Twitter

Follow palashbiswaskl on Twitter

Monday, August 5, 2013

প্রেম সন্দীপনের পক্ষে অনিবার্য অবলম্বন

প্রেম সন্দীপনের পক্ষে অনিবার্য অবলম্বন
কমল চক্রবর্তী


তুম্বিনি কখনও দেখিনি৷ এত শুনেছি, যেন শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ৷ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পুজো অবকাশে, ওই তুম্বিনির প্রশস্তি৷ খোলা মাঠ, দূরদূর উঁচু-নিচু রাস্তা৷ গাছপালা, ঘন হয়ে নেমে আসা, আকাশ৷ স্কুল বাড়ি, যেখানে নির্জন-বাসস্থান৷ বাচ্চারা ক'টা দিন এলোপাথাড়ি ফুটবল, আর হাল্লাবোলরবীন্দ্রনাথ, নিউটন থেকে মুক্ত৷ 

আমাকেও কয়েকবার যেতে বলেছেন৷ রামপুর হাটের ট্রেনে৷ যাওয়া হয়নি৷ ওখানে, ওই স্কুলেই কে ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী, সুরমা৷ জিজ্ঞাসা করা হয়নি৷ একদিন বরাহনগরের দোতলায়৷ এক ধুতিপরা ভদ্রলোক৷ 

আমি যেখানে বেড়াতে যাই, তুম্বিনির মাস্টারমশাই৷ 

আমি তুম্বিনির আরও কাছে চলে যাই৷ কিন্ত্ত সন্দীপন যদ্দূর প্রকাশ একবার আমেরিকায়৷ তাও ভাই ও স্ত্রী, গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রয়াত হওয়াতে৷ 

পুজোয় বেড়াতে যেতেনই৷ একবার রাঁচি ফেরতা জামশেদপুরে৷ আমাদের বাড়ি৷ সম্ভবত রাঁচিতে বরুণ চৌধুরীর বাড়ি৷ আমাদের দলবল সকাল সন্ধে সন্দীপন-এর৷ তার খাদ্য খাবার আনন্দ আহ্লাদ৷ স্কুটারে এ দিক সে দিক৷ যদিও বলতেন- ওরে ভয় করছে৷ বডি ব্যালেন্স থাকছে না৷ 

ফলে খুব দূর পরিকল্পনা সত্ত্বেও, হয়নি৷ কারণ, তখন অতিথি এলেই দলমা ফুটহিলে, মনোহর সিং-এর ধাবায়৷ ঠাকুরের রান্না৷ হাইওয়ে প্রিপারেশন৷ দারুণ৷ বড়ো বড়ো অশ্বত্থ, শিরিষ গাছের ছায়ায় খাটিয়া বার পাঁচখানা৷ মাঝে সমান্তরাল কাঠের টেবিল৷ দলমার ছায়া, গেলাসে৷ 
প্রাচীন পাহাড়ের নৈর্ব্যক্তিক ওঁ৷ সকাল দশটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচ ছয়৷ ছুটন্ত দিশি মুরগি দেখিয়ে, পণ্ডিত বলত, উসকো বানায়গা! প্লেটে শসা, পেঁয়াজ, মূলো, কাঁচালঙ্কা, টমাটো, উপরে ছড়ানো মশলা৷ সবার খুবই ইচ্ছে মনোহরের ধাবায়৷ একটা দিন-ছায়া৷ একটা নিগূঢ়, নিবিড়, সভা৷ রীনা বউদির অসুবিধেয়, না৷ ফলে আমাদের মৃগয়াক্ষেত্র পাহাড় অধিবেশন বানচাল৷ তবে ঘরে বসেও, সন্দীপন৷ একটা খুব সহজ, স্বাভাবিক, না-মধ্যবিত্ত, না-কাঙাল, না-আড়ষ্ট৷ দু'তিনটে, অমোঘ দিন৷ এবং বলা যায়, তাঁর সময় তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য, গদ্যকার৷ 

একবার উত্‍পল কুমার বসু, কবি, বলেছিলেন, সন্দীপন মিসিং লিঙ্ক৷ বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরত্‍, বাড়ুজ্জে, সতীনাথ, কমলকুমার একটাধারাবাহিকতা, কিন্ত্ত সন্দীপন, প্রক্ষিপ্ত৷ এই গদ্য বাংলা ভাষায়, অপূর্ব৷ 

সন্দীপনকে প্রথম দিকে, সন্দেহ৷ কারণ যখনই বাড়িতে, পেয়েছি৷ সাধারণত সকালের দিকে বেরুতেন না৷ বিকেল, আড্ডা, ও মদ্যের৷উনি যেকর্পোরেশনে জানতে জানতে বছর৷ খুবই নিম্নমধ্যবিত্ত৷ পড়ার টেবিলটিও আবর্জনা৷ খুবই ছোট ছোট দু'টি ঘর৷ তারই মধ্যে রীনা বউদির ঘরটিহয়তো সামান্য বড়ো৷ এবং লোহার আলমারিহীন৷ আনন্দবাজার বার্ষিক সংখ্যায় প্রথম ও শেষ উপন্যাস-'এখন আমার কোন অসুখ' জনিত টাকায়, প্রথম আলমারি৷ এখনও মুন্নির (মেয়ে) কথা মনে পড়ে, অমিতাভ বচ্চনের থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা৷ 

আপিস যেতেন না, মাইনে পেতেন, কারণ ওই লাল বাড়িতে অনেক 'উপরি'৷ সন্দীপন, নেবেন না৷ ফলে, তাঁর কাজ কিছু, যাঁরা নেবেন তাদের৷আমরা দুপুরে খেয়ে, কোন ডাইনিং টেবিল ছিল না৷ খুব কষ্ট করে বইপত্র ইত্যাদি সরিয়ে, দু'থালা৷ বউদি ভালো রান্না, ঘটি বাড়ির৷ আমরা ওরই মধ্যেদুপুরে একটু ঝিমোনো৷ কষ্টকর৷ না, পাশের ঘরের বাসিন্দা মুন্নি স্কুলে, বউদিও স্কুলে৷ 

আমরা সাহিত্য বিষয়ক, স্বপ্নহীন, কিছু৷ কখন কিছু আগে বেরিয়ে চুনিবাবুর বাজারে গৌরকিশোর ঘোষের বাড়ি৷ আর আসত সামনে ফ্ল্যাট থেকে কমল৷ মাঝেমাঝে দুপুরের দিকে, তাস পেসেন্স৷ পাশের নরেন্দ্রনাথ স্কুলের হই হই, কাশীনাথ দত্ত রোড, গভীর অ্যাবস্ট্র্যাক্ট৷ সামনের স্তূপাকার, ব্যালকনির ফাঁকে এক জোড়া বদ্রি৷ মাঝে মাঝে দানা খাওয়াতে দেখেছি৷ 

যখন রাতে, ৭১খ (ওঁর দেওয়া নাম৷ ৭১ ক-এ বউদি ও মুন্নি) গুঁজেমুজে, ভোরে বাথরুমের জল, দোতলায় ভারি৷ ওঃ! ভারির দেরি হলে সে যেকীবাপান্ত! আজ মনে হয়, এত আরবান, আরকী দেখেছি৷ এত যন্ত্রণার জীবন (!)৷ আরএক চাটুজ্জে, শক্তির বাড়িতে, ব্রহ্মসমাজ রোড, কর্নেল বিশ্বাসে থেকেছি, বিন্দাস৷ সেভাবেবলতেগেলে মীনাক্ষিদি খুব শান্তশিষ্ট, রীনাবউদি মেজাজি, তাতো নয়৷ দু'জনেই চাকরিবাকরিতে৷ দু'জনেই, দেব ভূত ঝেড়ে৷ যাকগে, সন্দীপন খুবই অর্থ-হীন৷ আমি এক বার একটা ক্যাসেট কিনতে যাই৷ এনএফডিসি, পথের পাঁচালি৷ উনি বললেন, 'ও আমি তোমায় দেব৷ কিনো না৷' সেআরদিয়েউঠতে পারেননি৷ আমি আজও ওঁর টাকার ব্যাপারটা বুঝেউঠতেপারিনি৷ কারণ, রীনাবউদির স্কুল, করপোরেশন, শেষেতা ১৯৮০-৮১ থেকে 'আজকাল' দৈনিকে সবিনয় নিবেদন পাঠকের চিঠিপত্র দেখতেন, একটা নিয়মিত মাসোহারা, তবু কোথায় যেন অর্থানটন৷ অথচ শুধু কর্পোরেশনের মেথর হয়ে ঢুকলে দোতলা বাড়ির, এ উদাহরণ নিশ্চয় দিতে হয় না৷ শুধু সন্দীপন? 

ফলে তার সিমলা বা নৈনিতাল, পুজোয় হয়নি৷ তুম্বিনির পর বরুণ চৌধুরীর রাঁচি৷ পরের বার ফের বরুণ চৌধুরীর লাক্সা রোডের কাশী৷ 

পরের বার সমীর রায়চৌধুরীর চাইবাসা৷ যেখানে মানুষের বাড়ি, মাথা গোঁজা৷ সৌখিন কিছু ওর চেতলার বাড়িতেও দেখিনি৷ যেহেতু চেতলা বাজারে সিআইটি খুবই ছোট ফ্ল্যাট, সেখানে বাথরুমে টাইলস৷ আমরা খঁুজে পেতে ওই বাজারেরই এক মিস্ত্রি এবং টাইলস৷আমি কখনও তাঁকে ট্যাক্সিতে, না৷ এমনকী টুটুল, আমি আর সন্দীপন! শীতের রাতে রাজভবনের পিছনের রাস্তায়, নির্জন৷ আমি খানিক এগিয়ে৷ দু'টো সিগারেট নাও৷ 'কিছু নাথাকা' দিয়ে এতটা পথ চলা! একবার এই প্রেমিকার জন্য সম্ভবত! 'হাউহুয়া' নামেএক চিনে রেস্তোঁরা৷ সেএক গল্প৷ সন্দীপন সম্ভব ওখানে, ওই হাউহুয়াতে ইতিপূর্বে৷ ঢুকে ঠিক নির্জনতম৷ এমনিতেই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ওই রেঁস্তোরা বাঙালি রসিকদের, নয়৷ এর ঝিম আলো, না-ভিড়, একটু কম উঁকিঝুকি, ফলে৷সন্দীপন কিছু পরে বললেন, চিমনি স্যুপ নিই, কী বল? আমি কী বলব! নামটাই প্রথম শুনছি৷ মানে, বিষয় আশয়, না৷ মেনু দেখেঠাহর, বেশ দামি একখানা প্লেট৷ বিকেলের কর্পোরেশন থেকেহেঁটে, কম নয়৷ সঙ্গে প্রেমিকা, টুটুল৷ ভালোই এক সাধনমার্গে, ক্রীতদাস, ক্রীতদাসী৷ফলে, একটু খাওয়া যাক, হ্যাঁ! 

কথা, একা সন্দীপনই৷ আমরা মাঝে মাঝে, 'হ্যাঁ' বা 'না' এবং বিভিন্ন ধরনের হাসি৷ যুবতী বিষয়ক আকুতি চোখে৷ প্রেম ওর পক্ষে অনিবার্য অবলম্বন৷ বাহুল্যহীন, এবং শরীর সচেতন৷ একটু টয়লেটে যাই৷ ওদের জন্য মিনিট কয়েক৷ এবং ততক্ষণে চিমনির ধোঁয়া৷ বিশাল, বগি মালার মতো৷ প্রায় ইঞ্চি দুই ধার৷ মাঝে চিমনি৷ চিমনি ঘিরে গোল রিং৷ এবং থালার নীচে আরও একটি অদৃশ্য থালা যেখানে কাঠকয়লার আগুন৷ 

ফলে চিমনি ও ধোঁয়া৷ এবং থালায় সেদ্ধ প্রায়, মকাই, এ্যারারুট, কাঁকড়া, চিংড়ি, শুয়োর, চিকেন, শতমূলী, ক্যাপসিকাম, সামান্য নুডল, গাজর ইত্যাদি৷ পাশের সিরামিক বাসনে ভিনিগার, টমাটোসস, সয়াসস, চিলিসস ইত্যাদি৷ যে যার প্লেটে তুলে সস৷ খেয়ে যতটা খুশি, তার থেকেও বেশি, দেখে, চিমনির ধোঁয়া, আমাদের নিবিড় নির্জনতা৷ অখণ্ড, তদারকিহীন সময়৷ আমরা অনেকক্ষণ মুখোমুখি৷ ক্রমে টুটুলকে আমিও৷ অতক্ষণ, অতটা ঠান্ডায়, মুখোমুখি৷ মনেই থাকে না কে কার! 

আর এক বার নেহরু রোডের ওয়াইএমসিএ৷ ব্যালকনিতে আমাদের নির্জন৷ ভিতরে উচ্ছ্বাস, টেবল টেনিস, ক্যারম ইত্যাদি৷ বাইরে পাউডার,পমেটমহীন, একহারা সন্দীপন৷ 

প্রথাহীন, তীব্র, এক আরবান৷ বিজনের রক্তমাংস, যতটা বাংলাসাহিত্যের, ততটা আমাদের, আর কবে? তুম্বিনী থেকে চাইবাসা, রাঁচি থেকে কাশী এই যার দৌড়, তার শারদীয়া তুমুল কখনও কি?


No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors