মন্ত্রিসভার বহর কমেছে। কিন্তু একই ধরনের মন্ত্রকগুলি মিশিয়ে দেওয়া হয়নি।

প্রত্যাশা ছিল, বিশেষজ্ঞদের মন্ত্রী করা হতে পারে। তা-ও হয়নি।

যে ধাক্কাটি মন্ত্রিসভার গঠনের সময়ই দেওয়া উচিত ছিল, সে পথেও হাঁটেননি তিনি।

'ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসন' এই আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় আসার দশ দিন পরে আজ কার্যত চমকহীন এক মন্ত্রিসভা পেশ করলেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।

রাজ্য ছেড়ে মোদী রাজধানীর গুজরাত ভবনে আস্তানা গাড়ার পর থেকে গত ছ'দিন ধরে মন্ত্রিসভার চেহারা নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনা চলছিল সেখানে। বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করছিলেন ভাবী প্রধানমন্ত্রী। দল সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছিল, প্রশাসনে গতি আনতে এক দিকে যেমন মন্ত্রিসভার বহর কমাবেন তিনি, তেমনই মিশিয়ে দেওয়া হবে একই ধরনের একাধিক মন্ত্রককে। আজ রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনের চত্বরে প্রায় পাঁচ হাজার অভ্যাগতের সামনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পরে দেখা গেল, দেশের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী একটি প্রত্যাশা পূরণ করেছেন, অন্যটি নয়।

বিদায়ী মনমোহন সিংহ সরকারে মন্ত্রী ছিলেন ৭৮ জন। ৩৩ জন পূর্ণমন্ত্রী। ১২ জন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী এবং ৩৩ জন প্রতিমন্ত্রী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন ৫৬ জন। মোদী আজ ৪৫ জনকে মন্ত্রী করেছেন। যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে ২৩ জন পূর্ণমন্ত্রী। ১০ জন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী। বাকি ১২ জন প্রতিমন্ত্রী।

ফলে আগের দুই প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় মন্ত্রিসভার বহর অনেকটাই কমিয়েছেন মোদী। কিন্তু এক ধাক্কায় মন্ত্রকের সংখ্যা কমানোর যে প্রত্যাশা তাঁর কাছে ছিল, সেটা পূরণ করতে পারেননি তিনি। এত দিন মনে করা হচ্ছিল, পরিবহণ সংক্রান্ত সমস্ত মন্ত্রক, অর্থাৎ রেল, ভূতল পরিবহণ এবং জাহাজ মন্ত্রক মিশিয়ে দেবেন মোদী। মিশে যাবে কৃষি এবং খাদ্য মন্ত্রক বা গ্রামোন্নয়ন এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রক। নতুন সরকারের কাছে শিল্প মহলেরও তেমনই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর কোনওটাই হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। একাধিক মন্ত্রক মিশিয়ে দিতে গেলে আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কারণ বিভিন্ন মন্ত্রক মেশাতে গেলে সরকারি স্তরে বহু পদ বিলুপ্ত হবে। ওই সব পদের আমলাদের কোথায় সরানো হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। তাই প্রাথমিক ভাবে একই মন্ত্রীকে একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে সেই পথে এগোনোর চেষ্টা শুরু হয়েছে।

সরকারের এই যুক্তিতে অবশ্য খুশি নয় শিল্পমহল। তাদের বক্তব্য, এই ধরনের সংস্কার একেবারে গোড়াতেই এক ধাক্কায় করা দরকার। না হলে পরে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার চাপে এগোনো কঠিন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া, একই ধরনের মন্ত্রকগুলি যদি এক জন মন্ত্রীর হাতে দেওয়া হতো, তা হলেও সংস্কারের একটা বার্তা যেত। কিন্তু তেমনটাও করা হয়নি।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন...

সংস্কারের কাজে তেমন সফল না হলেও নিজের মন্ত্রিসভা কিন্তু সুকৌশলেই সাজিয়েছেন মোদী। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকগুলির ভার নিজের আস্থাভাজনদের হাতেই তিনি সঁপে দিয়েছেন। যাতে মূল রাশটি নিজের হাতে থাকে। পাশাপাশি দূরে সরিয়ে রেখেছেন লালকৃষ্ণ আডবাণীকে। মুরলীমনোহর জোশী মন্ত্রী হতে চাইলেও ঠাঁই দেননি তাঁকে। সব মিলিয়ে মন্ত্রিসভায় বিরোধী স্বর যতটা সম্ভব কমিয়ে গোড়ার দিনেই টিম মোদীর ভিতটা পোক্ত করে ফেললেন নয়া প্রধানমন্ত্রী।

আর সেই কাজ করতে গিয়ে লোকসভা ভোটে হারা দুই প্রার্থীকে আজ পূর্ণমন্ত্রী করেছেন মোদী। প্রথম জন তাঁর দীর্ঘদিনের সেনাপতি অরুণ জেটলি। রাত পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে মন্ত্রক বণ্টন করা না-হলেও বিজেপি সূত্রের খবর দু'টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক অর্থ এবং প্রতিরক্ষা পেয়েছেন জেটলি। যা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে দল এবং প্রশাসনের অন্দরে। তবে প্রশাসনের অন্য সূত্র বলছে, এমন নয় যে আগামী পাঁচ বছরই এই দুই মন্ত্রক জেটলির হাতে থাকবে। জেটলিকে মোদী বলেছেন, যত দিন না উপযুক্ত কাউকে পাওয়া যাচ্ছে, তত দিন তিনি যেন দু'টি মন্ত্রকই সামলে দেন।

বিজেপি সূত্রে খবর, প্রাক্তন সেনাপ্রধান ভি কে সিংহ বা মুরলীমনোহর জোশীর মতো কেউ কেউ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মোদী চান সৎ এবং তাঁর আস্থাভাজন কাউকে ওই পদে বসাতে। এই অবস্থায় অর্থমন্ত্রীর হাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক দেওয়া একটি প্রশাসনিক যুক্তিও আছে বলে বিজেপি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। তাদের মতে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সংস্কার করতে চান মোদী। তিনি চান, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির দক্ষতা আরও বাড়িয়ে বাহিনীর পরিকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে বিদেশি রাষ্ট্রের উপর নির্ভরতা কমাতে। এই সংস্কারের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রক ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই এই দুই মন্ত্রক এক জনের হাতে থাকলে সংস্কারের সুবিধা হবে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার চারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দু'টির দায়িত্ব পেয়ে জেটলিই যে মোদীর পরে সব থেকে প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও আজ প্রধানমন্ত্রীর পরে শপথ নিয়েছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তার পরে শপথ নেন সুষমা স্বরাজ। যাঁর হাতে বিদেশ মন্ত্রক যাচ্ছে বলে খবর।

কিন্তু রাজনাথ বা সুষমা কেউই মোদীর আস্থাভাজন নন। বিশেষ করে সুষমা। গত লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী তো গোড়া থেকেই দলের অন্দরে মোদীর বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁদের পাল্লা যাতে ভারী না হয়, সেই জন্যই ভোটে হারা কাউকে মন্ত্রী করা ঠিক নয় এই যুক্তিতে কান দেননি মোদী। জেটলি জোড়া দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্য দিকে  নিজের আর এক ঘনিষ্ঠ, অমেঠীতে রাহুল গাঁধীকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া স্মৃতি ইরানিকেও আজ পূর্ণমন্ত্রী করেছেন মোদী। বিজেপি সূত্রে খবর, গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। বাজপেয়ী জমানায় যে মন্ত্রক সামলাতেন মুরলীমনোহর জোশী।

পেট্রোলিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকও হেভিওয়েট কাউকে না দিয়ে মোদী নিজের আস্থাভাজন ধর্মেন্দ্র প্রধানকে দিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে। এই মন্ত্রকটি নিয়ে বরাবরই শিল্প মহলের চাপ থাকে। ধর্মেন্দ্রকে স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী করে তার রাশ বকলমে মোদী নিজের হাতেই রাখলেন বলে মনে করা হচ্ছে। আর এক আস্থাভাজন পীযূষ গয়ালকে মোদী একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়েছেন বলে খবর।

বিজেপির এক নেতার কথায়, "আসলে নরেন্দ্র মোদী একটি পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে চাইছেন। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই মন্ত্রিসভার আরও সম্প্রসারণ বা পরিমার্জন হবে।"

মন্ত্রী কমলো, মন্ত্রক নয়

আপাতত শিকে ছিঁড়ল না বাংলার কপালে

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি, ২৭ মে, ২০১৪, ০৩:৩২:৪৭

সংখ্যায় মাত্র দুই।

তবুও আশায় বুক বেঁধেছিল বঙ্গবাসী। যদি শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিত্বের শিকে ছেঁড়ে বঙ্গের দুই বিজেপি সাংসদের কপালে। পূর্ণমন্ত্রী যদি বা না-ও হয়, তা হলেও যাতে অন্তত একটি প্রতিমন্ত্রীর আসন জোটে রাজ্যের ভাগ্যে!

কিন্তু হতাশই হতে হল রাজ্যবাসীকে। দৌড়ে এগিয়ে থাকলেও নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় জায়গা হল না আসানসোলের বাবুল সুপ্রিয়র। ফলে পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় এ রাজ্যের কোনও প্রতিনিধিত্বই রইল না। যদিও বিজেপির একটি সূত্র দাবি করেছে, আগামী এক-দু'মাসের মধ্যে ফের মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হবে। তখন আনা হতে পারে বাবুলকে। আপাতত আশা-নিরাশার দোলাচল মিটে যাওয়ায় নিজের কেন্দ্র আসানসোলের উন্নয়নেই মনোযোগ দিতে চাইছেন তিনি।

রাজ্য থেকে দুই সাংসদ এর আগেও পেয়েছে বিজেপি। ১৯৯৯ সালে। সেই দু'জনই, তপন শিকদার এবং সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় কিন্তু অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন তৃণমূলের সঙ্গে জোট ছিল বিজেপির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েছিলেন রেলমন্ত্রী।

এ যাত্রায় মন্ত্রিসভায় বাবুল স্থান পাবেন এমন আশা জাগিয়েছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদীই। আসানসোলে জনসভায় দাঁড়িয়ে মোদীর বক্তব্য ছিল, "মুঝে দিল্লিমে বাবুল চাহিয়ে।" নির্বাচনে হেভিওয়েট তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেনকে হারানোর পর তাই পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন, বাবুলকে নিশ্চয়ই মন্ত্রী করা হবে। বাবুল শিবিরের দাবি ছিল, রাজ্যে তৃণমূলের হয়ে লড়াইয়ে নামতে হলে গায়ক-সাংসদকে মন্ত্রী করা উচিত। তবেই রাজ্যবাসীকে বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

কেন মন্ত্রী হলেন না বাবুল?

বিজেপি সূত্রে বলা হচ্ছে, মোদী প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন মন্ত্রিসভা হবে ছোট। কার্যত একার হাতে এই দলটি গড়েছেন তিনি। সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা কর্নাটকের মতো রাজ্য, যে সব জায়গায় ভাল ফল করেছে বিজেপি। স্বাভাবিক ভাবেই এই সব রাজ্য থেকে বেশি সদস্যকে তিনি জায়গা দিয়েছেন মন্ত্রিসভায়। বিজেপি সূত্রের খবর, এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের সূত্র মেনেই এগোনো হয়েছে। ফর্মুলাটি ছিল, কোনও রাজ্যের প্রতি বারো জন সাংসদ পিছু এক জন পূর্ণমন্ত্রী, আর চার জন সাংসদ পিছু এক জনকে প্রতিমন্ত্রী করা হবে। এই সূত্র মানলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গের কোনও প্রতিনিধি থাকার কথা নয়।

যদিও রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সেই নিয়মে কিছু ব্যতিক্রম ঘটাবেন মোদী। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই হতাশ বাবুল শিবির। বাবুল অবশ্য বলেছেন, "আসানসোলের মানুষের স্বপ্নপূরণ করাই এখন লক্ষ্য। সেখানকার মানুষের জন্য কাজ শুরু করতে আমি উদগ্রীব হয়ে রয়েছি। আমি জানি, লম্বা দৌড়ে লিফ্টে করে ওঠার চেয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওঠা অনেক বেশি কার্যকরী।"

পরে চা চক্রে বাবুলের সঙ্গে লালকৃষ্ণ আডবাণীর পরিচয় করিয়ে দিতে যান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। বলেন, ওকে চেনেন? ভাল গান গায়। আডবাণী বলেন, হ্যাঁ চিনি। একই সঙ্গে প্রবীণ বিজেপি নেতার বক্তব্য, বাবুলের জয়টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

মোদীর মন্ত্রিসভায় রাজ্যের কোনও প্রতিনিধিত্ব না থাকায় তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির আঁতাঁতের অভিযোগ এনেছেন রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, "মমতা ও বিজেপির গোপন আঁতাঁত রয়েছে। আমাদের ধারণা মমতাকে স্বস্তি দিতেই রাজ্য থেকে কাউকে মন্ত্রী করা হয়নি। তা না হলে মমতা 'হরিদাস পাল'-র শপথ গ্রহণে মুকুল রায় ও অমিত মিত্রকে প্রতিনিধি করে পাঠান!"

মন্ত্রিসভা বহরে বাড়তে পারে, আজ এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন শিবসেনার সাংসদ অনন্ত গীতেও। এনডিএ-র সব থেকে পুরনো শরিক শিবসেনা থেকে এক মাত্র গীতেই এ দিন টিম মোদীতে ঠাঁই পেয়েছেন। তিনি এ দিন বলেন, "আগামী এক মাসের মধ্যে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ করা হবে। সেখানে শিবসেনার আরও দু'জন অন্তর্ভুক্ত হবেন।" গীতের ওই বক্তব্য শোনার পরে অনেকেই মনে করছেন, প্রথম সম্প্রসারণটা শীঘ্রই করে ফেলতে পারেন মোদী। বিজেপি সূত্রও বলছে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই মন্ত্রিসভা করার ব্যাপারে চাপ ছিল মোদীর উপর। তড়িঘড়িতে তাই সব প্রান্তের প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়তো সম্ভব হয়নি। এ বারে সব দিক বিবেচনা করে খুব দ্রুত মন্ত্রিসভায় সম্প্রসারণ করার কথা ভেবে রেখেছেন শীর্ষ বিজেপি নেতৃত্ব। সেই মন্ত্রিসভায় বাবুল স্থান পান কি না, সেটাই এখন দেখার।


৪৪ সদস্য নিয়ে মোদির যাত্রা শুরু
রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে শপথ গ্রহণ ॥ মন্ত্রিসভায় আছেন রাজনাথ সিং, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলিরা
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2014-05-27&ni=174120
কাওসার রহমান ॥ কথা রাখলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বড় জয় পেয়েও গড়লেন ছোট সরকার। ইউপিএ সরকারের ৭৭ সদস্যের মন্ত্রিসভার বিপরীতে ৪৪ সদস্যের ছোট সরকার নিয়েই শক্তিশালী ও উন্নত ভারত গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যাত্রা শুরু করলেন তিনি। সোমবার রাষ্ট্রপতি ভবনে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে সাড়ম্বরেই শপথ নিলেন ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার এ আড়ম্বরপূর্ণ শপথ অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে রইলেন এ উপমহাদেশের চার হাজার অতিথি। চা বিক্রেতা থেকে শুরু করে সার্ক দেশসমূহের সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ, বিদেশী কূটনীতিক, সেলিব্রেটি, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণীর মানুষ প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে রইলেন মোদির এ ঐতিহাসিক শপথ অনুষ্ঠানের। 
সব শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতিতে শপথ নিতে পারায় টুইটারে সন্তোষ প্রকাশ করেন মোদি। আর শপথ নিয়ে দেশবাসীর প্রতি এক বার্তায় মোদি শক্তিশালী ও উন্নত ভারত গড়তে সকলের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেন। মোদির শপথ গ্রহণের পর পরই দিল্লীর আকাশে আকাশে ভেসে উঠে আলোকচ্ছটা। রাস্তায় রাস্তায় চলে আতশবাজি। সারাদেশে বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা আনন্দে নেচে গেয়ে উৎসব মেতে উঠে।
সোমবার সন্ধ্যাটা একটু অন্যরকম ছিল ভারতবাসীর জন্য। এ দিন ৩০ বছর পর একক দল হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে নতুন সরকার গড়ে নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনের আগে মোদি কথা দিয়েছিলেন ছোট সরকার গড়ে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার। সেই প্রতিশ্রুতিরই এক ধাপ পূরণ করলেন ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার ছোট সরকারে ঠাঁই পেয়েছেন রাজনাথ সিং, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নাইড়ু, নিতিন গাড়কড়ি, উমা ভারতীর মতো রাজনীতিকরা।
রাষ্ট্রপতি ভবনের সুবিশাল চত্বরে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে শুরু হয় এ রাজকীয় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। তার আগেই দেশী-বিদেশী অতিথিদের সাড়ম্বর উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বর। ৬টা ৭ মিনিটে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি আসেন সুসজ্জিত শপথ মঞ্চে। এ সময় বেজে ওঠে রাষ্ট্রপতির আগমনী বার্তা। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিরা দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতির প্রতি। রাষ্ট্রপতি শপথ মঞ্চে আসার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় বহুল কাক্সিক্ষত সেই শপথ অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের জন্য নাম ডাকা হয় ১৬তম লোকসভা নির্বাচনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া নরেন্দ্র মোদির। আর সঙ্গে সঙ্গেই অভিনন্দনের মুহুর্মুহু করতালিতে রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বর মুখরিত হয়ে উঠে। আকাশে ভেসে উঠে আলোকচ্ছটা। রাস্তায় রাস্তায় চলে আতশবাজি। সারাদেশে বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা আনন্দে নেচে গেয়ে মেতে উঠে।
দর্শক সারি থেকে দৃঢ় পায়ে নরেন্দ্র মোদি এগিয়ে যান শপথ মঞ্চে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রীর শপথ বাক্য। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনের সুবিশাল চত্বরে বয়ে যায় মোদিকে অভিনন্দিত করার করতালির বন্যা। শপথ বাক্য পাঠ শেষে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে মাধা নুইয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানান। রাষ্ট্রপতিও করমর্দনের মাধ্যমে তাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিনন্দন জানান। 
এর পর এক এক করে শপথ নেন মোদি সরকারের ৪৪ সদস্যের মন্ত্রিসভার সদস্য। এদের মধ্যে ২৩ পূর্ণমন্ত্রী, ১০ স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও ১১ প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। তবে চার সপ্তাহের মধ্যে মোদি মন্ত্রিসভার আকার বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে টিডিপি, শিবসেনা, আকালী দলের আরও সদস্য মোদির মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। 
ভারতের ইতিহাসে নজির ভেঙ্গে মোদির ইচ্ছা অনুযায়ী, এবারই প্রথম সার্ক দেশের সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। অনেক ঘটনার জম্ম দিয়ে শেষ পর্যন্ত ৩০ সদস্যের বিশাল প্রতিনিধি দল নিয়ে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হয়ে মোদির শপথে যোগ দেন স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দ্র রাজাপাকসে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী সেরিং তোবেগে এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম। উপস্থিত ছিলেন মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী নবীন চন্দ্র রামগুলামও। 
বিরোধী দল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী, সহসভাপতি রাহুল গান্ধী, সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। শপথ অনুষ্ঠানে আসেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল ও এপিজে আবদুল কালাম। অনুষ্ঠানে আসেন বরোদা আসনে মোদির মনোনয়নের প্রস্তাবক চা-বিক্রেতা কিরণ মাহিদাও। 
মদির মন্ত্রিসভায় যাঁরা ঠাঁই পেলেন তাদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন রাজনাথ সিং, অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, রেলমন্ত্রী সদানন্দ গোড়া, সংসদবিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইড়ু, পরিবহনমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি, পানি সম্পদ ও গঙ্গা পরিষ্কার মন্ত্রী উমা ভারতী, সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী নাজমা হেফাতুল্লা, পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী গোপীনাথ মুন্ডে, খাদ্যমন্ত্রী রামবিলাস পাসওয়ান, নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী মানেকা গান্ধী, কেমিক্যাল ও ফার্টিলাইজার মন্ত্রী আনথ কুমার, রবিশঙ্কর প্রসাদ টেলিযোগাযোগ ও আইন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী হারসিমাত কুমার বাদল, উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রী জোয়াল বাঘান্দ, কৃষিমন্ত্রী রাধা মোহন সিং, মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী হর্ষবর্ধন, বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সিতারামন, কয়লা ও বিদ্যুত মন্ত্রী পিযুষ গোয়েল, অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী অশোক গজপতি রাজু, সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন প্রকাশ জাভরেকার, মহাকাশ গবেষণাবিষয়ক মন্ত্রী জীতেন্দ্র সিং ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। 
এক ঘণ্টার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে দেশী বিদেশী অতিথিদের গুজরাটি ঢোকলা, বাহারি নিরামিষ, কাবাবের মতো অল্পকিছু আমিষ এবং স্যান্ডউইচ, পেটিস, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। 
শপথ গ্রহণের পর পরই মোদি দেশী বিদেশী ভারতীয়দের উদ্দেশে বার্তা দেন। সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তন করা হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইট। সেখানে ভেসে উঠে নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই দামোদর মোদির ছবি। 
শপথ অনুষ্ঠান শেষে মোদি আগত দেশী বিদেশী অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। রাতে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শপথ নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন ৭ রেসকোর্স রোডের বাসভবনে উঠেন। যা বিজেপির ১১ অশোকা রোড থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। আজ সকাল ৮টা থেকে মোদি নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন শুরু করবেন। 
শপথ গ্রহণের আগে নরেন্দ্র মোদি সোমবার সকালে রাজঘাটে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।