Tarun Kanti Thakur | 10:14am Dec 9 |
"একেই কি বলে ব্রাহ্মণ্যবাদ ???"
তরুণকান্তি ঠাকুর
-------------------------
বিচ্ বাজার মে খাড়ে হোকর চিল্লা-চিল্লাকে বেঁচো তো মিট্টি ভি বিক জাতা হ্যায়, ওরনা সোনা ভি নহি বিকতা ।
কারন প্রচারের গুনে অচল মালও বিক্রি হয়ে যায়, আর অ-প্রচারে ভালো জিনিসও বিক্রি হয় না ।
বর্তমান প্রচারের যুগ, প্রচারের জোরে চোর, গুণ্ডা, বদমাইশ, বলাৎকারী, খুনি ভগবান হয়ে বশে থাকে আর অ-প্রচারে সজ্জন, বিদ্বান ,জ্ঞানীগুনী ব্যাক্তিও তাঁর যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হন।আর এর জলন্ত উদাহরণ বর্তমান ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বাতাবরণ।যেমন, আশারাম বাপু, স্বামী নিত্যানন্দ, ভিমানন্দ ,রামপাল ,স্বামী সদাচারী, শংকরাচার্য জৈনেন্দ্র সরস্বতী, চন্দ্রস্বমী ,সাঁই বাবা ইত্যাদি ভগবানে পরিণত হয়, অপর দিকে গুরুচাঁদ ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, রাষ্ট্রপিতা জ্যোতিরাও ফুলের, সাবিত্রীবাঈ ফুলে, সন্ত তুকারাম ,সন্ত রবিদাস , শাহু মহারাজ, , বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকর এর মত অসংখ্য মুলনিবাসী মনিষী, মহামানব অ-প্রচারে ও কুপ্রচারে তাঁদের যোগ্য সম্মান পান না । তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও প্রচার মাধ্যম চিরকাল মুলনিবাসী তথাকথিত শূদ্র মনিষী ও মহাপুরুষদের প্রচারের আলো থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে।চিরকাল অন্ধকারে রেখেছে, রাখার চেষ্টা করে চলছে ।কারন তাঁরা ব্রাহ্মণ্যদের বিরোধীতা করেছেন, সমাজকে বৈশম্যময় ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে মুক্ত করে সমানতা, বন্ধুতা ও ন্যায়ের সমাজ গঠনের আন্দোলন করেছেন।আমরা একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখতে পাব বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ ঘোষিত যত গুলি মনিষী ও সমাজসংস্কারকের নাম জানি এবং ইতিহাসের পাঠ্য ক্রমের মধ্যে দিয়ে নুতন নুতন প্রজন্মকে জানানো এবং শেখানো হয় তাঁরা সবাই হয় ব্রাহ্মণ সন্তান নতুবা ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক , প্রচারক ও সমর্থক।
বাংলায় এমন একজনও ব্রাহ্মণ এবং তৎসম জাতির মনিষী বা সমাজ সংস্কারকের নাম মনে পড়ে না, যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের উর্ধে উঠে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের উন্নতি ও মঙ্গল সাধনের কথা ভেবে কাজ করেছেন।ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচার মাধ্যম কিভাবে মিথ্যা গল্প ফেঁদে একজন মানুষকে মহান তৈরী করতে পারে তা আজ এখানে দেখার চেষ্টা কোরব।এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমি কাউকে হেঁয় বা ছোট করতে চাইনা।আমার উদ্দেশ্য তা নয়।আমি ব্রাহ্মণ্যবাদ কি ভাবে কাজ করে সেটা দেখানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু যেটা সত্য তাকে অস্বীকারও করতে পারছিনা।যদি এই লেখা পড়ে কারো মনে ব্যথা লাগে তার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।
আজ এখানে আমরা ব্রাহ্মণ প্রদত্ত উপাধি "বিদ্যাসাগর " শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং গুরুচাঁদ ঠাকুর এর তুলনা মূলক সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষা প্রসারের আলোচনা করব।
গুরুচাঁদ ঠাকুর :-1846 সালের 13 ই মার্চ অখন্ড বাংলার ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ বলতে বৎরের 6/7 মাস জলের তলায় ডুবে থাকে, ডোবা ও জল কাঁদায় পরিপূর্ণ থাকে।সম্পূর্ণ বাংলায় কোথাও নিম্নবর্ণের শূদ্র পতিতদের জন্য কোন স্কুল বা পাঠশালা ছিল না । তাই গুরুচাঁদ ঠাকুর কে প্রথমে দশরথ বিশ্বাসের বাড়িতে, তার পর মল্লকাঁদী গ্রামে গোলক কীর্তনীয়ার বাড়িতে থেকে বাংলা ভাষায় পড়াশুনা করেন এবং পরে বর্ণহিন্দুদের স্কুলে স্থান না হওয়ায় মুসলমানের মক্তবে ফার্সি ভাষায় পড়াশুনা করেন।
এই রকম জল কাঁদায় ঢুবে থাকা এলাকার অশিক্ষিত, বর্বর, পতিত মানুষের জন্য সর্বপ্রথম গুরুচাঁদ ঠাকুর অনুভব করেছিলেন যে, এ জাতির মুক্তির এক মাত্র পথ শিক্ষা।শিক্ষা বিনা এদেশের বৃহত্তর শূদ্র অতিশূদ্র ও মুসলমানদের জীবনে আন্ধকার রাতের শেষ হবে না।তাই তিনি 1880 সালে নিজ গৃহ ওড়াকান্দীতে সর্ব প্রথম সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করলেন।শুরু হল শিক্ষার আন্দোলন।পরের বৎসর খুলনা জেলার দত্তডাঙ্গায় নমঃশূদ্র সম্মেলনে শিক্ষার আন্দোলনের ডাক দিলেন।
"দত্তডাঙ্গা সভা মধ্যে গুরুচাঁদ কয়।
শিক্ষা বিনা এ জাতির নাহিক উপায়।।
সেই বানী সবে মানি নিল দেশে দেশে।
পাঠশালা করে সবে পরম উল্লাসে।"
গুরুচাঁদ ঠাকুর 1880 সাল থেকে 1937 সাল পর্যন্ত নিজ হাতে 1812 টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।তিনি বাংলার সকল অশিক্ষিত, বর্বর পতিত জাতির উদ্দেশ্যে বার বার বলতেন--
"বাঁচি কিবা মরি তাতে দুঃখ নাই।
গ্রামে গ্রামে পাঠশালা গড়ে যেতে চাই ।
খাও বা না খাও তাতে দুঃখ নাই ৷
ছেলে মেয়ে শিক্ষা দাও এই আমি চাই ।"
তিনি আরো বলতেন --
"বিদ্যাধর্ম ,বিদ্যাকর্ম ,বিদ্যা সর্বসার ।
বিদ্যা বিনা এ জাতির নাহিক উদ্ধার।"
"ছেলে মেয়ে দিতে শিক্ষা।
প্রয়োজনে কর ভিক্ষা।।"
"শিক্ষাহীন হলে জাতি কোন আশা নাই,
ঘরে ঘরে স্কুল কর মিলিয়া সবাই।
ছেলে মেয়ে উভয়েরে দিতে হবে শিক্ষা।
শক্তি না থাকিলে কর দশদ্বারে ভিক্ষা।"
সমগ্র বাংলার নমঃজাতি তথা অন্যান্য নিম্নবর্ণের( শূদ্র অতিশূদ্র) মানুষদের অজ্ঞান ও অশিক্ষার অন্ধকার কুপ থেকে মুক্তি দেবার জন্য সমগ্র বাংলায় একমাত্র পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর মুক্তির বারিধি হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন।তাঁর আগে বর্ণ বৈশম্যময় হিন্দু ধর্মের কোন মহান ব্যক্তি, সমাজ দরদী, সমাজ সংস্করক তথা তেত্রিশ কোটি দেবী দেবতা ও দুই ডজন অবতার তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তির কথা বলেন নাই, ভাবেন নাই।পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন মহান ব্যক্তি আমি খুঁজে পাই না যিনি সারাজীবন ধরে সমস্ত শ্রেনীর মানুষের কল্যাণে 100 (একশত) স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন।কিন্তু পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজ হাতে 1812 (আঠারো শত বার ) টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় যদি শুধু মাত্র উচ্চ বর্ণের ছেলে মেয়েদের জন্য শহর কেন্দ্রীক 39 (ঊনচল্লিশ) টি ,মতান্তরে 29 টি বিদ্যালয় স্থাপন করে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত হতে পারেন তাহলে জিনি 1812 টি বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন সেই পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর এর নামের সঙ্গে বিদ্যার মহাসাগর উপাধিও অতি তুচ্ছ মনে হবে।সূর্যকে মোমবাতি দেখানোর মত বিষয় হবে।
1858 সালে ব্রিটিশ সরকার দলিত পতিতদের জন্য শিক্ষার কথা বললে এ প্রসঙ্গে দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর 1859 সালে বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর কে এক আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন' - - "আমার সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় শিক্ষা বিস্তারের সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা হল - - - কেবল মাত্র উচ্চ বর্ণের ভিতর ব্যপক ভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।" ( পঞ্চরত্ন ক্যুইজ সমগ্র,হরি গুরুচাঁদ প্রকাশনী)
কিন্তু আমাদের তথা মুলনিবাসী ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও প্রচার মাধ্যমের হীনমন্যতা ও সতেলাপনার কারনে সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ সমাজ দরদী, সমাজ সংস্কারক শিক্ষার আন্দোলনের জলন্ত সূর্য পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেলেন না।কারন তিনি নমঃজাতির ঘরে জন্ম গ্রহন করেছেন।
শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় :- 26 সেপ্টেম্বর 1820 সালে বীরভূম জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।ছোট বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন।ব্রাহ্মণ সন্তান বলে বিদ্যা শিক্ষার জন্য কখনো কোন পাঠশালা বা বিদ্যালয়ে প্রবেশ পেতে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় নি।দারিদ্রতা শিক্ষা লাভের পথে বাঁধা সৃষ্টি করলেও সেটা বিরাট কোন বিষয় বলে মনে করি না।ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এর সমাজ সংস্কারমূলক কাজ গুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, এতে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না । তিনি অবশ্যই বাঙালী তথা ভারতবাসীর কাছে প্রনম্য ।কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও প্রচার মাধ্যম একজন মানুষকে কি ভাবে মহান থেকে মহানতর করে তুলতে পারে তার প্রমাণ শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ( বিদ্যাসাগর )।আমরা সকলেই স্কুল জীবনে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে অনেক গল্প কাহিনী পড়েছি ।পড়ে একজন বাঙালী হিসেবে গর্বে বুক ভরে গেছে।কিন্তু সেগুলো কতটা সত্য বা মিথ্যা তা আজ বুঝতে পারছি।
দু-তিন টি কাহিনী এখানে উল্লেখ করব পাঠকগন বিচার করবেন ব্রাহ্মণ্যবাদ কাকে বলে ?
প্রথমে বলি,
"মাতৃ ভক্ত বিদ্যাসাগর "
একবার বিদ্যাসাগরের মাতৃদেবী ছেলে (বিদ্যাসাগর) কে দেখতে চান তাই কলিকাতায় খবর পাঠালেন।খবর পেয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় মায়ের ইচ্ছা পুরন করতে কলিকাতা থেকে গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিলেন।পথে যেতে যেতে রাত হয়ে যায় এবং গ্রীষ্মকাল হওয়াতে বিকেল বেলা ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়।তবু তিনি থামলেন না, মায়ের আদেশ পালন করতে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে চললেন।পথে আবার এক বাঁধা দেখা দিল, খরস্রোতা দামোদর নদ।তার উপরে ঝড় ও বৃষ্টির কারণে আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।এতেও তিনি ভয় পেয়ে থামলেন না।সেই উত্তাল দামোদর তিনি সাঁতরে পার হয়ে গেলেন এবং সেই রাতেই মায়ের সঙ্গে দেখা করলেন।এ পর্যন্ত আমরা দেখলাম যে বিদ্যাসাগরের মাতৃ ভক্তির তুলনা হয় না।
কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য যায়গায়,
" আনন্দবাজার পত্রিকায় একবার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ভ্রাতা শম্ভুচরন বন্দোপাধ্যায়ের লেখার একটি উদৃতি দেখেছিলাম ,সেখানে তিনি লিখেছেন যে, তাঁহার দাদা ঈশ্বরচন্দ্র সাঁতারই জানিতেন না, সুতরাং তাঁহার পক্ষে উত্তাল দামোদর সাঁতরাইয়া পর হইবার প্রশ্নই ওঠে না।"
(সংগ্রহ; -গুরুচাঁদের প্রত্যক্ষ শিক্ষা ।---মনীন্দ্রনাথ বিশ্বাস । পৃষ্ঠা নং 6 )।।
দ্বিতীয় কাহিনীতে শেখানো হয় যে, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় কলিকাতায় থাকিয়া এতই অভাব অনটনের মধ্যে লেখাপড়া শিখেছেন যে রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়ার জন্য প্রদীপের তেল বা কেরোসিন কিনবার মত পয়সা ছিল না, তাই তিনি রাতে কলিকাতার রাস্তার গ্যাসের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে পড়াশুনা করতেন।এখানে পড়াশুনার প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অদম্য ইচ্ছা শক্তির পরিচয় সমাজ ও নুতন নুতন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচার মাধ্যম।
কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করেছে কলিকাতা মিউনিসিপাল্টির তৎকালীন রেকর্ড।তৎকালীন মিউনিসিপাল্টির রেকর্ড পরিক্ষা করে দেখা গেছে যে শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় যখন পড়াশুনা করতেন তখন কলিকাতার রাস্তায় ল্যাম্পপোষ্ট বা গ্যাসের আলো লাগানোই হয়নি।
আর একটা বিষয় বলে লেখাটা শেষ করব, বিষয়টি হল, বিদ্যাসাগরের আত্মসম্মান বোধ বা আমরা বলতে পারি অপমানের বদলা।যেমন কুকুর তেমন মুগুর।
অনেক লোকে প্রায়ই বলে থাকেন, "অশি অপেক্ষা মসির ধার অনেক বেশি তীক্ষ্ণ এবং ধাঁরাল ।"
অর্থাৎ কলমের জোরে একটা বিষয়কে ভালো থেক মন্দ, আবার মন্দ থেকে ভালো তৈরী করা যায়।কাউকে মহান তৈরী করতে তাঁর তুচ্ছ কাজকেও মহান কাজে পরিণত করা যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এর বেলাতেও তাই হয়েছে বলে আমি মনে করি।ঈশ্বরচন্দ্রের এই ঘটনাটা পড়লে বিষয়টা আপনাদের সামনে পরিষ্কার হবে।
কোন এক দরকারে একবার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় জনৈক ইংরেজ অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে তার অফিসে যান।গিয়ে দেখলেন সেই ইংরেজ অফিসার জুতা পায়ে টেবিলের উপরে পা তুলে বসে আছেন।ইংরেজ অফিসার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় কে দেখে পা দুটো টেবিলের উপর থেকে নামালেন না, এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তা করলেন না।সুতরাং ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় অত্যন্ত আপমানিত হলেন।শুধু তিনি কেন? যে কোন সাধারণ মানুষও অপমানিত হবেন ,হবারও কথা।
জনৈক ইংরেজ টেবিলের উপর থেকে পা দুটো না নামিয়ে অত্যন্ত জঘন্য কাজ করেছেন।তার জন্য তাকে বারংবার ধিক্কার জানাই।
কিন্তু ঘটনা ক্রমে কোন একদিন সেই ইংরেজ অফিসার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলে শ্রী বন্দোপাধ্যায় সেই ইংরেজ অফিসারের মত করে অপমানের প্রতিশোধ নিলেন।
অর্থাৎ ইংরেজ অফিসারকে ভিতরে ঢুকতে দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় নিজের চটি জুতা পায়ে দিয়ে ইংরেজের সামনেই টেবিলের উপর পাঁদুটো তুলে দিলেন।ফল স্বরূপ সেই ইংরেজ অফিসার ভিষন আপমানিত হলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় অপমানের বদলা নিতে পেরে অসীম শান্তি পেলেন।
কিন্তু আপনারাই বলুন, এটা কি কোন পন্ডিত ব্যাক্তির ভদ্রলোকের মত কাজ হয়েছে ?
সেদিন যদি ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় জনৈক ইংরেজ অফিসারকে নিজের অফিসে ঢুকতে দেখে চটি জুতা পায়ে দিয়ে টেবিলের উপরে তুলে না দিয়ে নিজে উঠে গিয়ে ইংরেজের জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে বলতেন, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেদিন সেই ইংরেজ অফিসার তার কৃতকর্মের জন্য আরো বেশী অপমানিত হতেন, লজ্জা পেতেন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি এই কাজটি করতেন তাহলে সেদিন এক বিদেশীর কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির মাথা উচু হত।ভারতীয় সভ্যতার পরিচয় আরো একবার বিদেশী ইংরেজ দেখতে পারত।
কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় তা না করে ইটের বদলে পাটকেল, খুনের বদলা খুন, আর অপমানের বদলে অপমান করে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাথা হেট করলেন।
এখানে সত্যেনদ্রনাথ দত্তের কবিতা মনে পড়ে গেল,
" উত্তম ও অধম"
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়,
কাপড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তায়।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে বলে ভৎসনা ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
"তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নাই দাঁত !"
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
"তুইরে হাঁসালি মোরে।
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়
দংশিব কেমন করে !
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তাই ব'লে কুকুরে কামড়ানো কি'রে
মানুষের শোভা পায় ?"
tarunkantithakur@gmail.com, 08855805900.
-------------------------
বিচ্ বাজার মে খাড়ে হোকর চিল্লা-চিল্লাকে বেঁচো তো মিট্টি ভি বিক জাতা হ্যায়, ওরনা সোনা ভি নহি বিকতা ।
কারন প্রচারের গুনে অচল মালও বিক্রি হয়ে যায়, আর অ-প্রচারে ভালো জিনিসও বিক্রি হয় না ।
বর্তমান প্রচারের যুগ, প্রচারের জোরে চোর, গুণ্ডা, বদমাইশ, বলাৎকারী, খুনি ভগবান হয়ে বশে থাকে আর অ-প্রচারে সজ্জন, বিদ্বান ,জ্ঞানীগুনী ব্যাক্তিও তাঁর যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হন।আর এর জলন্ত উদাহরণ বর্তমান ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বাতাবরণ।যেমন, আশারাম বাপু, স্বামী নিত্যানন্দ, ভিমানন্দ ,রামপাল ,স্বামী সদাচারী, শংকরাচার্য জৈনেন্দ্র সরস্বতী, চন্দ্রস্বমী ,সাঁই বাবা ইত্যাদি ভগবানে পরিণত হয়, অপর দিকে গুরুচাঁদ ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, রাষ্ট্রপিতা জ্যোতিরাও ফুলের, সাবিত্রীবাঈ ফুলে, সন্ত তুকারাম ,সন্ত রবিদাস , শাহু মহারাজ, , বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকর এর মত অসংখ্য মুলনিবাসী মনিষী, মহামানব অ-প্রচারে ও কুপ্রচারে তাঁদের যোগ্য সম্মান পান না । তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও প্রচার মাধ্যম চিরকাল মুলনিবাসী তথাকথিত শূদ্র মনিষী ও মহাপুরুষদের প্রচারের আলো থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে।চিরকাল অন্ধকারে রেখেছে, রাখার চেষ্টা করে চলছে ।কারন তাঁরা ব্রাহ্মণ্যদের বিরোধীতা করেছেন, সমাজকে বৈশম্যময় ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে মুক্ত করে সমানতা, বন্ধুতা ও ন্যায়ের সমাজ গঠনের আন্দোলন করেছেন।আমরা একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখতে পাব বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ ঘোষিত যত গুলি মনিষী ও সমাজসংস্কারকের নাম জানি এবং ইতিহাসের পাঠ্য ক্রমের মধ্যে দিয়ে নুতন নুতন প্রজন্মকে জানানো এবং শেখানো হয় তাঁরা সবাই হয় ব্রাহ্মণ সন্তান নতুবা ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক , প্রচারক ও সমর্থক।
বাংলায় এমন একজনও ব্রাহ্মণ এবং তৎসম জাতির মনিষী বা সমাজ সংস্কারকের নাম মনে পড়ে না, যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের উর্ধে উঠে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের উন্নতি ও মঙ্গল সাধনের কথা ভেবে কাজ করেছেন।ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচার মাধ্যম কিভাবে মিথ্যা গল্প ফেঁদে একজন মানুষকে মহান তৈরী করতে পারে তা আজ এখানে দেখার চেষ্টা কোরব।এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমি কাউকে হেঁয় বা ছোট করতে চাইনা।আমার উদ্দেশ্য তা নয়।আমি ব্রাহ্মণ্যবাদ কি ভাবে কাজ করে সেটা দেখানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু যেটা সত্য তাকে অস্বীকারও করতে পারছিনা।যদি এই লেখা পড়ে কারো মনে ব্যথা লাগে তার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।
আজ এখানে আমরা ব্রাহ্মণ প্রদত্ত উপাধি "বিদ্যাসাগর " শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং গুরুচাঁদ ঠাকুর এর তুলনা মূলক সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষা প্রসারের আলোচনা করব।
গুরুচাঁদ ঠাকুর :-1846 সালের 13 ই মার্চ অখন্ড বাংলার ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ বলতে বৎরের 6/7 মাস জলের তলায় ডুবে থাকে, ডোবা ও জল কাঁদায় পরিপূর্ণ থাকে।সম্পূর্ণ বাংলায় কোথাও নিম্নবর্ণের শূদ্র পতিতদের জন্য কোন স্কুল বা পাঠশালা ছিল না । তাই গুরুচাঁদ ঠাকুর কে প্রথমে দশরথ বিশ্বাসের বাড়িতে, তার পর মল্লকাঁদী গ্রামে গোলক কীর্তনীয়ার বাড়িতে থেকে বাংলা ভাষায় পড়াশুনা করেন এবং পরে বর্ণহিন্দুদের স্কুলে স্থান না হওয়ায় মুসলমানের মক্তবে ফার্সি ভাষায় পড়াশুনা করেন।
এই রকম জল কাঁদায় ঢুবে থাকা এলাকার অশিক্ষিত, বর্বর, পতিত মানুষের জন্য সর্বপ্রথম গুরুচাঁদ ঠাকুর অনুভব করেছিলেন যে, এ জাতির মুক্তির এক মাত্র পথ শিক্ষা।শিক্ষা বিনা এদেশের বৃহত্তর শূদ্র অতিশূদ্র ও মুসলমানদের জীবনে আন্ধকার রাতের শেষ হবে না।তাই তিনি 1880 সালে নিজ গৃহ ওড়াকান্দীতে সর্ব প্রথম সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করলেন।শুরু হল শিক্ষার আন্দোলন।পরের বৎসর খুলনা জেলার দত্তডাঙ্গায় নমঃশূদ্র সম্মেলনে শিক্ষার আন্দোলনের ডাক দিলেন।
"দত্তডাঙ্গা সভা মধ্যে গুরুচাঁদ কয়।
শিক্ষা বিনা এ জাতির নাহিক উপায়।।
সেই বানী সবে মানি নিল দেশে দেশে।
পাঠশালা করে সবে পরম উল্লাসে।"
গুরুচাঁদ ঠাকুর 1880 সাল থেকে 1937 সাল পর্যন্ত নিজ হাতে 1812 টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।তিনি বাংলার সকল অশিক্ষিত, বর্বর পতিত জাতির উদ্দেশ্যে বার বার বলতেন--
"বাঁচি কিবা মরি তাতে দুঃখ নাই।
গ্রামে গ্রামে পাঠশালা গড়ে যেতে চাই ।
খাও বা না খাও তাতে দুঃখ নাই ৷
ছেলে মেয়ে শিক্ষা দাও এই আমি চাই ।"
তিনি আরো বলতেন --
"বিদ্যাধর্ম ,বিদ্যাকর্ম ,বিদ্যা সর্বসার ।
বিদ্যা বিনা এ জাতির নাহিক উদ্ধার।"
"ছেলে মেয়ে দিতে শিক্ষা।
প্রয়োজনে কর ভিক্ষা।।"
"শিক্ষাহীন হলে জাতি কোন আশা নাই,
ঘরে ঘরে স্কুল কর মিলিয়া সবাই।
ছেলে মেয়ে উভয়েরে দিতে হবে শিক্ষা।
শক্তি না থাকিলে কর দশদ্বারে ভিক্ষা।"
সমগ্র বাংলার নমঃজাতি তথা অন্যান্য নিম্নবর্ণের( শূদ্র অতিশূদ্র) মানুষদের অজ্ঞান ও অশিক্ষার অন্ধকার কুপ থেকে মুক্তি দেবার জন্য সমগ্র বাংলায় একমাত্র পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর মুক্তির বারিধি হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন।তাঁর আগে বর্ণ বৈশম্যময় হিন্দু ধর্মের কোন মহান ব্যক্তি, সমাজ দরদী, সমাজ সংস্করক তথা তেত্রিশ কোটি দেবী দেবতা ও দুই ডজন অবতার তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তির কথা বলেন নাই, ভাবেন নাই।পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন মহান ব্যক্তি আমি খুঁজে পাই না যিনি সারাজীবন ধরে সমস্ত শ্রেনীর মানুষের কল্যাণে 100 (একশত) স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন।কিন্তু পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজ হাতে 1812 (আঠারো শত বার ) টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় যদি শুধু মাত্র উচ্চ বর্ণের ছেলে মেয়েদের জন্য শহর কেন্দ্রীক 39 (ঊনচল্লিশ) টি ,মতান্তরে 29 টি বিদ্যালয় স্থাপন করে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত হতে পারেন তাহলে জিনি 1812 টি বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন সেই পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর এর নামের সঙ্গে বিদ্যার মহাসাগর উপাধিও অতি তুচ্ছ মনে হবে।সূর্যকে মোমবাতি দেখানোর মত বিষয় হবে।
1858 সালে ব্রিটিশ সরকার দলিত পতিতদের জন্য শিক্ষার কথা বললে এ প্রসঙ্গে দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর 1859 সালে বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর কে এক আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন' - - "আমার সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় শিক্ষা বিস্তারের সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা হল - - - কেবল মাত্র উচ্চ বর্ণের ভিতর ব্যপক ভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।" ( পঞ্চরত্ন ক্যুইজ সমগ্র,হরি গুরুচাঁদ প্রকাশনী)
কিন্তু আমাদের তথা মুলনিবাসী ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও প্রচার মাধ্যমের হীনমন্যতা ও সতেলাপনার কারনে সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ সমাজ দরদী, সমাজ সংস্কারক শিক্ষার আন্দোলনের জলন্ত সূর্য পতিত পাবন গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেলেন না।কারন তিনি নমঃজাতির ঘরে জন্ম গ্রহন করেছেন।
শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় :- 26 সেপ্টেম্বর 1820 সালে বীরভূম জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।ছোট বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন।ব্রাহ্মণ সন্তান বলে বিদ্যা শিক্ষার জন্য কখনো কোন পাঠশালা বা বিদ্যালয়ে প্রবেশ পেতে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় নি।দারিদ্রতা শিক্ষা লাভের পথে বাঁধা সৃষ্টি করলেও সেটা বিরাট কোন বিষয় বলে মনে করি না।ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এর সমাজ সংস্কারমূলক কাজ গুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, এতে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না । তিনি অবশ্যই বাঙালী তথা ভারতবাসীর কাছে প্রনম্য ।কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও প্রচার মাধ্যম একজন মানুষকে কি ভাবে মহান থেকে মহানতর করে তুলতে পারে তার প্রমাণ শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ( বিদ্যাসাগর )।আমরা সকলেই স্কুল জীবনে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে অনেক গল্প কাহিনী পড়েছি ।পড়ে একজন বাঙালী হিসেবে গর্বে বুক ভরে গেছে।কিন্তু সেগুলো কতটা সত্য বা মিথ্যা তা আজ বুঝতে পারছি।
দু-তিন টি কাহিনী এখানে উল্লেখ করব পাঠকগন বিচার করবেন ব্রাহ্মণ্যবাদ কাকে বলে ?
প্রথমে বলি,
"মাতৃ ভক্ত বিদ্যাসাগর "
একবার বিদ্যাসাগরের মাতৃদেবী ছেলে (বিদ্যাসাগর) কে দেখতে চান তাই কলিকাতায় খবর পাঠালেন।খবর পেয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় মায়ের ইচ্ছা পুরন করতে কলিকাতা থেকে গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিলেন।পথে যেতে যেতে রাত হয়ে যায় এবং গ্রীষ্মকাল হওয়াতে বিকেল বেলা ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়।তবু তিনি থামলেন না, মায়ের আদেশ পালন করতে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে চললেন।পথে আবার এক বাঁধা দেখা দিল, খরস্রোতা দামোদর নদ।তার উপরে ঝড় ও বৃষ্টির কারণে আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।এতেও তিনি ভয় পেয়ে থামলেন না।সেই উত্তাল দামোদর তিনি সাঁতরে পার হয়ে গেলেন এবং সেই রাতেই মায়ের সঙ্গে দেখা করলেন।এ পর্যন্ত আমরা দেখলাম যে বিদ্যাসাগরের মাতৃ ভক্তির তুলনা হয় না।
কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য যায়গায়,
" আনন্দবাজার পত্রিকায় একবার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ভ্রাতা শম্ভুচরন বন্দোপাধ্যায়ের লেখার একটি উদৃতি দেখেছিলাম ,সেখানে তিনি লিখেছেন যে, তাঁহার দাদা ঈশ্বরচন্দ্র সাঁতারই জানিতেন না, সুতরাং তাঁহার পক্ষে উত্তাল দামোদর সাঁতরাইয়া পর হইবার প্রশ্নই ওঠে না।"
(সংগ্রহ; -গুরুচাঁদের প্রত্যক্ষ শিক্ষা ।---মনীন্দ্রনাথ বিশ্বাস । পৃষ্ঠা নং 6 )।।
দ্বিতীয় কাহিনীতে শেখানো হয় যে, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় কলিকাতায় থাকিয়া এতই অভাব অনটনের মধ্যে লেখাপড়া শিখেছেন যে রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়ার জন্য প্রদীপের তেল বা কেরোসিন কিনবার মত পয়সা ছিল না, তাই তিনি রাতে কলিকাতার রাস্তার গ্যাসের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে পড়াশুনা করতেন।এখানে পড়াশুনার প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অদম্য ইচ্ছা শক্তির পরিচয় সমাজ ও নুতন নুতন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচার মাধ্যম।
কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করেছে কলিকাতা মিউনিসিপাল্টির তৎকালীন রেকর্ড।তৎকালীন মিউনিসিপাল্টির রেকর্ড পরিক্ষা করে দেখা গেছে যে শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় যখন পড়াশুনা করতেন তখন কলিকাতার রাস্তায় ল্যাম্পপোষ্ট বা গ্যাসের আলো লাগানোই হয়নি।
আর একটা বিষয় বলে লেখাটা শেষ করব, বিষয়টি হল, বিদ্যাসাগরের আত্মসম্মান বোধ বা আমরা বলতে পারি অপমানের বদলা।যেমন কুকুর তেমন মুগুর।
অনেক লোকে প্রায়ই বলে থাকেন, "অশি অপেক্ষা মসির ধার অনেক বেশি তীক্ষ্ণ এবং ধাঁরাল ।"
অর্থাৎ কলমের জোরে একটা বিষয়কে ভালো থেক মন্দ, আবার মন্দ থেকে ভালো তৈরী করা যায়।কাউকে মহান তৈরী করতে তাঁর তুচ্ছ কাজকেও মহান কাজে পরিণত করা যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এর বেলাতেও তাই হয়েছে বলে আমি মনে করি।ঈশ্বরচন্দ্রের এই ঘটনাটা পড়লে বিষয়টা আপনাদের সামনে পরিষ্কার হবে।
কোন এক দরকারে একবার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় জনৈক ইংরেজ অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে তার অফিসে যান।গিয়ে দেখলেন সেই ইংরেজ অফিসার জুতা পায়ে টেবিলের উপরে পা তুলে বসে আছেন।ইংরেজ অফিসার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় কে দেখে পা দুটো টেবিলের উপর থেকে নামালেন না, এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তা করলেন না।সুতরাং ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় অত্যন্ত আপমানিত হলেন।শুধু তিনি কেন? যে কোন সাধারণ মানুষও অপমানিত হবেন ,হবারও কথা।
জনৈক ইংরেজ টেবিলের উপর থেকে পা দুটো না নামিয়ে অত্যন্ত জঘন্য কাজ করেছেন।তার জন্য তাকে বারংবার ধিক্কার জানাই।
কিন্তু ঘটনা ক্রমে কোন একদিন সেই ইংরেজ অফিসার ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলে শ্রী বন্দোপাধ্যায় সেই ইংরেজ অফিসারের মত করে অপমানের প্রতিশোধ নিলেন।
অর্থাৎ ইংরেজ অফিসারকে ভিতরে ঢুকতে দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় নিজের চটি জুতা পায়ে দিয়ে ইংরেজের সামনেই টেবিলের উপর পাঁদুটো তুলে দিলেন।ফল স্বরূপ সেই ইংরেজ অফিসার ভিষন আপমানিত হলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় অপমানের বদলা নিতে পেরে অসীম শান্তি পেলেন।
কিন্তু আপনারাই বলুন, এটা কি কোন পন্ডিত ব্যাক্তির ভদ্রলোকের মত কাজ হয়েছে ?
সেদিন যদি ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় জনৈক ইংরেজ অফিসারকে নিজের অফিসে ঢুকতে দেখে চটি জুতা পায়ে দিয়ে টেবিলের উপরে তুলে না দিয়ে নিজে উঠে গিয়ে ইংরেজের জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে বলতেন, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেদিন সেই ইংরেজ অফিসার তার কৃতকর্মের জন্য আরো বেশী অপমানিত হতেন, লজ্জা পেতেন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি এই কাজটি করতেন তাহলে সেদিন এক বিদেশীর কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির মাথা উচু হত।ভারতীয় সভ্যতার পরিচয় আরো একবার বিদেশী ইংরেজ দেখতে পারত।
কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় তা না করে ইটের বদলে পাটকেল, খুনের বদলা খুন, আর অপমানের বদলে অপমান করে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাথা হেট করলেন।
এখানে সত্যেনদ্রনাথ দত্তের কবিতা মনে পড়ে গেল,
" উত্তম ও অধম"
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়,
কাপড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তায়।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে বলে ভৎসনা ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
"তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নাই দাঁত !"
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
"তুইরে হাঁসালি মোরে।
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়
দংশিব কেমন করে !
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তাই ব'লে কুকুরে কামড়ানো কি'রে
মানুষের শোভা পায় ?"
tarunkantithakur@gmail.com, 08855805900.
No comments:
Post a Comment