Twitter

Follow palashbiswaskl on Twitter

Friday, October 18, 2013

শুধু রচনাবলী খুঁজলেই ঐতিহাসিকের দায় শেষ?

শুধু রচনাবলী খুঁজলেই ঐতিহাসিকের দায় শেষ?

শুধু রচনাবলী খুঁজলেই ঐতিহাসিকের দায় শেষ?
দুনিয়াভর সন্ধান৷ অজস্র নথি, বিবরণীর তল্লাশি৷ এ ভাবেই রূপ নিয়েছে 'গান্ধী বিফোর ইন্ডিয়া'৷ সেই বই এবং গান্ধী সম্পর্কে একান্ত আলাপেরামচন্দ্র গুহ৷ কথা বলেছেন শোভন তরফদার




শোভন তরফদার: আপনি কিছু দিন আগে একটি সাক্ষাত্‍কারে বলেছেন, প্রতিটি ভারতীয় ঐতিহাসিককেই কখনও না কখনও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় নামতে হয়৷ কেন, একটু বুঝিয়ে বলবেন? 



রামচন্দ্র গুহ: কারণটা খুব সহজ৷ গান্ধীর চরিত্রটাই অসম্ভব আকর্ষণীয়৷ এবং, আমাদের জীবনের প্রতিটি পরতেই তিনি কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে৷ ফলে, অনিবার্যও বটে৷ আপনি রাজনীতি বলুন, সামাজিক পরিসর বলুন, এমনকী খেলা, সেখানেও- আমি যখন 'আ কর্নার অফ আ ফরেন ফিল্ড' বইটা লিখছিলাম, তার মধ্যেও মহাত্মা গান্ধীকে এড়াতে পারিনি৷ ক্রিকেট নিয়ে লিখতে গিয়ে গান্ধীর অজস্র উল্লেখ খুঁজে পেয়েছি৷ যদিও তিনি নিজে ক্রিকেটে উত্‍সাহী ছিলেন না, কিন্ত্ত সেই সময়কার ক্রিকেটের রাজনীতি, তার ডায়নামিক্স কী করে গান্ধীকে এড়িয়ে চলবে? আর, এখনও তিনি ভীষণ ভাবেই সমকালীন৷ ফলে যাঁরা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন এবং যাঁরা করেন না, কোনও পক্ষই কিন্ত্ত তাঁকে অস্বীকার করতে পারেন না৷ সেই কারণেই আমি ওই কথাটা বলেছিলাম, যে ঐতিহাসিকই আধুনিক ভারত নিয়ে কাজ করুন না কেন, তাঁর পক্ষে গান্ধীর সঙ্গে মোকাবিলাটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়৷ আমি নিজে দীর্ঘকাল ধরে গান্ধী-চর্চা করে চলেছি, আমার নানা লেখালিখির মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে গান্ধীর প্রসঙ্গ বার বার এসেছে৷ তার পর অ্যাকাডেমিক কাজের সূত্রে নানা দেশে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, গান্ধীকে নিয়ে অজস্র তথ্য এ দিক ও দিক ছড়িয়ে আছে৷ তাই একটা সময় ভাবলাম, এ বার গান্ধীর একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার দিকেই এগোনো উচিত৷ 



একটু পুরনো কথায় যাই৷ কিছুকাল আগে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে আপনাকে একটা কোর্স পড়ানোর আমন্ত্রণ করল, আপনি জানালেন যে কোর্সটির বিষয় হোক 'আর্গুমেন্টস্ উইথ গান্ধী'৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটু সংশয় ছিল, এই রকম একটি কোর্সে আদৌ কোনও ছাত্র-ছাত্রী আগ্রহী হবে তো? শেষমেষ অনেকেই আগ্রহী হল এবং খুব সফল ভাবেই শেষ হল সেই কোর্স৷ এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে আপনি একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলেছিলেন- আদৌ কি ভাবা যায়, কোনও একটি কোর্সের নাম হচ্ছে 'আর্গুমেন্টস্ উইথ রুজভেল্ট' কিংবা 'আর্গুমেন্টস্ উইথ দ্য গল'৷ অর্থাত্‍ , গান্ধী এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক, সেটা বলতে গিয়েই আপনার এই উদাহরণ৷ আমি এর পাশে রাখতে চাইছি আর একটি মন্তব্য৷ সম্প্রতি প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার বলেছেন গান্ধীর পথ ও মত এখন আর ততটা প্রাসঙ্গিক নয়৷ আপনার প্রতিক্রিয়া? 

ব্লেয়ার এ কথা বলেছেন নাকি? আমি এখনও খবরটা দেখিনি, প্রেক্ষিতটাও জানি না, তাই কী কারণে এই মন্তব্য তা বলতে পারব না৷ তবে নানা সময়ই গান্ধীকে নিয়ে নানা জন পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কিছু বলেন৷ ব্লেয়ারের মন্তব্যটি বিশদে না জেনে কিছু বলা ঠিক হবে না৷ 



তা হলে অন্তত এটা বলুন, আপনার মতে মহাত্মা গান্ধী এখনও কেন সমকালীন? তাঁর তাত্‍পর্যটা কোথায়? 

এই জন্যই সমকালীন যে গান্ধী তাঁর জীবন এবং তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে, তাঁর বিভিন্ন লেখালিখির মধ্যে দিয়ে একের পর এক মৌলিক বিষয়ে আলো ফেলেছেন৷ ধরা যাক, রাজনীতি৷ সেই রাজনীতির চলনটা, অর্থাত্‍ যাকে 'কনডাক্ট অফ পলিটিক্স' বলে, তার ধাঁচটা কী রকম হবে, সে বিষয়ে তিনি আলো ফেলেছেন৷ যখন প্রশাসন বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, সমান অধিকার মিলছে না, সেই পরিস্থিতিতে কী ভাবে তার বিরোধিতা করা যায়, তা-ও তিনি দেখাচ্ছেন৷ বা, ধরা যাক ধর্ম৷ এই ঘটমান বর্তমান কালটা ধর্ম নিয়ে নানা রকম হানাহানিতে রক্তাক্ত৷ এক দিকে নাস্তিকতা, অন্য দিকে ধর্মীয় মৌলবাদ, এই আড়াআড়ি দু'ভাগে ভেঙে-যাওয়া পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে গান্ধী জানাচ্ছেন, না, এর বাইরেও একটা তৃতীয় পন্থা আছে৷ নিজের বিশ্বাসটা আঁকড়ে থাকো, চেষ্টা করো কী ভাবে তাকে আরও উন্নত করা যেতে পারে, অন্য লোকেদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক আর পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক গড়ে তোলো৷ তা ছাড়া, পরিবেশ-সংক্রান্ত নানা সংকট নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কথা সুবিদিত৷ এ সব থেকেই বুঝতে পারা যায়, কেন হঠাত্‍ টোনি ব্লেয়ার তাঁকে অস্বীকার করতে চাইছেন৷ একটা সময় নকশালপন্থীরাও তাঁকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন৷ অর্থাত্‍, যদিও আজ থেকে ৬৫ বছর আগে তাঁর দেহাবসান ঘটেছে, কিন্ত্ত এখনও তিনি সময়ের সামনে, সমাজের সামনে বেশ কিছু গভীর এবং সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারেন৷ আসলে, গান্ধীকে আক্রমণ করার প্রবণতাই বুঝিয়ে দেয় যে তিনি এখনও ঠিক কতটা প্রাসঙ্গিক৷ তা না হলে লোকে বহু কাল আগে নিহত একটি মানুষকে নিয়ে খামখা এত মাথা ঘামাতে যাবে কেন? যদি তারা দেখে যে অন্য কিছু লোক গান্ধীর ভাবধারাকে এখনও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, তখনই তাঁকে আক্রমণ করার প্রশ্ন ওঠে৷ 



আপনার সাম্প্রতিক গ্রন্থ 'গান্ধী বিফোর ইন্ডিয়া'-য় আপনি দেখিয়েছেন, স্কুল-জীবনে কিন্ত্ত মোহনদাস করমচাঁদ নিতান্তই মধ্যমেধার ছাত্র ছিলেন৷ পরে সেই মুখচোরা ছাত্রটিই হয়ে উঠলেন জাতির নিয়ন্তা৷ 

ঠিকই, স্কুলে পড়ার সময় যাকে বলে মিডিওকার, গান্ধী সে রকমই ছাত্র ছিলেন৷ সত্‍, পরিশ্রমী, কিন্ত্ত যাকে বলে চোখ-ধাঁধানো ছাত্র, তা মোটেই নয়৷ পোরবন্দরে কাথিয়াওয়াড় হাইস্কুলের একটা দেওয়াল আলমারি থেকে তাঁর স্কুল জীবনের নানা নথিপত্র সংগ্রহ করেছিলেন এক গুজরাটি স্কুল-শিক্ষক৷ সেই সব কাগজপত্র আমার এই বইটায় খুবই কাজে লেগেছে৷ তো, সেই ভদ্রলোক তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের শেষে একটা কথা বলেছিলেন৷ খুব ইন্টারেস্টিং কথা৷ ভদ্রলোক বলেছিলেন, গান্ধীজির সম্পর্কে বলা হয় যে তিনি নিছক কাদা মাটির তাল থেকে মহানায়ক তৈরি করেছিলেন৷ সে ক্ষেত্রে এটাও বলা উচিত যে সেই পরীক্ষাটা হয়তো সর্বপ্রথম এবং সব থেকে সফল ভাবে তিনি নিজের জীবনেই চালিয়েছিলেন৷ কাদার তাল থেকেই উঠে এসেছিলেন ভারতের ইতিহাস বদলে দেওয়া এক জননেতা৷ 


রিচার্ড অ্যাটেনবরো-র 'গান্ধী' ছবিটি নিয়ে সম্প্রতি একটি সাক্ষাত্‍কারে আপনি বলেছেন, কখনও কোনও ফিচার ছবিকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করবেন না৷ সে মন্তব্যের প্রেক্ষিতটা ছিল এই যে, অ্যাটেনবরো পিটারমারিত্‍জবার্গ-এ গান্ধীকে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাটা বড়ো করে দেখিয়েছেন, অথচ, ডারবান-এ গান্ধীকে যে জনরোষের শিকার হতে হয়েছিল, সে ব্যাপারটা সামনে আনেননি৷ 
ঠিকই, ১৮৯৭-তে ডারবান-এর বন্দরে গণরোষের মুখে গান্ধীর প্রাণ সংশয় হওয়ার উপক্রম হয়েছিল৷ সে ঘটনায় অ্যাটেনবরো ততটা গুরুত্ব দেননি৷ আমি নানা নথিপত্র জোগাড় করে দেখিয়েছি, গান্ধীর জীবনী লিখতে গেলে এই বিশেষ কাণ্ডটাকে ভুলে গেলে চলবে না৷ তখন এক বার দেশে এসেছিলেন গান্ধী, তারপর সপরিবার ফিরছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, তখন বন্দরে বেশ কিছু লোক গান্ধীকে আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে জমায়েত হল কেন, কী তাদের ক্ষোভের কারণ- দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন গান্ধীর কার্যক্রম যদি খুঁটিয়ে দেখেন, বোঝা যাবে এই কাণ্ডটার তাত্‍পর্য ঠিক কতখানি৷ অথচ, এত বড়ো একটা ঘটনার কথা সাধারণ মানুষ জানে না বললেই চলে৷ আমি এই বইটায় ইতিহাস খুঁড়ে তেমনই কিছু অজানা তথ্য তুলে আনতে চেয়েছি৷ 



গান্ধীর মতো একজন জননায়কের জীবনী যখন নতুন করে কেউ নির্মাণ করতে চান, তখন তাঁদের অধিকাংশই, যেমন আপনি বলেছেন, ওই একশো খণ্ড গান্ধীর কালেক্টেড ওয়ার্কস্ এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন, তার বাইরে বেরোতে চান না৷ 

দেখুন, কোনটা 'মিথ' আর কোনটা 'রিয়্যালিটি', সে হিসেবটা ভালো ভাবে বুঝে নিতে গেলে আপনাকে ইতিহাসের নানা রকম উপাদান-উপকরণের দিকে, নানা রকম সম্ভাব্য টুকরো টাকরার দিকে চোখ ফেরাতে হবে৷ তার আত্মজীবনীর বাইরেও অন্য নানা জায়গায় নজর দিতে হবে৷ আমার বইটা শুরুই হচ্ছে গান্ধীর রচনা থেকে একটি এপিগ্রাফ দিয়ে, তার গোড়াটুকু এই রকম- 'I understand more clearly today that what I read long ago about the inadequacy of autobiography as history. I know that I do not set down in this story all that I remember...' সুতরাং, কথাটা হচ্ছে এই যে আপনাকে গান্ধীর যে দৃষ্টিকোণ, যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার বাইরেও নিজের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে৷ সেটা খুব জরুরি৷ সমকালীন নানা তথ্য, নথি, ঘটনা বিবরণ- এ সব খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ঐতিহাসিক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা এটাই যে যদি কোনও স্মৃতি, অন্তত বছর তিরিশের পাল্লার মধ্যে হয়, তা হলে কিন্ত্ত তার মধ্যে নানা রকম ভুলভ্রান্তির আশঙ্কা থেকে যায়৷ ধরা যাক, ১৯০৫ সালে কোনও ঘটনা ঘটেছে৷ ১৯৩৫-এ এসে কেউ আপনাকে বলছেন, তিরিশ বছর আগে অমুক অমুক কাণ্ড ঘটেছিল৷ সেটা একটা বয়ান৷ আবার ১৯০৫-এই কেউ হয়তো লিখে যাচ্ছেন, যে এই সব কাণ্ড ঘটেছে৷ ঐতিহাসিক হিসেবে আমি কিন্ত্ত এই দ্বিতীয় বয়ানটিকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দেব৷ এই জন্যই গান্ধীর জীবন, তাঁর দীর্ঘ যাত্রাপথ, তাঁর সংগ্রাম- এই গোটা জিনিসটাকে নতুন করে ধরার জন্য আমি যথাসম্ভব তাঁর সমকালীন নথিপত্রগুলি ঘেঁটে দেখেছি৷ তা ছাড়া, এটাও সত্যি যে সাধারণত ফিচার ছবি সোজাসরল ধাঁচে চলে, তার মধ্যে সাদা-কালোর ভাগাভাগিটা খুব স্পষ্ট গোছের থাকে৷ ফলে, অনেক কিছু বাদও দিতে হয়৷ যেমন অ্যাটেনবরো-র ওই ছবিটায় আম্বেদকর বা সুভাষচন্দ্র বসু কেউই নেই৷ ছবিটাতে জওহরলাল নেহরু কিংবা বল্লভভাই প্যাটেলকে রাখা সহজ, কারণ তাঁরা গান্ধীর অনুগামী৷ আবার, অন্য দিকে জিন্না কিংবা ভাইসরয়কেও রাখাটা কঠিন নয়, কারণ তাঁরা গান্ধীর বিরোধী৷ গান্ধী জাতিভেদ প্রথাকে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন, আম্বেদকরও চেয়েছিলেন, কিন্ত্ত এ দু'জন ঠিক একই ভাবে সেই কাজটা করতে চাননি৷ আবার সুভাষচন্দ্র বসু দীর্ঘকাল কংগ্রেসের সদস্য, নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন, গান্ধীর অনুগামীও ছিলেন, কিন্ত্ত পরে তাঁদের সম্পর্কে ভাঙন ধরে৷ সমস্যা হচ্ছে, এত কিছু দেখাতে গিয়ে আপনি তো আর ছবিটাকে বেশি রকম জটিল করে ফেলতে পারবেন না৷ ছবিটা বেশ সরলরেখায় এগিয়েছিল, প্রচুর মানুষকে টেনেওছিল সে জন্য, আর মোটের উপর বলতে পারি, আমারও দেখে ভালোই লেগেছিল৷ গান্ধীর নৈতিক সাহস, তাঁর সম্ভ্রম, অহিংসাকে প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা, এই সব ছবিটা থেকে বেশ ভালো ভাবেই বেরিয়ে এসেছিল৷ কিন্ত্ত, যদি আপনি দেখতে চান যে 'রেপ্রেজেন্টেশন' হিসেবে ছবিটা কতখানি নিখুঁত, তখন সমস্যা৷ আমি বলব না যে ছবিটা ইতিহাসকে 'ইনঅ্যাকিউরেট' ভাবে তুলে ধরেছে, বরং এটা বলব যে ছবিটা অনেক ক্ষেত্রেই ইতিহাসের সরলীকরণ করেছে৷ সেটা করতে গিয়ে কোনও কোনও ঘটনাকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছে যা তাদের প্রাপ্য নয়, আবার কোনও কোনও ঘটনাকে একদম এড়িয়ে গিয়েছে৷ তবে, এটাও ঠিক যে, আমি লেখার জন্য ছ'শো পাতা পেয়েছি৷ অ্যাটেনবরো পেয়েছেন মাত্র তিনটি ঘণ্টা, ফলে কিছু সীমাবদ্ধতা তো থেকেই যায়৷ সিনেমায় কাহিনির স্পষ্ট একটা ধারা বজায় রাখতে হয়৷ কিন্ত্ত, ইতিহাস যে ভাবে চলে, তার মধ্যে নানা ধূসর অঞ্চল, নানা রকম বাঁক-বদল ইত্যাদি থাকে৷ সে সব বাদ দিয়ে ইতিহাসকে নির্মাণ করা অসম্ভব৷ 


ভারতে একটা অভ্যেস চালু আছে যে, যাঁকেই মহানায়ক বলে গণ্য করা হয়, তাঁকেই প্রায় একটা অলৌকিক শ্রদ্ধার মিনারে তুলে দেওয়া হয়, তাঁর সম্বন্ধে কোনও বিরুদ্ধ মন্তব্যই তখন আর চট করে সামনে আসে না৷ রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এ জিনিস হয়েছে, সুভাষচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রে হয়েছে...গান্ধীর জীবন নিয়েও নানা রকম বিতর্কিত ঘটনার কথা শোনা যায়৷ ধরা যাক, বড় ছেলে হরিলালের সঙ্গে তাঁর তিক্ত সম্পর্ক...সে সব নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা শোনা যায় কি? 
আপনি যে কথা বলছেন, সে কথা অনেকের ক্ষেত্রেই খাটে৷ যেমন রবীন্দ্রনাথ, যেমন সুভাষচন্দ্র, যেমন আম্বেদকর, যেমন শিবাজী৷ কিন্ত্ত গান্ধীর ক্ষেত্রে খাটে না৷ গান্ধীর প্রসঙ্গে যেটা সব থেকে উল্লেখ করার মতো বিষয় তা হল এই, এখন কিন্ত্ত গান্ধী সম্পর্কে যে কেউ যে কোনও রকম কথা বলতে পারেন, কেউ আপনার বাড়িতে আগুন লাগাতে আসবে না, আপনার বইটাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ভয় নেই৷ তার কারণটা এই যে, গান্ধী কিন্ত্ত কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে আর আবদ্ধ নন৷ তিনি নিছক গুজরাটি আইকন নন, দলিত আইকন নন, কোনও বিশেষ জাতিসম্প্রদায়ের পরিচয়ে তাঁকে ধরা যাবে না৷ আপনার কথাটা মানতে পারছি না এই জন্য যে গান্ধীকে নিয়ে কিন্ত্ত প্রচুর সমালোচনা হয়েছে৷ ঠিকই, ওই যাকে আপনি অলৌকিক শ্রদ্ধা বলছেন, সে রকম একটা জিনিস গান্ধীর ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কিন্ত্ত সেটা আসলে ভারতীয়দেরই একটা বিশেষ ধরনের মানসিকতা৷ সাধারণ ভাবে, ভারতীয়রা যাঁকে বিখ্যাত মানুষ বলে ভাবেন, তাঁদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন নিয়ে জনপরিসরে কথাবার্তা চলুক, চর্চা-টর্চা হোক, এ সব তাঁরা একদমই পছন্দ করেন না৷ এটা আবার আমেরিকার ঠিক উল্টো৷ ধরা যাক, যদি কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশেষ কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, সমস্ত কাগজ প্রথম পাতায় সে খবর ছাপবে৷ অথচ, এখানে যদি তেমন কোনও রাষ্ট্রনেতার জীবনে এই ধরনের ঘটনা ঘটে, জনজীবনে খুব একটা হইচই হওয়াটা অস্বাভাবিক৷ হবেও না৷ বাবা হিসেবে গান্ধীর ব্যক্তিগত অনুভবের কথা আমি লিখেছি, তবে তা নিয়ে আগেও যে কথাবার্তা হয়নি তা নয়৷ একেবারে এই বিষয়ের উপরেই একটা নাটক ছিল, একটা ছবিও হয়েছিল 'গান্ধী মাই ফাদার' নামে৷ সেটা মোটেই ফেলে দেওয়ার মতো ছবি নয়৷ আর একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ গান্ধীর সঙ্গে কোনও সম্প্রদায় বা কোনও দলই কিন্ত্ত আর জড়িয়ে নেই৷ আপনি রাজীব গান্ধীর বিষয়ে নেতিবাচক কিছু বললে কংগ্রেস ক্ষিপ্ত হতে পারে৷ বা, ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বাঙালিরা খুবই স্পর্শকাতর৷ মনে আছে খুশবন্ত সিং এক বার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কিছু একটা বলেছিলেন, এবং ভাবাই যায় না, অচিরেই পশ্চিমবঙ্গে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল, এতটাই যে বিধানসভায় রীতিমতো এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাশ করা হল! মহারাষ্ট্রে বসে আপনি শিবাজি নিয়ে টুঁ শব্দটি করতে পারবেন না৷ সে দিক দিয়ে গান্ধী ভাগ্যবান৷ যে কেউ তাঁকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে পারে, তিক্ততম সমালোচনার মুখে ফেলতে পারে৷ গান্ধী সকলের, এবং একই সঙ্গে আবার, গান্ধী কারওরই নন৷ হি বিলংস টু এভরিওয়ান অ্যান্ড নো ওয়ান! 



শেষ প্রশ্ন এটাই যে এই যুগে জননেতা হতে গেলে মিডিয়াকে দক্ষ ভাবে সামলানো শিখতে হয়৷ বিশেষত যখন টিভি ক্যামেরা আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চাহনি খেয়াল রাখে৷ এই পরিস্থিতিতে গান্ধী কতটা সফল হতেন বলে আপনার মনে হয়? 

বলা শক্ত, কারণ গান্ধী সত্যিই খুব সুবক্তা ছিলেন না৷ তিনি অনেক সময়ই শব্দ হাতড়াতেন, বাক্যবাণে জনতাকে বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার শক্তি তাঁর ছিল না বলেই মনে হয়৷ হয়তো চেষ্টা করে খানিকটা সফল হতেও পারতেন৷ আন্না হাজারেও তো খুব বড়ো মাপের বক্তা নন, কিন্ত্ত তিনি তো সাফল্য পেয়েছেন৷ গান্ধীর সময়ে দেশি মিডিয়া বলতে ছিল বিভিন্ন ভাষার সংবাদপত্র এবং এটা ভুলে গেলে চলবে না যে গান্ধী কিন্ত্ত দেশটা চষে বেড়িয়েছেন৷ ট্রেনে করে ঘুরেছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত৷ সেটাই ছিল তাঁর জনসংযোগ৷ তত্‍কালীন মিডিয়াতে তাঁর এই প্রত্যক্ষ জনসংযোগের রাস্তা খুব সফল হয়েছিল, কিন্ত্ত এই অষ্টপ্রহর টেলিভিশনের যুগে কী হত, তা সত্যিই বলা কঠিন৷ 

'গান্ধী বিফোর ইন্ডিয়া', রামচন্দ্র গুহ পেঙ্গুইন, ৮৯৯ টাকা 

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors