Awami league inflicted with internal conflict.
নীতিনির্ধারক-দায়িত্বশীল পর্যায়ের লোকদের একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য
ঘরের লোকদের 'বিতর্কিত' বক্তব্যে নাকাল আ'লীগ
সরদার আবদুর রহমান : নিজের ঘরেই এক চরম বেকায়দায় পড়েছে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ঘরের লোকদের 'বিতর্কিত' বক্তব্যে বলতে গেলে নাকাল অবস্থা আ'লীগের। সাম্প্রতিক সময়ে দলের নীতিনির্ধারণী ও উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে একের পর এক বক্তব্য-মন্তব্য উচ্চারিত হতে থাকায় শুধু দলের ভেতরে নয়, জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তোলপাড় সৃষ্টি করে। বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েও কোন কোন ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তি তাদের বক্তব্যে অনড় ও অটল থাকার ঘোষণাও দেন।
বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসা এসব ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, বহিষ্কৃত মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, সাবেক মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল অব. একে খন্দকার প্রমুখ। এছাড়া দলের 'জাতীয় নেতাদের' একজন তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদও বই লিখে আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলে দেন। সর্বশেষ, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা, চার আনাও না; এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই'-এই মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিস্ফোরক বক্তব্যে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মহাজোটের ক্ষমতার মসনদ। আর মহানবী হযরত মুহাম্মাদ স. ও পবিত্র হজ্ব নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে কটূক্তি করায় সরকারের পাশাপাশি লতিফ সিদ্দিকীর নিজের ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়।
রিক্রুটেডদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে নির্বাচন
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন সংক্রান্ত কুট-কৌশল নির্ধারক এইচ টি ইমাম গত ১২ নবেম্বর ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের 'ভেতরের কথা' প্রকাশ করে দেন। তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর নিজেদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করার কথাও প্রকাশ করেন। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধীদলীয় অভিযোগকে এতোদিন সরকারি মহল উড়িয়ে দিলেও ইমামের বক্তব্যে তা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, 'নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশের, প্রশাসনের যে ভূমিকা; নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি। সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা বুক পেতে দিয়েছে। আমাদের যে ১৯ জন পুলিশ ভাই প্রাণ দিয়েছে, তোমাদের মনে আছে এরা কারা? সব আমাদের মানুষ।' একই অনুষ্ঠানে দলীয় প্রার্থীদের চাকরি প্রদান প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, 'যখনই কারো বায়োডাটা নিয়ে যাই, বলি যে এরা সুযোগ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই জিজ্ঞেস করেন তারা কি ছাত্রলীগ করেছে? কোথায় পদধারী ছিল? তোমরা অনেকেই বল ছাত্রলীগের চাকরির কথা। দেখ, আমার চেয়ে, নেত্রীর চেয়ে, অন্য কারো দরদ কী বেশি আছে? আমরা তো জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি। নেত্রী বলেন, যেভাবেই হোক আমাদের ছেলেদের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তারপরে আমরা দেখব।'
জয় সরকারের কেউ নয়
এর আগে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা বহিষ্কৃত মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে সেখানকার টাঙ্গাইলবাসীদের সাথে এক মতবিনিময়কালে দেয়া বক্তব্যে রীতিমত ঝড় ওঠে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মহলে। তিনি তার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন? 'জয় ভাই' কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন।' প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে নিউ ইয়র্ক সফরকালে লতিফ সিদ্দিকী আরো বলেন, 'আমি জামায়াতে ইসলামীর বিরোধী। তার চেয়েও বেশি বিরোধী হজ ও তাবলীগ জামাতের।' তিনি বলেন, 'এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছে। এদের কোন কাম নাই। এদের কোনো প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে।' তিনি হজের শুরু প্রসঙ্গে বলেন, 'আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ চিন্তা করলো, এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কীভাবে চলবে। তারা তো ছিল ডাকাত। তখন একটা ব্যবস্থা করলো যে, আমার অনুসারীরা প্রতি বছর একবার একসাথে মিলিত হবে। এর মধ্য দিয়ে একটা আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে।' তাবলীগ জামাতের সমালোচনা করে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, 'তাবলীগ জামাত প্রতি বছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদের তো কোনো কাজ নেই। সারা দেশের গাড়ি-ঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।' আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর এই বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে তার দল আ'লীগ চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে সরকারের তরফে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি তার সংসদ সদস্য পদ বহাল রয়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মপ্রাণ মানুষদের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত মামলায় আত্মসমর্পণের পর তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। সূত্র জানায়, লতিফ সিদ্দিকীর হজ¦ বিষয়ক মন্তব্যে সরকার বিব্রত হলেও মূল অ্যাকশনটা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেয়ার দায়ে।
নিশা দেশাই 'দুই আনার মন্ত্রী'
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। এই সফর নিয়ে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি গত ২৯ ডিসেম্বর খুলনায় দলের এক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে নিশা দেশাইকে 'দুই আনার মন্ত্রী' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিশা দেশাইয়ের বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সৈয়দ আশরাফ বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা, চার আনাও না- এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই। ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যদিও সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'টেলিভিশনে দেখে মনে হয়েছে ২২/২৩ বছরের মেয়ের সামনে খালেদা জিয়া একদম শিশু। হাত পেতে বসে আছেন ক্ষমতাটা যাতে এই মিস দেশাই খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দেবেন।' একই অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনারও সমালোচনা করেন। রাষ্ট্রদূত মজিনাকে 'কাজের মেয়ে মর্জিনা' বলে সম্বোধন করেন তিনি। আশরাফ বলেন, 'কয়দিন আগে উনি (খালেদা জিয়া) ছিলেন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে। মজিনা তো কত চেষ্টা করল নির্বাচনটা বন্ধ করার জন্য, শেখ হাসিনা যাতে প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে তার জন্য। এমন কোনো প্রচেষ্টা নাই তিনি করেন নাই। আল্লার ওয়াস্তে সবশেষে চাকরির মেয়াদও শেষ, ক্ষমতাও শেষ। আগামী সপ্তাহে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেবেন। জীবনে হয় তো আর বাংলাদেশে আসবেন না। বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নাই যে 'কাজের মেয়ে মর্জিনা' বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করবে।' এর আগে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমদও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার বিরূপ মন্তব্য করেন।
'ঘুষ' অবৈধ নয়?
'ঘুষ দেয়া-নেয়া অবৈধ নয়' বলে সামাজিক ও ধর্মীয় মহলে বিতর্ক তোলেন আরেক সিনিয়র মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, 'যা কোনো কাজের গতি আনে, আমি মনে করি তা কোনো অবৈধ বিষয় নয়। উন্নত দেশগুলোয় একে বৈধ করে দেয়া হয়েছে ভিন্ন নামে।' গত ১২ নবেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'কারো কাজ দ্রুত করে দিয়ে উপহার নিলে তা অবৈধ মনে করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি তা অবৈধ মনে করি না।' মুহিতের 'ঘুষ অবৈধ নয়' এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হলে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেননি।' অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও শীর্ষ ওলামায়ে কেরামগণ প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা অর্থমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতিও দেন। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকেও এর প্রতিবাদ জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জয় পাকিস্তান!
আওয়ামী লীগেরই আরেক ঘরের লোক মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের বিদায়ী সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী একে খন্দকার বীরোত্তম তাঁর লেখা আত্মজৈবনিক গ্রন্থ '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' প্রকাশের পর তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ বেজায় ক্ষুব্ধ হয়। এই বিবরণের গুরুতর ও উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় একে খন্দকার লিখেছেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষ শব্দ ছিল 'জয় পাকিস্তান'। এছাড়া একে খন্দকার তার বন্ধু মঈদুল হাসানের বরাত দিয়ে বলেন, 'তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র লিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তা পাঠ করতে বললেও তিনি রাজি হননি। উল্টো তিনি বলেন, 'এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে।' এ কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে বেরিয়ে যান।' এ ছাড়া 'মুজিব বাহিনী ভারতীয়দের কাছ থেকে সম্মানী পেতো', 'মুজিব বাহিনী অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে অবজ্ঞা করত' মুক্তিযুদ্ধকালীন এমন আরো কিছু তথ্য তিনি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। একে খন্দকারের এই বই নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে তিরস্কার, গালাগালি ও সমালোচনার বন্যা বয়ে যায়। সংসদ অধিবেশন থেকে রাজপথ, আলোচনার টেবিল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রায় সবখানেই দলের বাঘা বাঘা নেতা থেকে পাতি নেতা পর্যন্ত একে খন্দকারের পি-ি চটকানোর কাজ চলে। দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বইটি অবিলম্বে নিষিদ্ধের দাবি তোলেন। ইতিহাস বিকৃতি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সরকারের প্রভাবশালীরা তাঁকে গ্রেফতারেরও দাবি জানান। একজন নেতা তাঁকে 'কুলাঙ্গার' এবং আরেকজন নেতা 'রাষ্ট্রদ্রোহী' আখ্যা দেন।
মুজিববাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মুক্তিযোদ্ধারা!
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এবং আ'লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জোহরা তাজউদ্দীনের কন্যা শারমিন আহমদ তাঁর রচিত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থেও আওয়ামী লীগের সাজানো ইতিহাসকে তছনছ করে দেন। তাঁর এই বইয়ের বিবরণ নিয়ে তিরস্কার করতে ছাড়েননি দলের অনেক নেতা। তাঁর 'তাজউদ্দীন : নেতা ও পিতা' গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, 'পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু (তাজউদ্দীন আহমদ) স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণার স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে শেরাটন) অবস্থিত বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে এবং তাঁরা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। আব্বু বলেছিলেন, 'মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কারণ কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না, কী তাদের করতে হবে। এই ঘোষণা কোনো-না-কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে।' মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন 'এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে। ---মুজিব কাকুকে আত্মগোপন বা স্বাধীনতার ঘোষণায় রাজি করাতে না পেরে রাত নয়টার দিকে আব্বু ঘরে ফিরলেন বিক্ষুব্ধ চিত্তে। আম্মাকে সব ঘটনা জানালেন। মুজিব কাকুর সঙ্গে পুরান ঢাকার পূর্ব নির্ধারিত গোপন স্থানে আব্বুর আত্মগোপন করার কথা ছিল। মুজিব কাকু না যাওয়াতে পূর্ব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।' শারমিন আরো লিখেছেন, '--একদিকে আব্বুকে (তাজউদ্দীন আহমদকে) যেমন প্রতিহত করতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তেমন যুবনেতাদের অনাস্থা ও ষড়যন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের একাংশের অন্তর্কলহ ও কোন্দল। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে যুবনেতারা স্বাধীন বাংলাদেশ তথা মুজিবনগর সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন করে।' শারমিন আরো লিখেছেন, '--আগস্টে আব্বু যখন দিল্লি সফর করেন, সেখানে তিনি 'র' এর সাহায্যপুষ্ট 'মুজিব বাহিনীর' ক্রমবর্ধমান উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপ ও সরকার-বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এই স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিভক্তকারী মারাত্মক সমস্যা সমাধানের জন্য পি.এন হাকসার (ইন্দিরা গান্ধীর সচিব) এবং 'র' এর প্রধান রামনাথ কাওয়ের সাহায্য চান। কিন্তু দুজনেই নীরব..।' শারমিন আরো জানান, 'সমগ্র জাতির মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে আব্বুর নিবেদিত কর্মপ্রয়াসের বিপরীতে অনুগত তরুণদের ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ে সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে গঠিত মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। তাদের আত্মঘাতী কর্মকা- ও ভিত্তিহীন অপপ্রচারণা তাঁদের ক্রমশই অপ্রিয় করে তোলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয়, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিট হয় মুজিববাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের কাতার থেকে তারা এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারত সরকারও তাদের প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে মুজিববাহিনীর শীর্ষস্থানীয় এক নেতা এতটাই হিংসাত্মক ও মরিয়া হয়ে ওঠে যে সে আব্বুকে হত্যারও প্রচেষ্টা চালায়।' এছাড়া 'মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর-কথোপকথন' নামক গ্রন্থেও মুক্তিযুদ্ধের তিন দিকপাল একে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মির্জা আওয়ামী লীগের গড়া ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন।
ভাষ্যকারদের মতে, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে সম্পূর্ণ নিজেদের মতো করে সাজিয়ে তুলেছিলো। কিন্তু এসব গ্রন্থের তথ্যাবলি সেই সাজানো ইতিহাসকে তছনছ করে দিয়েছে। এভাবে ভেতর থেকে একের পর এক বিস্ফোরণে রীতিমত বেকায়দায় পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একদিকে দলীয় লোকজনের খুন-হত্যা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবজি, দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগ, অপরদিকে সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ঘরের লোকদের একের পর এক মন্তব্যে সরকারের ভেতরে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। রাজনীতি বিশ্লেষক ও সচেতন মানুষ মনে করছেন, সরকার শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার যে চেষ্টা করে আসছিলো তা মন্ত্রী-উপদেষ্টারা সবই ফাঁস করে দিচ্ছেন।
বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসা এসব ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, বহিষ্কৃত মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, সাবেক মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল অব. একে খন্দকার প্রমুখ। এছাড়া দলের 'জাতীয় নেতাদের' একজন তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদও বই লিখে আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলে দেন। সর্বশেষ, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা, চার আনাও না; এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই'-এই মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিস্ফোরক বক্তব্যে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মহাজোটের ক্ষমতার মসনদ। আর মহানবী হযরত মুহাম্মাদ স. ও পবিত্র হজ্ব নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে কটূক্তি করায় সরকারের পাশাপাশি লতিফ সিদ্দিকীর নিজের ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়।
রিক্রুটেডদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে নির্বাচন
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন সংক্রান্ত কুট-কৌশল নির্ধারক এইচ টি ইমাম গত ১২ নবেম্বর ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের 'ভেতরের কথা' প্রকাশ করে দেন। তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর নিজেদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করার কথাও প্রকাশ করেন। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধীদলীয় অভিযোগকে এতোদিন সরকারি মহল উড়িয়ে দিলেও ইমামের বক্তব্যে তা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, 'নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশের, প্রশাসনের যে ভূমিকা; নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি। সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা বুক পেতে দিয়েছে। আমাদের যে ১৯ জন পুলিশ ভাই প্রাণ দিয়েছে, তোমাদের মনে আছে এরা কারা? সব আমাদের মানুষ।' একই অনুষ্ঠানে দলীয় প্রার্থীদের চাকরি প্রদান প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, 'যখনই কারো বায়োডাটা নিয়ে যাই, বলি যে এরা সুযোগ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই জিজ্ঞেস করেন তারা কি ছাত্রলীগ করেছে? কোথায় পদধারী ছিল? তোমরা অনেকেই বল ছাত্রলীগের চাকরির কথা। দেখ, আমার চেয়ে, নেত্রীর চেয়ে, অন্য কারো দরদ কী বেশি আছে? আমরা তো জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি। নেত্রী বলেন, যেভাবেই হোক আমাদের ছেলেদের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তারপরে আমরা দেখব।'
জয় সরকারের কেউ নয়
এর আগে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা বহিষ্কৃত মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে সেখানকার টাঙ্গাইলবাসীদের সাথে এক মতবিনিময়কালে দেয়া বক্তব্যে রীতিমত ঝড় ওঠে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মহলে। তিনি তার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন? 'জয় ভাই' কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন।' প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে নিউ ইয়র্ক সফরকালে লতিফ সিদ্দিকী আরো বলেন, 'আমি জামায়াতে ইসলামীর বিরোধী। তার চেয়েও বেশি বিরোধী হজ ও তাবলীগ জামাতের।' তিনি বলেন, 'এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছে। এদের কোন কাম নাই। এদের কোনো প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে।' তিনি হজের শুরু প্রসঙ্গে বলেন, 'আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ চিন্তা করলো, এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কীভাবে চলবে। তারা তো ছিল ডাকাত। তখন একটা ব্যবস্থা করলো যে, আমার অনুসারীরা প্রতি বছর একবার একসাথে মিলিত হবে। এর মধ্য দিয়ে একটা আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে।' তাবলীগ জামাতের সমালোচনা করে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, 'তাবলীগ জামাত প্রতি বছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদের তো কোনো কাজ নেই। সারা দেশের গাড়ি-ঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।' আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর এই বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে তার দল আ'লীগ চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে সরকারের তরফে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি তার সংসদ সদস্য পদ বহাল রয়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মপ্রাণ মানুষদের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত মামলায় আত্মসমর্পণের পর তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। সূত্র জানায়, লতিফ সিদ্দিকীর হজ¦ বিষয়ক মন্তব্যে সরকার বিব্রত হলেও মূল অ্যাকশনটা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেয়ার দায়ে।
নিশা দেশাই 'দুই আনার মন্ত্রী'
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। এই সফর নিয়ে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি গত ২৯ ডিসেম্বর খুলনায় দলের এক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে নিশা দেশাইকে 'দুই আনার মন্ত্রী' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিশা দেশাইয়ের বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সৈয়দ আশরাফ বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা, চার আনাও না- এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই। ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যদিও সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'টেলিভিশনে দেখে মনে হয়েছে ২২/২৩ বছরের মেয়ের সামনে খালেদা জিয়া একদম শিশু। হাত পেতে বসে আছেন ক্ষমতাটা যাতে এই মিস দেশাই খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দেবেন।' একই অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনারও সমালোচনা করেন। রাষ্ট্রদূত মজিনাকে 'কাজের মেয়ে মর্জিনা' বলে সম্বোধন করেন তিনি। আশরাফ বলেন, 'কয়দিন আগে উনি (খালেদা জিয়া) ছিলেন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে। মজিনা তো কত চেষ্টা করল নির্বাচনটা বন্ধ করার জন্য, শেখ হাসিনা যাতে প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে তার জন্য। এমন কোনো প্রচেষ্টা নাই তিনি করেন নাই। আল্লার ওয়াস্তে সবশেষে চাকরির মেয়াদও শেষ, ক্ষমতাও শেষ। আগামী সপ্তাহে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেবেন। জীবনে হয় তো আর বাংলাদেশে আসবেন না। বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নাই যে 'কাজের মেয়ে মর্জিনা' বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করবে।' এর আগে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমদও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার বিরূপ মন্তব্য করেন।
'ঘুষ' অবৈধ নয়?
'ঘুষ দেয়া-নেয়া অবৈধ নয়' বলে সামাজিক ও ধর্মীয় মহলে বিতর্ক তোলেন আরেক সিনিয়র মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, 'যা কোনো কাজের গতি আনে, আমি মনে করি তা কোনো অবৈধ বিষয় নয়। উন্নত দেশগুলোয় একে বৈধ করে দেয়া হয়েছে ভিন্ন নামে।' গত ১২ নবেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'কারো কাজ দ্রুত করে দিয়ে উপহার নিলে তা অবৈধ মনে করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি তা অবৈধ মনে করি না।' মুহিতের 'ঘুষ অবৈধ নয়' এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হলে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেননি।' অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও শীর্ষ ওলামায়ে কেরামগণ প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা অর্থমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতিও দেন। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকেও এর প্রতিবাদ জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জয় পাকিস্তান!
আওয়ামী লীগেরই আরেক ঘরের লোক মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের বিদায়ী সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী একে খন্দকার বীরোত্তম তাঁর লেখা আত্মজৈবনিক গ্রন্থ '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' প্রকাশের পর তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ বেজায় ক্ষুব্ধ হয়। এই বিবরণের গুরুতর ও উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় একে খন্দকার লিখেছেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষ শব্দ ছিল 'জয় পাকিস্তান'। এছাড়া একে খন্দকার তার বন্ধু মঈদুল হাসানের বরাত দিয়ে বলেন, 'তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র লিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তা পাঠ করতে বললেও তিনি রাজি হননি। উল্টো তিনি বলেন, 'এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে।' এ কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে বেরিয়ে যান।' এ ছাড়া 'মুজিব বাহিনী ভারতীয়দের কাছ থেকে সম্মানী পেতো', 'মুজিব বাহিনী অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে অবজ্ঞা করত' মুক্তিযুদ্ধকালীন এমন আরো কিছু তথ্য তিনি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। একে খন্দকারের এই বই নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে তিরস্কার, গালাগালি ও সমালোচনার বন্যা বয়ে যায়। সংসদ অধিবেশন থেকে রাজপথ, আলোচনার টেবিল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রায় সবখানেই দলের বাঘা বাঘা নেতা থেকে পাতি নেতা পর্যন্ত একে খন্দকারের পি-ি চটকানোর কাজ চলে। দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বইটি অবিলম্বে নিষিদ্ধের দাবি তোলেন। ইতিহাস বিকৃতি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সরকারের প্রভাবশালীরা তাঁকে গ্রেফতারেরও দাবি জানান। একজন নেতা তাঁকে 'কুলাঙ্গার' এবং আরেকজন নেতা 'রাষ্ট্রদ্রোহী' আখ্যা দেন।
মুজিববাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মুক্তিযোদ্ধারা!
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এবং আ'লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জোহরা তাজউদ্দীনের কন্যা শারমিন আহমদ তাঁর রচিত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থেও আওয়ামী লীগের সাজানো ইতিহাসকে তছনছ করে দেন। তাঁর এই বইয়ের বিবরণ নিয়ে তিরস্কার করতে ছাড়েননি দলের অনেক নেতা। তাঁর 'তাজউদ্দীন : নেতা ও পিতা' গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, 'পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু (তাজউদ্দীন আহমদ) স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণার স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে শেরাটন) অবস্থিত বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে এবং তাঁরা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। আব্বু বলেছিলেন, 'মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কারণ কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না, কী তাদের করতে হবে। এই ঘোষণা কোনো-না-কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে।' মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন 'এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে। ---মুজিব কাকুকে আত্মগোপন বা স্বাধীনতার ঘোষণায় রাজি করাতে না পেরে রাত নয়টার দিকে আব্বু ঘরে ফিরলেন বিক্ষুব্ধ চিত্তে। আম্মাকে সব ঘটনা জানালেন। মুজিব কাকুর সঙ্গে পুরান ঢাকার পূর্ব নির্ধারিত গোপন স্থানে আব্বুর আত্মগোপন করার কথা ছিল। মুজিব কাকু না যাওয়াতে পূর্ব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।' শারমিন আরো লিখেছেন, '--একদিকে আব্বুকে (তাজউদ্দীন আহমদকে) যেমন প্রতিহত করতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তেমন যুবনেতাদের অনাস্থা ও ষড়যন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের একাংশের অন্তর্কলহ ও কোন্দল। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে যুবনেতারা স্বাধীন বাংলাদেশ তথা মুজিবনগর সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন করে।' শারমিন আরো লিখেছেন, '--আগস্টে আব্বু যখন দিল্লি সফর করেন, সেখানে তিনি 'র' এর সাহায্যপুষ্ট 'মুজিব বাহিনীর' ক্রমবর্ধমান উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপ ও সরকার-বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এই স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিভক্তকারী মারাত্মক সমস্যা সমাধানের জন্য পি.এন হাকসার (ইন্দিরা গান্ধীর সচিব) এবং 'র' এর প্রধান রামনাথ কাওয়ের সাহায্য চান। কিন্তু দুজনেই নীরব..।' শারমিন আরো জানান, 'সমগ্র জাতির মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে আব্বুর নিবেদিত কর্মপ্রয়াসের বিপরীতে অনুগত তরুণদের ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ে সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে গঠিত মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। তাদের আত্মঘাতী কর্মকা- ও ভিত্তিহীন অপপ্রচারণা তাঁদের ক্রমশই অপ্রিয় করে তোলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয়, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিট হয় মুজিববাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের কাতার থেকে তারা এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারত সরকারও তাদের প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে মুজিববাহিনীর শীর্ষস্থানীয় এক নেতা এতটাই হিংসাত্মক ও মরিয়া হয়ে ওঠে যে সে আব্বুকে হত্যারও প্রচেষ্টা চালায়।' এছাড়া 'মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর-কথোপকথন' নামক গ্রন্থেও মুক্তিযুদ্ধের তিন দিকপাল একে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মির্জা আওয়ামী লীগের গড়া ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন।
ভাষ্যকারদের মতে, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে সম্পূর্ণ নিজেদের মতো করে সাজিয়ে তুলেছিলো। কিন্তু এসব গ্রন্থের তথ্যাবলি সেই সাজানো ইতিহাসকে তছনছ করে দিয়েছে। এভাবে ভেতর থেকে একের পর এক বিস্ফোরণে রীতিমত বেকায়দায় পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একদিকে দলীয় লোকজনের খুন-হত্যা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবজি, দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগ, অপরদিকে সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ঘরের লোকদের একের পর এক মন্তব্যে সরকারের ভেতরে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। রাজনীতি বিশ্লেষক ও সচেতন মানুষ মনে করছেন, সরকার শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার যে চেষ্টা করে আসছিলো তা মন্ত্রী-উপদেষ্টারা সবই ফাঁস করে দিচ্ছেন।
No comments:
Post a Comment