Twitter

Follow palashbiswaskl on Twitter

Wednesday, November 5, 2014

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : আবার ধর্ষণ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : আবার ধর্ষণ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নিপীড়ন, সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তার ভয়াবহ আকারে ঘটে চললেও সবাই যেন তা দেখেও না দেখার ভান করছে। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলেও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। সাধারণ শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষক, ক্যাম্পাসের আলোচিত বুদ্ধিজীবী মহল এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারও কোনো কার্যকর ভূমিকা বা উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। চলতি বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাবমূর্তিকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক ক্যাম্পাসের সর্বত্র মাদকের বিস্তার ও নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো শক্ত উদ্যোগের বিপরীতে দেখা গেছে সব পক্ষের এড়িয়ে যাবার মানসিকতা। স্বাভাবিকভাবেই যা সমস্যাকে আরও গভীরতর করে তুলছে।

ধর্ষণের প্রমাণ মেলে না!
জাবিতে নারী নিপীড়ন ঘটছে নানা প্রকারে। বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এ বছর এমন অভিযোগ উঠেছে বেশ কয়েকটি। ক্যাম্পাসের ছাত্রীরাও ছিনতাই, টিজিং ও অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন নিয়মিত। ফলে ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের চলাফেরা সীমিত হচ্ছে। সন্ধ্যার পর আগের তুলনায় ছাত্রীরা হল থেকে কম বের হন। আগে যেখানে মাঝরাত পর্যন্ত ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ চত্বরগুলো মুখরিত থাকত, এখন সেখানে রাত দশটার মধ্যেই ক্যাম্পাস সুনসান হয়ে যাচ্ছে।  নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় বর্ষ পড়–য়া অর্থনীতি বিভাগের একজন ছাত্রী বলেন, 'ক্যাম্পাসের এমন অবস্থার কথা ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে বলেছিলাম। এখন আমার মা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে হলে ফিরেছি কি না, জিজ্ঞেস করে। তাড়াতাড়ি হলে ঢুকে যেতে বলে। অথচ ভর্তির সময় পরিবার থেকে সবাই এই ক্যাম্পাসটিকে নিরাপদ ভেবে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। সন্ধ্যার পরে কোনো কাজে বের হলে টিজিংয়ের শিকার হতেই হবে। সিনিয়র-জুনিয়র কোনো বিষয় নেই। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো মারপিটের ঘটনাও ঘটেছে।'

নিয়মিত একজন ছাত্রীকে যখন এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসে বহিরাগতরা পড়ছেন আরও বড় সমস্যার মধ্যে। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দুপুরে ঈদুল আজহার ছুটিতে বহিরাগত এক তরুণী বোটানিক্যাল গার্ডেনে গণধর্ষণের শিকার হন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিগত এক বছরে কমপক্ষে এমন তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার শক্ত অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাগুলো জানলেও তারা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 'অভিযোগের ভিত্তি নেই' বা 'আমরা জানি না' বা 'লিখিত কোনো অভিযোগ কেউ করেনি' ইত্যাদি বলে দায় এড়িয়ে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী, নিরাপত্তা রক্ষী, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৯ অক্টোবর ক্যাম্পাসে ঈদুল আজহার ছুটি চলছিল। ছুটির সময়ে হল খালি করার নির্দেশনা জারি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে পুরো ক্যাম্পাস ছিল শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ। কিন্তু পোষ্যকোটায় ভর্তি হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বজন কিছু শিক্ষার্থী ছুটির এই সময়টিতে ক্যাম্পাসেই ছিল। ঘটনার দিন এদের সঙ্গে আরও ৮-১০ জন ছিল। তারা সবাই মিলে ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় নিয়মিত আড্ডা দেয়।

৯ অক্টোবর একটি যুগল ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসে। তারা বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় যাওয়া মাত্র তরুণটিকে কিল-ঘুষি দিয়ে ওই দলের দুজন মিলে বেঁধে ফেলে। বাকিরা তরুণীটিকে পাশে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে এবং ফেলে রেখে যায়।গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত মর্মে কয়েকজনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ ওঠে। এদের মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের ভাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আসিফ ইকবাল। প্রকৌশল অফিসের মিস্ত্রি আলমগীর মাস্টারের ছোট ভাই প্রততত্ত্ব বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রাসেল খন্দকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের পিয়ন ইসমাইলের ছেলে সোহেল ঈসরাফিল ও আ ফ ম কামাল উদ্দিন হলের নিরাপত্তা প্রহরী মাহবুবের ছোট ভাই শওকত আকবর। ক্যাম্পাসে ছিনতাই, টিজিং, নারী নিপীড়নসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে এদের বিরুদ্ধে।

সূত্র জানায়, আসিফ ইকবালের বড় ভাই আব্দুর রহমান বাবুল বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের অভিনয় ও ব্ল্যাকমেইল করে দেড় মাস যাবৎ জোরপূর্বক নিয়মিত শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করার মতো জঘন্য অভিযোগ রয়েছে আসিফের বিরুদ্ধে। এছাড়াও ক্যাম্পাসের আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের সঙ্গে তার যুক্ত থাকার বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ অনেকেই ওয়াকিবহাল।

রাসেল খন্দকার আল বেরুনী হল ছাত্রলীগের সভাপতি উজ্জ্বল কুমারের ছত্রছায়ায় থাকে। গত রোজার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ইসলামনগর বাজারে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দ্বারা এক দোকান ভাঙচুরে সে যুক্ত থাকে ও ২৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে। হলে একাধিকবার বড়দের গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনা ঘটিয়েও সে পার পেয়ে গেছে।

সোহেল ঈসরাফিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের পরিচয় দেয়। বিএনপির হরতালের সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গাড়ি ভাঙচুরের দায়ে কয়েক মাস আগে গ্রেফতার হয়েছিল। পরে জামিনে বের হয়ে এসেই ইসলামনগর বাজারে প্রকাশ্যে পিস্তল নিয়ে মহড়া দেয় বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে।

শওকত আকবরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাতেই চলে তার সব কুকর্ম। ঈদুল আজহার দুই দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেটে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গাড়ি আটকিয়ে চাঁদা আদায় করে বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে।সূত্র আরও জানায়, ছুটির সময় এই চারজনসহ ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ চারটি মোটরসাইকেলে করে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়িয়েছে। নিরাপত্তা প্রহরীরা তাদের দেখেছেন বলে স্বীকার করেন। কিন্তু নাম প্রকাশ করতে তারা রাজি হননি। যে দিন তরুণীটি ধর্ষিত হন, ঠিক তার পরের দিন ১০ অক্টোবর শুক্রবার তিনটার সময় আসিফ ইকবাল, রাসেল খন্দকার, সোহেল ঈসরাফিল, শওকত আকবরসহ আরও কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনের কালভার্টের ওপর আশুলিয়া প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ ও তার ছোট বোনকে আটকিয়ে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। এ ঘটনা শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্র ও সাংবাদিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে 'ক্যাম্পাসের কিনা তা জানতে চেয়েছিলাম' দাবি করে পরে একপর্যায়ে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে ক্যাম্পাসের একজন শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী বলেন, 'প্রথমে বেশ কয়েকজন এই ধর্ষণের ঘটনার বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেছিলেন। তারা বিভিন্নজনকে ঘটনা জানিয়েছিলেন। ঘটনার দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের উপস্থিতিতে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে অবহিত করা হয় এবং বিষয়টি নিয়ে জাবি কর্মচারী সমিতির এক সভায় আলোচনাও হয় বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করে। 

নিরাপত্তারক্ষীসহ সাধারণ কর্মকর্তাদের কয়েকজন এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার কথা ভাবেন। এই প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে তখন দু'একটি সংবাদ মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনার কথা ছাপাও হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরবর্তীতে বিষয়টি এড়িয়ে গেলে প্রত্যক্ষদর্শীরাও পরে পিছিয়ে যান। এখন এই প্রত্যক্ষদর্শীরা সরাসরি দেখেছেন বলতে রাজি হচ্ছেন না। যিনি আগে দেখেছি বলেছেন, তিনিও এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রশাসনের আন্তরিকতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হলে আর মুখ খুলে এরা কেউ চাকরি হারাতে চাইবেন না।'

বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হওয়াটা এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৩ সালের ঈদুল আজহার ছুটির সময় ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা অপর এক বহিরাগত তরুণীকে শহীদ মিনার এলাকা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই তরুণীর সঙ্গে আসা যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের বিষয়টি জানালে ওই যুবকসহ নিরাপত্তারক্ষীরা দুই ঘণ্টা পুরো ক্যাম্পাসে খোঁজাখুঁজি করেও তরুণীটির হদিস পাননি। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাকর্মীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে স্বীকৃতি দিলেও তারা নিজেদের পরিচয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নন। প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা জেফরুল হাসান সজল নিজেও তখন ওই তরুণীকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

শুধু বহিরাগত নয়, এ বছর এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা এক ছাত্রীও ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ আছে। বাইরে থেকে এসে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে গিয়ে অপরিচিতরা চলে যান বোটানিক্যাল গার্ডেন বা সুইমিং পুলের দিকে। সেখানে আড্ডারত মাদকসেবীরা এদের ধরে নিয়ে যায় বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনের দিকে। সেখানে তারা নির্বিঘেœ যা খুশি তা-ই করে। তাদের হাত থেকে উদ্ধার পেয়েই ক্ষতিগ্রস্তরা এলাকা ত্যাগ করেন। কেউ জানেনি ভেবে তারাও বিষয়টি চেপে যান। ক্যাম্পাসের ভেতর এ নিয়ে আলাপ আলোচনা কিছু চললেও তথ্যপ্রমাণ না মেলার কারণে এর কোনো প্রতিকার হয় না। ক্যাম্পাসের মানসম্মানের কথা বলে বিষয়টি সবাই মিলে চাপা দিয়ে দেন। এবারের ঘটনায়ও প্রক্টরিয়াল বডির মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি উপরোল্লিখিত চারজনকে শোকজ করলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার মতো কোনো প্রমাণ না পেয়ে তাদের ছেড়ে দিয়েছে। একইভাবে এই এক বছরে ক্যাম্পাসের ছাত্র ও অছাত্ররা মিলে নারী নিপীড়নের যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে তার কোনো বিচার হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।

ক্যাম্পাসজুড়ে সন্ত্রাস
ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, প্রধান প্রবেশদ্বার ডেইরি গেট, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও সুইমিংপুল এলাকা, মীর মশাররফ হোসাইন হল গেট ইত্যাদি এলাকায় নিয়মিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। শুধু শিক্ষার্থীরা নন, শিক্ষকরাও ছিনতাইয়ের শিকার হন। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে এ সব ঘটনায় ক্যাম্পাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বজনরা যুক্ত থাকে। তারা ক্যাম্পাস সংলগ্ন স্থানীয় ইসলাম নগর, পানধুয়া এলাকায় গিয়েও সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়। ক্যাম্পাসের ভেতরে এসব উচ্ছৃঙ্খল ছাত্ররা সিনিয়রদের গায়ে হাত দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটায় হরদম।

গত ১৭ মে, ২০১৪ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনের পরিচালক কামাল হোসেনকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটায় ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল হোসেন দিপু। গত ৩ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে পরিসংখ্যান বিভাগের ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আমির হামজা রিয়াদকে রড দিয়ে বেধড়ক পেটায় বঙ্গবন্ধু হলের জুনিয়রদের ১০-১২ জনের একটি দল। সে সময় আহত রিয়াদকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এর কিছুদিন আগে ২১ জুন, পরিসংখ্যান বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী বিদ্যুৎ সরকার সনিকে এই রিয়াদ মারপিট করে বলে জানা যায়।

গত দুই মাসে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা বেড়াতে এসে জুনিয়রদের কাছে মার খেয়েছেন, অকথ্য ভাষায় গালি শুনেছেন বা অপরিচিতদের দ্বারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন, এমন ঘটনা এক ডজনেরও বেশি হবে বলে জানান মাস্টার্স শেষ করতে চলা পরিসংখ্যান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, 'প্রতিদিন এরকম ঘটনা ঘটে। সব তো কানে আসে না। কিছুদিন আগে মোটরসাইকেল মহড়া দেয়ার সময় এক সিনিয়র ভাইয়ের রিকশার সঙ্গে কিছু ছেলের ঝামেলা লেগে যায়। শামীম নামের ওই বড় ভাইকে তারা তখন বেধড়ক পেটায়। কেউ এসবের কোনো প্রতিবাদ করতেও যায় না। কারণ প্রতিবাদ করতে গেলে মার খেতে হবে। সেই মার খেয়েও পরে কিছু হবে না। তাই সবাই দেখেও না দেখার ভান করে চলছে।'

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাপক ছিনতাই-রাহাজানি। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্যদের তথা  কর্মচারীদের সন্তান বা ছোট ভাইদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র। যারা পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়েছে এবং অনেকেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সবাই কোনো না কোনো ছাত্রলীগ নেতার প্রশ্রয়ে আছে। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল ভেদ এক্ষেত্রে যেন একেবারে ঘুচে গেছে।

গত ৬ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে জাবি থিয়েটার (টিএসসি) আলবেয়ার কাম্যুর 'দ্য আউটসাইডার' নাটকের প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে উপস্থিত হয়ে ৪৩তম ব্যাচের কিছু ছাত্র নাটকের বিভিন্ন ডায়লগ ধরে কটূক্তি করতে থাকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, আয়োজকরা প্রদর্শনী বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তারা মাইকে ঘোষণা করেন যে, 'যারা পেছন থেকে কটূক্তি করছেন, তারা কিছু বলার থাকলে মাইকে এসে বলুন।' এই ঘোষণার পর ওই ছাত্ররা ধীরে ধীরে কেটে পড়ে। পরবর্তীতে অনুষ্ঠান শেষে প্রক্টর তপন কুমার সাহাকে জানানো হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের ৪২তম ব্যাচের এক ছাত্রী বলেন, 'এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি এই ক্যাম্পাসে দেখতে হবে, তা আমরা কেউ ভাবিনি। ক্যাম্পাসে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা তো নেই, উল্টো যা হয় তা বন্ধ করে দেয়ার আয়োজন আছে। দিওয়ালির অনুষ্ঠানে গেলে শিক্ষকরা ছাত্রীদের ডেকে বলেন, মুসলিম হয়ে দিওয়ালিতে যাও কেন? কোনো মেয়ে টিজের শিকার হলে তারা অভিযুক্তদের খোঁজার চেয়ে মেয়েদের খুঁত ধরতে বেশি আগ্রহী থাকেন। ক্যাম্পাসের আজকের এই পরিণতির পেছনে একশ্রেণীর শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান।

মাদক ক্যাম্পাসের সর্বত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র মাদকের জোগান। রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কক্ষগুলোতে হাতের নাগালেই পাওয়া যায় ইয়াবা, গাঁজা, মদ, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্য। কারা এসব বিক্রি ও বিতরণ করে, তা মোটামুটি ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য হলেও এর কোনো প্রতিকার নেই। দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত এসব মাদক ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে বিভিন্ন কাগজে খবর প্রকাশ হলেও প্রশাসন এদের ধরতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ক্যাম্পাসে সর্বাধিক জনপ্রিয় মাদক হচ্ছে ইয়াবা। সাভার এলাকার গেন্ডা, হেমায়েতপুর এবং ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী ইসলামনগর বাজার, কলমা, পানধুয়া, ওয়ালিয়া থেকে নির্দিষ্ট একটি চক্রের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ইয়াবা সরবরাহ হয়। গত ৯ জুন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বটতলা এলাকা থেকে দুই ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। আটককৃতরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সন্তান। তাদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহানারা ইমাম হলের ঝাড়ুদার রোকেয়া আক্তারের ছেলে মো. মহসিন (২০) এবং অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের মালি মো. আবুল হোসেনের ছেলে মো. আব্দুল হালিম (২৫)। এদের সঙ্গে আগে উল্লেখিত ৯ অক্টোবরের ঘটনায় জড়িত গ্রুপটির সম্পর্ক ছিল বলে জানা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্পটে শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রকাশ্যেই মাদক গ্রহণ করে থাকে। সুইমিংপুল এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে এই প্রতিবেদক সেখানে বেশ কজনকে গাঁজা সেবনরত অবস্থায় দেখতে পান। বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনের জংলা এলাকাতেও বিভিন্ন স্থানে খবরের কাগজ বিছিয়ে মাদকের আসর বসতে দেখা যায়। ওই এলাকায় যত্রতত্র মদ ও ফেনসিডিলের বোতল পড়ে আছে। সূত্র জানায়, সবচেয়ে বেশি মাদক সেবন চলে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল ও ভবনের ছাদে। হলগুলোতে নির্দিষ্ট রুমে রাত ১টার পর শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে গাঁজা ও মদ্যপান করে থাকে।

বাইরে প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর, প্রকৌশল অফিস, টারজান পয়েন্ট, নির্মাণাধীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল, নিরাপত্তা অফিসের বারান্দা, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, জাবি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠ এবং কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বারান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে। এসব স্থানে ছোট ছোট দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে আসর বসে। এছাড়া প্রতিনিয়তই মওলানা ভাসানী হলের দ্বিতীয় তলা, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের দ্বিতীয় তলা, শহীদ সালাম-বরকত হলের এ ব্লকের দ্বিতীয় ও 'বি' ব্লকের দ্বিতীয় তলা, আল বেরুনী হলের (বর্ধিতাংশ) একাদশ ব্লক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দ্বিতীয় তলা এবং মীর মশাররফ হলের বি ব্লকের দ্বিতীয় তলার নির্দিষ্ট কয়েকটি কক্ষে মাদকের আসর বসে। মেয়েদের হলগুলোতেও নির্দিষ্ট কিছু কক্ষে একই রকম ঘটনা ঘটে বলে কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের অনুমতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে গাঁজা সরবরাহ করে থাকেন আলী নামের একজন কর্মচারী। তিনি মেডিকেলের অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে ক্যাম্পাসে কর্মরত। মাদকসেবী শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি 'দাদু' নামে পরিচিত। দাদু কেমন আছেন বলে ফোন দিলেই তিনি বুঝে যান যে গাঁজা লাগবে। এছাড়া এসব কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পরিবহন কর্মচারী, হলের গার্ড এবং ঝাড়ুদারদেরও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকের চালান নিয়ে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে, যার সূত্র ধরে ঘটে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসের বঙ্গবন্ধু হলের একজন নিরাপত্তাকর্মী নাজিম মারা যান। বয়সে যুবক এই নাজিম ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল চালাতেন। তাকে দেখে হলের নিরাপত্তাকর্মী মনে হতো না। ইসলাম নগর বাজারে তার আড্ডা ছিল। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে ছিল তার দহরম মহরম। সূত্র জানায়, ক্যাম্পাসে মাদকের চালানসহ ছাত্রলীগের অস্ত্রশস্ত্র বহন করত এই নাজিম। তার মৃত্যুর পর বলা হয় যে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। ক্যাম্পাসের ভেতর উড়ো খবর আছে মদের আড্ডায় গিয়ে তার মৃত্যু হয়।

ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাওলাদার মুহিবুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্তদের পেছনে থেকে বড় ভাইয়ের ছায়া দেন বলে অভিযোগ আছে। ৩৮ ও ৩৯ ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী এসব তৎপরতার সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত। যদিও মাদকসেবীরা অধিকাংশই ক্যাম্পাসে নতুন, ৪১ ও ৪২ ব্যাচের।

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিবহন কর্মচারী বলেন, 'মাদক তো এই বয়সে পোলাপান খায়ই। আমাদের বলা আছে, ক্যাম্পাসে এত ছেলেপেলে থাকে। এরকম একটু আধটু গেঞ্জাম, মাদক খাওয়া হইবই। এগুলা নিয়া আমাদের কথা বলার বারণ আছে।' কে বারণ করেছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'এইটা প্রতি মাসেই একবার করে উপর মহল থেকে বলে দেয়া হয়।'

সবাই চুপ!
এত কিছু ঘটছে ক্যাম্পাসে, কিন্তু কেউ দেখছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্যায় ঠেকাবে কি, তারা অধিকাংশই নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণকালের দুর্নীতিবাজ প্রশাসন শরীফ এনামুল কবীরের পক্ষের প্যানেল থেকেই চলতি বছরের মার্চে দেশের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ড. ফারজানা ইসলাম। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ৪০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যার অধিকাংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় বলে অভিযোগ আছে। উপাচার্য থাকাকালে ড. শরিফের বিরুদ্ধে শূন্য পদের চেয়ে অধিক শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ ছিল। তার তিন বছরের মেয়াদকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ২০০ বিতর্কিত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

ড. শরিফের প্যানেলের ফারজানা ইসলামও সেই একই পথে হেঁটেছেন। সম্প্রতি জৈব রসায়ন এবং আণবিক জীববিজ্ঞান বিভাগে চারটি শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিলেও সেখানে ছয়জনকে নিয়োগ দিয়েছে তার প্রশাসন। এর মধ্যে তিনজনই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আত্মীয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ওই বিভাগে ২২টি পদের বিপরীতে এমনিতেই ২৩ জন শিক্ষক ছিল। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন, ড. শরিফের ভাতিজা এবং সহকারী প্রক্টর সেলিনা আক্তারের স্বামী কাজী রাসেল উদ্দিন, সহকারী প্রক্টর মাহমুদুল হাসানের স্ত্রী আফরোজা পারভীন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মান্নানের ভাতিজা মোজাম্মেল হোসাইন। বাকি তিনজন সুব্রত বণিক, মো. মাহফুজ আলী খান এবং ড. মোহাম্মদ মোরশেদকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনা হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলে যে, 'সবকিছু বিবেচনা করে বোর্ড সঠিক প্রার্থীদেরকেই নিয়োগ দিয়েছে।'

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। তাদের বিরোধী অংশগুলো এই নিয়ে সোচ্চার হলেও ক্যাম্পাসের অন্যান্য সমস্যা নিয়ে তারাও এ পর্যন্ত খুব কমই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এসবের মধ্যেই শিক্ষকদের একাংশ গত ২৯ অক্টোবর গণনিয়োগ, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিহিংসামূলক আচরণ এবং প্রশাসনিক আধিপত্য দিয়ে শিক্ষকের চাকরিচ্যুতিসহ নানা বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ক্যাম্পাসে শরীফ এনামুলের সময়কার খারাপ অবস্থা আবারও ফিরে আসছে। তারা ৯ অক্টোবরের ধর্ষণের ঘটনার তদন্তও দাবি করেন। এর বাইরে পুরো ক্যাম্পাসে ভয়ানক ওই ঘটনা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। এ ধরনের ঘটনার প্রেক্ষিতে কী উদ্যোগ নিয়েছেন? প্রশ্ন করা হলে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি তন্ময় ধর বলেন, 'ধর্ষণের ঘটনায় সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাইনি বিধায় এটা নিয়ে আমরা কিছু বলতে পারিনি। সামগ্রিকভাবে এ মুহূর্তে হয়তো আমাদের দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি নেই। কিন্তু আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচার চালাচ্ছি। বিষয়গুলো নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। প্রশাসন এবং সরকারি দলের যে মেলবন্ধন, তার ফলেই এসব ঘটনার প্রতিবাদ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।'

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি শাফায়েত পারভেজ বলেন, 'আমরা ছাত্রদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জানতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করেছে। সেই কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।' বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি বলে এমন ঘটনা ঘটেনি, তাহলে কী করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা তখন নিজেরা অনুসন্ধান করব। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে পরামর্শ করে তখন সিদ্ধান্ত নেব। ইস্যু তো এই একটি না। এরকম আরও অনেক বিষয় আছে। সব নিয়েই আমাদের ভাবতে হয়।'

ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কণ্ঠ যেন এক্ষেত্রে প্রশাসনের কণ্ঠেরই প্রতিধ্বনি। প্রক্টর তপন কুমার সাহাকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমরা ৯ অক্টোবরের ঘটনার তদন্ত করছি। দ্রুতই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। রেজিস্ট্রার আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি আপনাদের জানাবেন। মাদকসহ ক্যাম্পাসের অন্য বিষয়াদি নিয়ে আমরা তৎপর রয়েছি। প্রোভিসি স্যারের নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আমি আশাবাদী।'প্রোভিসি আবুল হোসেনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমাদের কাজ চলছে। আপনি একদিন আমার অফিসে আসুন। তখন মুখোমুখি বসে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে।'

প্রগতিশীল ক্যাম্পাস হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সুনাম রয়েছে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ক্যাম্পাস এটি। ক্যাম্পাসের ভেতরের পরিবেশও অসাধারণ। এটি সেই ক্যাম্পাস, যেখানে পাখিদের জন্য গান হয়। অথচ এখানে বেড়াতে এসেই যদি কোনো নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়, তাহলে ক্যাম্পাসের আর কী থাকল! সবাই মান সম্মান বাঁচাতে এসব ঘটনা এড়িয়ে যান। কিস্তু এর ফলে অপরাধীর হাত আরও লম্বা হয়। ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতির যে ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে, তা একেবারে স্পষ্ট। সাংস্কৃতিক অবস্থারও ব্যাপক অবনমন ঘটেছে। কিন্তু সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ছাত্র সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, কোনো পক্ষকেই এ নিয়ে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। তাহলে কি সব শেষ হয়ে গেলে তারপর নড়েচড়ে বসবেন সংশ্লিষ্টরা? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু পাখিদের নয়, মানুষের জন্যও নিরাপদ করতে হবে। অমানুষদের থাবা থেকে ক্যাম্পাসটিকে রক্ষা করতে হবে। সেজন্য সংশ্লিষ্টদের টনক নড়াটা জরুরি!


সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেনি, বরং উন্নতি হচ্ছে'
ড. ফারজানা ইসলাম

উপাচার্য, জাবি

সাপ্তাহিক : ক্যাম্পাসে ৯ অক্টোবর একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার অভিযোগ এসেছে। আপনারা কী ভূমিকা নিয়েছেন?
ড. ফারজানা : এই ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। এ ধরনের ঘটনার তো সাধারণত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে প্রক্টরকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্ত কমিটি জানাবে। তবে আমি যদ্দূর জেনেছি, এর সত্যতা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সাপ্তাহিক : ক্যাম্পাসে ব্যাপকভাবে মাদকের বিস্তার ঘটেছে?
ড. ফারজানা : মাদক, ছিনতাই বেশ ভালোই হচ্ছে। আমি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রোভিসিকে প্রধান করে একটি পরিদর্শক দল করা হয়েছে। আমরা অ্যালার্ট হয়েছি। যারাই ধরা পড়বে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে, তাদের পুলিশে দেয়া হবে। 
সাপ্তাহিক : সার্বিকভাবে ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে। এর জন্য কী পদক্ষেপ নিবেন?
ড. ফারজানা : সাংস্কৃতিক অবনমন হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। বরং উন্নতি হচ্ছে। আগে ক্যাম্পাসে যা খুশি তা-ই চলত। এখন আমরা একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। সেটা হচ্ছে, কিছু ঘটলেই তদন্ত, তার পরে সে অনুযায়ী প্রতিকারের বিধান দেয়া। এটাই আমাদের সবার সংস্কৃতি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কারও সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য দেয়াটা তো ঠিক না। সেটাই বরং সাংস্কৃতিক অবনমন। 

http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=9685

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors