'এসে দেখি আমি ধর্মতলার চারকোণে চারদল....?'
১৯৫৬ এর ৬ই ডিসেম্বর। বাবাসাহেব আম্বেদকর এর মৃত্যুদিন। ১৯৯২ সালের ঠিক ঐ দিনটাকেই বেছে নিয়েছিলো সংঘ-এর লোকরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করতে। বুঝিয়ে দিয়েছিলো— শুধু মুসলিমরা নয়, অন্য কোনো সংখ্যালঘুরাও নয়, মৌলবাদের প্রধাণ টার্গেট তাদের 'নিজেদের' ধর্মের লোকরা। নীচু জাতেরদের মুক্তি যে তথাকথিত 'বর্ণ হিন্দু' সম্প্রদায়ের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর দাঁড়িয়ে হবে না, দলিতদের মুক্তির জন্য যে তাদের বেড়িয়ে যেতে হবে হিন্দুধর্মের আচার-আচরণ থেকে— একথা নিয়ে সবচেয়ে লড়েছিলেন যে আম্বেদকর, তার মৃত্যুদিন টাকে সম্ভবত বুঝেশুনেই বেছেছিলেন উচ্চবর্ণ-হিন্দুদের সংগঠন আর.এস.এস এর নেতারা। আর তারপর থেকে আরও জোরদার হয়েছে দলিতদের 'হিন্দু' বানানোর প্রক্রিয়া। 'আদিবাসী'দের আদর করে ডাকা হয়েছে 'বনবাসী' বলে। এই ভূখন্ডে দীর্ঘদিন ধরে যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ঐতিহ্য প্রবহমান, তাকে দলে-পিষে মেরে সকলকে 'ওদের পছন্দমাফিক হিন্দু' করতে চায় সংঘ। যেমন ইরাক আর সিরিয়াতে নিজেদের 'পছন্দমাফিক মুসলিম' বানাতে চায় আই.এস.আই.এস সকলকে, যেমন মিজোরামের কিছু জায়গায় 'ক্রিশ্চান' না'হলে দলিতকে শাস্তি দেয় 'ফাদার'রা...
মন্দির-মসজিদ-গীর্জা দিয়ে নিরন্ন পেটের মানচিত্রকে ভুলিয়ে দেবার সংগঠিত রাজনীতি বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ভারতবর্ষে তার এক অন্যতম 'সাহসী পদক্ষেপ' নিয়েছিল ১৯৯২ এর ৬ই ডিসেম্বর। কিন্তু তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তাই ৬ই ডিসেম্বরের আজকের প্রাসঙ্গিকতা শুধু ওখানে মসজিদের আগে মন্দির ছিলো কিনা, মন্দিরের আগে কী ছিলো, 'শ্রীরামচন্দ্র' বলে আদও কোনো মানুষ বাস্তবে অযোধ্যা কেন, অন্য কোথাও-ও জন্মেছিলেন কিনা— নাকি ওটার কবি বাল্মীকির কল্পনা এসব ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে আজকের বিতর্ক। মানুষে মানুষে দাঙ্গা আর হানাহানি খারাপ, হিন্দু-মুসলিম-ক্রিশ্চান সকলের রক্তের রঙ-ই লাল— আর তাই আসুন আমরা সকলে মিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখি এটা চিত্কার বলাটা খুব জরুরী, কিন্তু ওটুকুতে থেমে গেলে সমস্যা হবে। 'ধর্মনিরপেক্ষতা' ভাঙিয়ে করে খেতে চাওয়া লোকের অভাব নেই সেটা একটা সত্যি কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল আজকের ভারতে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রমোট করছে করা আর এর বিরুদ্ধে লড়াই এর মানেটাই বা কী?
আমাদের দেশে আজকের দিনে সাম্প্রদায়িকতাকে পুরোপুরি মদত করছে, ব্যবহার করছে কর্পোরেটরা শক্তিরা। না, ওপর থেকে দেখলে তাদের স্বার্থের সাথে সম্পর্ক নেই ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতা এসবের। তারা শুধু চায় দেশের মানুষ কমপয়সায় খাটুক উদয়াস্ত, দেশের সরকার জমি-জল-জঙ্গল-নদী-পাহাড় সব তুলে দিক ওদের হাতে বিনা পয়সায়। কিন্তু মানুষ জীবটাই যে গোঁয়ার— সে দু'বেলা খেতে চায়, মাথায় ছাদ চায়, এমনকি মাঝে মাঝে সম্মান নিয়ে 'মানুষের মতো' করে বাঁচতে চায়! তাই সে জোট বাঁধে, আওয়াজ তোলে 'হেঁই সামালো'! আর এটাকে খুব ভয় পায় সুন্দর স্যুট-টাই-ক্লীনশেভ কর্পোরেটরা! মানুষগুলো তাই নিজেদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে মারপিট করলে ওদের পোয়া বারো! কেউ কিছু বললেই ব্যাটাকে 'পাকিস্তানের দালাল' বলে ভরে দেওয়া যাবে!
তাই ওরা আর.এস.এস-কে বেছেছে, তাই ওরা মোদীকে এনেছে এবারে। কারণ বিশ্বব্যাপী সংকটের পর ওদের হাল বেশ খারাপ। তাই ওদের আরো মুনাফা চাই, আরও তাড়াতাড়ি মুনাফা চাই। না'হলে কংগ্রেস-সিপিএম-লালু-মুলায়ম-মায়া-মমতা-জয়ললিতা-করুনানিধিরা ভালই দালালি করছিলো ওদের। 'দালালি' করা নিয়ে প্রতিযোগিতাটাও বেশ জমে উঠেছিলো— এদিকে বুদ্ধবাবু মালকোঁচা মেরে 'লালঝান্ডা' বগলে নিয়ে পুঁজির মালিকদের কাছে গিয়ে গলায় বকলসের দাগটা দেখিয়ে আসেন তো ওদিকে রাহুলবাবা গালে টোল পড়া হাসি নিয়ে মালিকদের পা-ধরতে ছোটেন। তবু, মালিকদের কৃপা পাওয়া গেল না, মিডিয়ারা গালমন্দ বাড়িয়ে দিলো, অবশেষে ভোটে হারতে হল!
এদিকে 'বিপ্লব' করা ছাড়া সিপিএম এর কাছে এখন বাঁচার আর অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই! ৩৪ বছর ধরে দালালি করার পড়েও মালিকরা লাথি মেরেছে। বেচারা 'বোকা' জনগণ বুঝতেই পারেনি 'সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় কেন্দ্রের প্রচন্ড বঞ্চনা'র মাঝেও কী কষ্ট করে সিপিএম পার্টি পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সেবা করে চলেছিলো অক্লান্তভাবে! প্রমোটাররা বুঝে গেছে সিপিএম পার্টিকে আর টাকা দিয়ে লাভ নেই। ভাড়াটে গুন্ডারা বুঝেছে সিপিএম গাঁয়েগঞ্জে নিজের ক্যাডারদেরই সুরক্ষা দিতে পারছে না, গুন্ডাদের কী শেল্টার দেবে? সিপিএম তাই এখন প্রকৃত অর্থে 'সর্বহারা', হারানোর মতো কিছু নেই আর— জয় করার আছে গোটা বিশ্বব্রম্ভান্ড! অতঃপর 'বিপ্লব করা'র জন্য সঙ্গে নিতে হবে 'ছোটখাটো' বন্ধুদের। একটু বেশি 'প্রজেকশন' দিয়ে দিতে হবে তাদের লিডারদের। লক্ষ্যটা কিন্তু পরিষ্কার, মালিকদের ভরসা পুনরুদ্ধার করা, যাতে আবার দালালি করা যায়— এবার অবিশ্যি আনলে, মালিকরা আরও ভালো করে 'টাইট' দিয়ে তারপরে আনবে, যাতে বেশি 'বামপন্থা' কপচানো না যায়!
এবার কতগুলো কথা সোজা করে বলে ফেলি। ৬ই ডিসেম্বরে এতগুলো কর্মসূচী কেন? সকলে এক হলে হয় না? না, হয় না। হলে, সবসময় ভালো-ও হয় না। এই যে ১৬ পার্টির পক্ষ থেকে যে মিছিল ডাকা হয়েছে 'সাম্প্রদায়িকতার/ফ্যাসিবাদ-এর বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই' করার জন্য সেটার ভবিতব্য ঠিক কী? ভারতে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে রয়েছে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থের সাথে, নিও-লিবারালিজমের সাথে। এই প্রশ্নে 'প্রাচীনপন্থী আর.এস.এস' আর কর্পোরেট পুঁজির প্রতিনিধি 'মডার্ন মোদী' আর মুকেশ আম্বানীদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রাম তাই করতে হবে সক্কলে মিলে, নিও-লিবারালিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলে! যে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে (এবং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে) নিও-লিবারালিজমকে লাগু করলো, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে রক্ত ঝরালো পুঁজির অঙ্গুলিহেলনে, তাকে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতে যদি পারা যায়— তবে কংগ্রেসকে নিয়েই বা করা যাবে না কেন? আরও বৃহৎ ঐক্য, আরও স-অ-অ--ক-ক-ক্কলে মিলে! হ্যাঁ, ঐ ১৬ পার্টির মধ্যে বহু দল আছে, যেসব দলে এরকম বহু মানুষ আছে, যারা সত্যি-সত্যি লড়তে চান, যারা সত্ভাবে সমাজটার ভালো করতে চান, এই সমাজটাকে বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে আজ-ও যারা বাঁচেন কিংবা প্রাণ দেন লড়াই-এর ময়দানে। পার্টিগুলোর লীডারদের ভোটের-জোটের অঙ্ক কষার আগে ঐ মুখগুলো মনে পড়ে তো?
No comments:
Post a Comment