়৷ কিন্ত্ত তাঁদের খদ্দের বা দালালরা কখন, কোথায় ধরা পড়ল, আদৌ ধরা পড়ল কি না, তা কত জন দেখতে পান? ক্রিমিনাল রেকর্ডস বরাদ্দ হয় মেয়েদের জন্যই৷ সমাজে কোনও পেশাকে কিংবা কোনও সম্পর্ককে কোন চোখে দেখা হবে, সেটা তাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেয় আইনই৷

মাদ্রাজ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি যৌনতা, সম্পর্ক, বিয়ে, পিতৃত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গে বিতর্কের ঢেউ তুলতে পারে৷ কিন্ত্ত এই বিতর্কই এক উন্নততর ভারত নির্মাণের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেবে৷ যে সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য অপেক্ষাকৃত কম৷ যে সমাজ অনেকটা সুইডেনের মতো৷ যে দেশে অবিবাহিত মায়েরা সন্তান বড়ো করার যাবতীয় খরচ পেয়ে যান সরকারি তহবিল থেকেই৷ সন্তানের বাবারা সেই খরচ আংশিক ভাবে বা পূর্ণ ভাবে মিটিয়ে দিতে বাধ্য থাকেন৷ অর্থাত্‍ সন্তান ধারণ সেই দেশে কোনও 'অভিশাপ' নয়৷ অস্বাভাবিকও নয়৷

লেখক 'আপনে আপ' সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors