সাক্ষাৎকারে শফিক রেহমান : বিদেশি চাপে বেকায়দায় সরকার, পতন হবে
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অনৈতিক আখ্যা দিয়ে এই সরকারকে চলে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারকে বিদায় নিতে হবে এবং তারা সেটা বলছেন। সরকার কিভাবে চলে যাবে সেটি বড় একটি প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে- আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার চলে যাবে।
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে রেডিও তেহরানকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার শফিক রেহমান এসব কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এদেশে আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কূটনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন আছে।
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম কিছু দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে খুব কঠিন অবস্থান নিয়েছে। তো সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে সরকার বেকায়দায় আছে; নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে।
বিশিষ্ট এ সাংবাদিক বলেন, আওয়ামী লীগ যদি চায় এবং অন্যকে বাধ্য করে তাহলে তখন আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি সহিংস দল তৈরি হবে। আর তখন আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি নিজেও হয়তো সেই আন্দোলনে যোগ দেব।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে শফিক রেহমান বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ভারত। ফলে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব থাকতেই হবে। তবে তার মানে এই নয় যে তাদের পদানত হয়ে থাকতে হবে বা তারা আমাদেরকে পদানত রাখতে পারবে।
পাঠকদের জন্য পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো—
প্রশ্ন: বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আগামী মার্চের মধ্যে সরকার পতনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মির্জা আব্বাস বলেছেন, সরকারের কাছে কত গুলি আছে দেখতে চাই। আর শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ডিসেম্বরে ঢাকা অবরোধ করা হবে। তাছাড়া বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক চেহারার পরিবর্তন হবে। আজ ক'দিন ধরে বিভিন্ন অঙ্গন থেকে এ ধরনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। কিসের ভিত্তিতে এই আভাস?
শফিক রেহমান: বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনীতি নিয়ে এভাবে ভবিষ্যত বাণী না করাই উচিত। কারণ আমেরিকার মতো বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের বিধি-বিধান নেই। আমরা সবসময় বৃটিশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে অনুসরণ করছি। আমরা অনিশ্চিতের মধ্যেই থেকে যাচ্ছি। এই অবস্থার সমাধান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে সরকারটি আছে তারা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অনৈতিক সরকার। এই সরকারকে চলে যেতে হবে, বিদায় নিতে হবে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারকে বিদায় নিতে হবে। আর সেকথাই তারা বলছে। তবে সরকার কিভাবে চলে যাবে সেটি একটি প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার চলে যাবে।
বিএনপি নেতারা যে মার্চের কথা বলছে সে সম্পর্কে বলব, এই শীতকালটাকে যদি সরকার পার করতে পারে তাহলে অনেকের ধারণা সরকার আরো একটি বছর ক্ষমতায় থেকে যাবে। ফলে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদল খুবই চেষ্টা করবে যাতে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে স্বচ্ছ একটি নির্বাচন আদায় করে নিতে পারে। আর সে কারণেই এখন বিএনপি নেতাসহ অন্যান্য নেতাদের কাছ থেকে এ ধরনের কথা আসছে।
প্রশ্ন: বিএনপির কোনো কোনো নেতা সম্প্রতি জানিয়েছেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে তাদের পক্ষে জোরালো কূটনৈতিক সমর্থন রয়েছে। এখন বরং তাদের জন্য জনপ্রত্যাশা পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- বিএনপি কি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে বলে আপনি মনে করেন? আর এই কূটনৈতিক সমর্থনেরই বা কী গুরুত্ব আছে?
শফিক রেহমান: আমি প্রথমেই বলব কূটনৈতিক সমর্থনের খুবই গুরুত্ব আছে। আজকের যুগে শেষ বিচারে কূটনৈতিক সমর্থনের দরকার পড়ে। কেননা এখন বিশ্ব একটা গ্লোবাল ভিলেজ। ধরুন, বাংলাদেশের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ অন্যরা যে গার্মেন্টস সামগ্রী কিনবে এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য জায়গায় আমাদের জনশক্তি রপ্তানি হবে। আর এগুলোর ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ যে সেক্টরগুলো আছে। যেমন ধরুন হাউজিং প্রজেক্ট। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে লোক গেলে তারা এদেশে ফ্লাট কিনবে। তখন হাউজিং সেক্টরটা খুব ভালোভাবে চলবে। এভাবে প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে প্রতিটি জিনিস সম্পৃক্ত। আর সেকারণে বিদেশি সমর্থন দরকার।
এখন যদি কূটনৈতিকরা বলে যে, না আমরা তোমাদের গার্মেন্ট কিনব না; তোমাদের জনশক্তি নেব না, তাহলে সঙ্কটে পড়তে হবে। এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি মধ্যপ্রাচ্যে লোক নিচ্ছে না। যদিও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন কিছু লোক নেয়ার তদবির করতে। কিন্তু সে সফর ব্যর্থ হয়েছে। তারা কেবল বলেছে মাত্র ২ হাজার নারী শ্রমিক তারা নেবে। তবে সেটিও নিশ্চিত করা যায়নি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া হবে। কিন্তু তারা সেটা করতে তো পারেইনি বরং বিভিন্ন দেশে তাদের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন ফিরে আসছে, নতুন চাকরির বাজারও সৃষ্টি হচ্ছে না। এর ফলে দেশে বেকারত্ব আরো বেড়ে গেছে। ফলে এ বিষয়টি আসলে কূটনীতির উপর নির্ভর করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম কিছু দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে খুব কঠিন অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশে যে পর পর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে, এ কারণেও তারা ক্ষুব্ধ। অথচ হাসিনা বলছেন, বিদেশিরা যে যাই বলুক না কেন আমি বিচার করব এবং মৃত্যুদণ্ড দিতেই থাকব। অর্থাৎ তার কথায় এমন মনে হচ্ছে যে, তিনিই বিচারক এবং তিনি মৃত্যুদণ্ড দিতেই থাকবেন। আর এর মাধ্যমে তিনি এদেশে হাজার হাজার বিধবা সৃষ্টি করছেন।
তবে এটি আজকের যুগে সম্ভব না। কারণ তুর্কিসহ ১২টি মুসলিম দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোট ১৪০টি দেশে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা হয়েছে। এসব কারণে ইইউ বাংলাদেশের প্রতি খুবই বিরক্ত। কারণ তারা মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। তাছাড়া আমেরিকাও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ওপর বিরক্ত। ফলে সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে সরকার বেকায়দায় আছে; নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। আর এজন্যেই প্রধানমন্ত্রী ইংল্যান্ডে গেলেন না। তার সফর বাতিল করা হয়েছে।
এর আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সঙ্গে দেখা করে তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, ক্যামেরন বলেছেন- পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি কখনও এমনটি বলেননি। আমি ইংল্যান্ডে বহু বছর ছিলাম এবং এখনও সেখানকার রাজনীতি আমি ফলো করি। কিন্তু আমি কখনও দেখিনি কোনো ভিজিটিং প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার পর দিনই একটা স্টেটমেন্ট আসে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরের পর এরকমই একটি স্টেটমেন্ট এলো যে, আমরা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই। এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই বিব্রত আছেন।
শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ সরকার এটি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। সুনির্দিষ্টভাবে আরো একটি জায়গায় তিনি আটকে গেছেন। লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে শেখ হাসিনার পুত্র সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ তিনি করেছেন। আর সেই অভিযোগের চিত্র মিডিয়াতে চলে এসেছে। আর জয় সম্পর্কে যেসব কথা লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, তার উত্তর শেখ হাসিনা অর্থাৎ জয়ের মা এখনও পর্যন্ত দিতে পারেননি।
কেন এই অভিযোগগুলো করা হলো, এটা সত্য নাকি মিথ্যা সে ব্যাপারে উনি কিছু বলছেন না। উনি কেবল লতিফ সিদ্দিকীর ধর্মের দিক এবং হজের দিকটা নিয়ে কথা বলেছেন। এটার ফলে একটা ধারণা করা যেতে পারে যে, আমেরিকা এবং ইইউসহ অন্যান্যরা বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তারা পেয়েছে। আর সেটা শেখ হাসিনার সরকারের জন্য শুভ সংবাদ নয়।
আর সেজন্যেই কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত থাকলে শেখ হাসিনার জন্য তার সরকারকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তারপরও কূটনীতিকরা বলবে যে হ্যাঁ আমরা তোমাদের দেশে দুর্নীতির চিত্র দেখছি; অনিয়ম দেখছি। এরপরও বলা হচ্ছে মানুষ আওয়ামী লীগকে চায়। বিএনপিকে প্রমাণ করতে হবে যে, দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে চায় না। জনসমর্থন তাদের পক্ষে। আর সেজন্যেই খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করছেন। কিশোরগঞ্জে জনসভা করেছেন। অন্যান্য জায়গায়ও তিনি মিটিং করেছেন।
বিএনপির জনসভায় এই যে জনসমর্থন বিদেশিরা এবং হাসিনা দেখছে- এতেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে জনসমর্থন বিএনপির পক্ষে রয়েছে। ফলে জনসমর্থন যেমন দরকার একইসঙ্গে কূটনৈতিক সমর্থনও দরকার।
তারপরও হার্ডডোজ যদি প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে আমি বলব খালেদা জিয়া অত্যন্ত সাহসী, তিনি শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাননি। শেখ হাসিনা সাহসের বড়াই করেন কিন্তু সময়মতো পালিয়ে যান। যেমন ১/১১ পর তিনি দু'বার পালিয়ে গিয়েছিলেন দেশ থেকে। তারপর বিদেশিদের কাছ থেকে গ্যারান্টি নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
তারপর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারাই তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। অন্যদিকে খালেদা অত্যন্ত সহসিকতার সঙ্গে বর্তমান আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। একই সঙ্গে আমি বলে রাখছি, আমি কিন্তু বিএনপির কোনো সদস্য নই।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের একটা বিশেষ ভূমিকা ও প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশের কূটনীতিকদের এক সম্মেলনে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আদর্শ নয়। তিনি চান বাংলাদেশে আদর্শ গণতন্ত্র ফিরে আসুক। ভারতীয় কূটনীতিবিদের এ বক্তব্যকে কিভাবে দেখবেন?
শফিক রেহমান: ভারত আমাদের শুধু তিন দিক থেকে ঘিরে রাখেনি সাড়ে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে বলে সাবেক ভারতীয় এক হাইকমিশনার দেব মুখার্জী আমাকে বলেছিলেন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। আমাকে তিনি বললেন, শফিক তোমাদের তিন দিক থেকে নয় সাড়ে তিন দিক থেকে আমরা ঘিরে রেখেছি। তার মানে জিজ্ঞেস করায় তিনি আমাকে বললেন, বঙ্গোপসাগরেও তোমাদেরকে আমরা ঘিরে রেখেছি। ফলে যে দেশটি আমাদের সাড়ে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব থাকতেই হবে। তবে তার মানে এই নয় যে তাদের পদানত হয়ে থাকতে হবে বা তারা আমাদেরকে পদানত রাখতে পারবে। ভারত যদি আমাদেরকে কাশ্মীর ভাবে তাহলে তারা ভুল করবে।
তবে কাশ্মীরের মুসলমানদেরকে তারা পদানত করে রাখতে পেরেছে এর কারণ হচ্ছে তারা স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। ফলে ভারতের জন্য সংকট হবে যদি তারা কাশ্মীরের কথা ভেবে অথবা হায়দ্রাবাদের কথা ভেবে বাংলাদেশকে পদানত করে রাখতে চায়। একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ব্রিটিশ শাসনের সময় যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তার অধিকাংশই কিন্তু বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে হয়েছে। সূর্যসেন যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন তিনিও বাংলাদেশের সন্তান। বলতে গেলে প্রায় সব আন্দোলন বাংলাদেশ থেকেই হয়েছে। ফলে আবারও যদি তীব্র আন্দোলন হয় তাহলে সেটা ভারতের জন্য ভালো হবে না।
এ প্রসঙ্গে আমি বলব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে যে মিটিং হয়েছে সেখানে অনেককে সাবেক বলা হলেও পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীতে সাবেক বলা যাবে না। কারণ আমি যতটুকু জানি পিআর চক্রবর্তী দিল্লিতে বাংলাদেশ ডেস্কের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। আর তিনি যদি বলেন- বাংলাদেশে একটি ভালো নির্বাচন হওয়া উচিত এবং তা হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তাহলে সেটা আমাদের জন্যও আশার কথা। আর একথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যাবে যে, ভারতের সুমতি হয়েছে অথবা বলতে হবে রামের সুমতি হয়েছে।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী সম্পর্কে আমি আরো দু'একটা কথা বলতে চাই। তার নামের আদ্যক্ষর হচ্ছে পিআর অর্থাৎ পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ঢাকায় হাইকমিশনার থাকা অবস্থায় কোনো দিনও তিনি বেগম খালেদা জিয়ার ঈদ বা অন্য কোনো পার্টিতে আসেননি। আমি ওইসব পার্টির অন্যতম সংগঠক হিসেবে বিষয়টি জানি। তারপর তিনি যখন থাইল্যান্ডে বদলি হয়ে যান তখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আর সেদিন আমি তাকে ধরলাম এবং হাসতে হাসতে বললাম, আপনি আপনার নামের প্রতি সুবিচার করেননি।
তিনি অবাক হয়ে গেলেন এবং এর অর্থ জানতে চাইলেন। তখন আমি তাকে বললাম আপনার নামের আদ্যক্ষর হচ্ছে পিআর, মানে পাবলিক রিলেশন্স। অথচ আপনি জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশন্স করেননি। আপনি কেবল একটি দলের সঙ্গে রিলেশন্স করেছেন। অথচ ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে উচিত ছিল দুটি দলের সঙ্গেই পিআর তৈরি করা। অথচ আপনি সেটা করেননি এবং সে বিষয়টি সংশোধন করার জন্য শেষবারের মতো আপনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি আমার কথার উত্তর দিতে পারেননি।
ফলে আমাদেরকে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এদেশের বুদ্ধিজীবী এবং কূটনীতিকরা ভারতের কথা এলেই চুপ হয়ে যায়। ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যে নতজানু হয়ে যায় সেটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। এর কারণ আমি খুঁজে পাই না। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিদেশে বহু বছর কাজ করেছি। ভারতের সঙ্গে কম্পিটিশন করে জিতেছি অনেক সময় তাদের চেয়ে ওপরে উঠেছি।
আমাদের দেশের মানুষদেরকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে দৃষ্টি দিতে হবে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকার দিকে। ফলে ফরগেট দি ইন্ডিয়ান! তারা ভালো হোক মন্দ হোক তাদের মতোই আছে; তাদের মতোই তারা তাদের রাষ্ট্র চালাবে। তাদের কাছে নতজানু হওয়ার বিষয়টি আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর মনে হয়। এই ভারতীয়দের আনা হচ্ছে। কেন তাদেরকে আনা হচ্ছে? কেন ইংল্যান্ড থেকে বা ইউরোপ আমেরিকার অন্যান্য দেশ থেকে লোকদের আনা হচ্ছে না। তারা আনতে পারবে না। এখানে ভারতপ্রীতি এবং ভারত ফোবিয়া দুটোকেই আমি মারাত্মক খারাপ বিষয় বলে মনে করি।
তবে হ্যাঁ একথাও সত্যি যে, ভারত আমাদের প্রতিবেশি বড় রাষ্ট্র। আমরা প্রতিবেশির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে চাই। ইউরোপে আমরা দেখেছি ফ্রান্স এবং জার্মানি বহু বছর লড়াই করেছে। আবার তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আমরাও ভারতের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতে চাই। তবে লিড নিতে হবে ভারতকে। কারণ তারা বড় রাষ্ট্র। তাদেরকে আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। আমরা তো তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে প্রস্তুত আছি; আমরা তো তাদের সঙ্গে লড়াই করে কখনও জিততে পারব না। ফলে আমরা কেন তাদের সঙ্গে লড়াই করব; এ বিষয়টি ভারতকে বুঝতে হবে।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জোটের আকার বাড়তে বাড়তে এখন ২০ দলে পৌঁছেছে। তারপরও আন্দোলনের বড় কোনো কর্মসূচি নেই। সংকটটা কাদের- বিএনপির নাকি জোটের?
শফিক রেহমান: দেখুন, এটি হচ্ছে আওয়ামী প্রচারণা। মিডিয়ার প্রচারণা। আর আপনারাও আওয়ামী সেই প্রচারণার মধ্যে পড়ে গেছেন। বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তাদের কোনো পত্রিকা নেই, রেডিও নেই, টেলিভিশন নেই; কিচ্ছু নেই। তাদের কেবল আছে জনসমর্থন। আর আওয়ামী সরকারের আছে মিডিয়া সমর্থন, আছে প্রোপাগাণ্ডা।
আমি বাংলাদেশে ছোটবেলা থেকে আছি। ১৯৪৫ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন আমি দেখে আসছি। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রায় সব আন্দোলনই আমি দেখেছি এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু ২০১৩ সালে যে আন্দোলন দেখেছি এমন দুর্বার আন্দোলন আর কখনও দেখিনি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে এর আগে আওয়ামী লীগ বলত তাদের কাছ থেকে বিএনপির আন্দোলন শিখতে হবে। তবে এখন আর তারা সেটা বলে না। কেননা বিএনপির আন্দোলন কিরকম হতে পারে সেটা আওয়ামী লীগ খুব ভালোভাবে জেনে গেছে।
সেই আন্দোলনের সময় কয়েক হাজার গাছ কাটা পড়েছে, অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীরা রেললাইন উপড়ে ফেলেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন শহর দখল করে নিয়েছিল। এমনটি ১৯৭১ সালেও হয়নি। এই সত্যটাকে আজকে মানতে হবে। আমি দেশজুড়ে ১৯৭১ সালেও এতবড় আন্দোলন দেখিনি। আমি ৭১ দেখেছি এবং ২০১৩ দেখেছি।
তবে সেই দুর্বার আন্দোলনেও সরকার পড়েনি। সরকার পড়েনি এই অর্থে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে না বের হয়ে গেলে সরকার পতন বলা যাবে না। তিনি যেদিন গণভবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলবেন, আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিলাম। অথচ সেটা তিনি করেননি। তিনি বসে আছেন এই ভরসায় যে কেউ না কেউ তাকে উদ্ধার করবে।
তবে আমি একথা বলব, আন্দোলন সার্বিকভাবে হয়েছে সারাদেশে। তবে ঢাকাতে সরকারের পতন হয়নি। তাছাড়া আমি আরো একটা কথা বলে রাখতে চাই সেটি হচ্ছে- বিএনপি কোনো সংগ্রামী, বিপ্লবী বা ক্যাডারভিত্তিক দল নয়। রাস্তায় নেমে মারামারি কাটকাটি করবে এটি বিএনপির কাছ থেকে আশা করাও তো অন্যায়।
বিএনপি সম্পর্কে আমি আরো বলতে চাই, খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে কোনো আন্দোলনে যেন কেউ মারা না যায়। তার কারণ হচ্ছে এর আগে এরশাদের আমলে মিছিলে আন্দোলনে বাস উঠিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। মিলনকে হত্যা করা হলো। অথচ খালেদা জিয়া সেটা করতে দেননি। তিনি মানুষের মৃত্যু চাননি। অথচ এখন আন্দোলনের সময় বলে দেয়া হয় দেখামাত্র গুলি কর, দেখামাত্র গ্রেপ্তার কর। তো এই অবস্থার মধ্যে আন্দোলন করতে গেলে সহিংস হতে হবে। বিএনপি সহিংস আন্দোলন চায় না। বিএনপি একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দল।
আওয়ামী লীগ যদি চায় এবং অন্যকে বাধ্য করে তাহলে তখন আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি সহিংস দল তৈরি হবে। আর তখন আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি নিজেও হয়তো সেই আন্দোলনে যোগ দেব। তবে সরকারের এমনটি করা কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না।ওরা অন্যায় করছে। তাদেরকে গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে এবং গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন করতে হবে। মানুষের আশা করা অন্যায় যে বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো সহিংস এবং বদমায়েশি করবে। এটা কখনও হবে না।
প্রশ্ন: সরকারবিরোধী আন্দোলনে আরো বড় প্লাটফর্ম গঠনের তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি, যে প্লাটফর্ম সরকারের হার্ডলাইন অবস্থানকে মোকাবেলায় মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। এমন কার্যকর প্লাটফর্ম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটা দেখছেন আপনি?
শফিক রেহমান: সরকারবিরোধী বড় প্লাটফর্ম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। যে কোনো গণতন্ত্রমনা দল বা ব্যক্তির উচিত হবে যদি বড় কোনো প্লাটফর্ম হয় তাহলে তাতে যোগ দেয়া। কেননা বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যুক্তফ্রন্ট থেকে শুরু করে ৯০-এ এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত বড় প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে।
যখন সবগুলো দল ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয় এবং একসঙ্গে আন্দোলন করে তখন তারা জয়লাভ করে। সেই হিসেবে যদি একটা বড় ফ্রন্ট হয় অর্থাৎ বিশ দল থেকে যদি ৩০ দল হয় তাহলে সফলতা আসবে খুব সহজেই। তবে বর্তমানে অনেক দল মানে একজনের একটি সাইনবোর্ড দল; তারপরও তাদের একটা অবদান থাকে। তারা কথা বলতে পারে; চিন্তাধারা প্রকাশ করতে পারে; এবং ইনপুট দিতে পারে। ফলে সবাই মিলে বিএনপির সঙ্গে যদি আন্দোলন করে সেটা বিএনপির জন্যও ভালো হবে এবং অন্য সবার জন্যও ভালো হবে। আর তখন দেশে একটা গণতন্ত্র ফিরে আসবে।
তবে সবচেয়ে ভালো হয় আওয়ামী লীগ যদি এটা বুঝতে সক্ষম হয় যে মারামারি কাটাকাটি করে কোনো লাভ হবে না, বিদেশিদের চাপ আছে এবং দেশে একটা বড় প্লাটফর্ম হয়েছে ফলে যে কোনো মুহূর্তে বড় আন্দোলন হতে পারে। হয়তো আওয়ামী লীগের এবং শেখ হাসিনার এমন একটা সুমতি হতে পারে যে আমি তোমাদের নির্বাচন দিলাম এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন হবে। যেখানে তারা এমপি থেকে হাস্যকর নির্বাচন করার বিষয়টি আর রিপিট করবেন না। তারা যদি তাদের ভুল এবং গোয়ার্তুমি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তাহলে দেশের জন্য ভালো হবে।
তবে বিএনপি যে কোনোভাবেই হোক জিতবে কারণ মানুষ তাদের পক্ষে। তবে বড় কোনো প্লাটফর্ম হলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে কথা হচ্ছে সেটি খুব দ্রুত সম্ভব হবে এবং ক্ষমতায় ফিরে আসাটা সহজ হবে। একইসঙ্গে হতাহতের পরিমাণ কম হবে। আর আমরা সেটাই চাই। বিভিন্ন আন্দোলনে এদেশে অনেকে বিধবা হয়েছে, অনেকে এতিম হয়েছে। আমরা আর রক্তপাত দেখতে চাই না।
http://bangla.irib.ir/2010-04-21-08-29-09/2010-04-21-08-30-45/item/68285-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2014/12/04/261821#.VH_m9WfDXgI
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অনৈতিক আখ্যা দিয়ে এই সরকারকে চলে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারকে বিদায় নিতে হবে এবং তারা সেটা বলছেন। সরকার কিভাবে চলে যাবে সেটি বড় একটি প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে- আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার চলে যাবে।
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে রেডিও তেহরানকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার শফিক রেহমান এসব কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এদেশে আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কূটনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন আছে।
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম কিছু দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে খুব কঠিন অবস্থান নিয়েছে। তো সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে সরকার বেকায়দায় আছে; নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে।
বিশিষ্ট এ সাংবাদিক বলেন, আওয়ামী লীগ যদি চায় এবং অন্যকে বাধ্য করে তাহলে তখন আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি সহিংস দল তৈরি হবে। আর তখন আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি নিজেও হয়তো সেই আন্দোলনে যোগ দেব।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে শফিক রেহমান বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ভারত। ফলে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব থাকতেই হবে। তবে তার মানে এই নয় যে তাদের পদানত হয়ে থাকতে হবে বা তারা আমাদেরকে পদানত রাখতে পারবে।
পাঠকদের জন্য পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো—
প্রশ্ন: বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আগামী মার্চের মধ্যে সরকার পতনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মির্জা আব্বাস বলেছেন, সরকারের কাছে কত গুলি আছে দেখতে চাই। আর শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ডিসেম্বরে ঢাকা অবরোধ করা হবে। তাছাড়া বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক চেহারার পরিবর্তন হবে। আজ ক'দিন ধরে বিভিন্ন অঙ্গন থেকে এ ধরনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। কিসের ভিত্তিতে এই আভাস?
শফিক রেহমান: বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনীতি নিয়ে এভাবে ভবিষ্যত বাণী না করাই উচিত। কারণ আমেরিকার মতো বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের বিধি-বিধান নেই। আমরা সবসময় বৃটিশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে অনুসরণ করছি। আমরা অনিশ্চিতের মধ্যেই থেকে যাচ্ছি। এই অবস্থার সমাধান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে সরকারটি আছে তারা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অনৈতিক সরকার। এই সরকারকে চলে যেতে হবে, বিদায় নিতে হবে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারকে বিদায় নিতে হবে। আর সেকথাই তারা বলছে। তবে সরকার কিভাবে চলে যাবে সেটি একটি প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার চলে যাবে।
বিএনপি নেতারা যে মার্চের কথা বলছে সে সম্পর্কে বলব, এই শীতকালটাকে যদি সরকার পার করতে পারে তাহলে অনেকের ধারণা সরকার আরো একটি বছর ক্ষমতায় থেকে যাবে। ফলে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদল খুবই চেষ্টা করবে যাতে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে স্বচ্ছ একটি নির্বাচন আদায় করে নিতে পারে। আর সে কারণেই এখন বিএনপি নেতাসহ অন্যান্য নেতাদের কাছ থেকে এ ধরনের কথা আসছে।
প্রশ্ন: বিএনপির কোনো কোনো নেতা সম্প্রতি জানিয়েছেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে তাদের পক্ষে জোরালো কূটনৈতিক সমর্থন রয়েছে। এখন বরং তাদের জন্য জনপ্রত্যাশা পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- বিএনপি কি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে বলে আপনি মনে করেন? আর এই কূটনৈতিক সমর্থনেরই বা কী গুরুত্ব আছে?
শফিক রেহমান: আমি প্রথমেই বলব কূটনৈতিক সমর্থনের খুবই গুরুত্ব আছে। আজকের যুগে শেষ বিচারে কূটনৈতিক সমর্থনের দরকার পড়ে। কেননা এখন বিশ্ব একটা গ্লোবাল ভিলেজ। ধরুন, বাংলাদেশের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ অন্যরা যে গার্মেন্টস সামগ্রী কিনবে এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য জায়গায় আমাদের জনশক্তি রপ্তানি হবে। আর এগুলোর ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ যে সেক্টরগুলো আছে। যেমন ধরুন হাউজিং প্রজেক্ট। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে লোক গেলে তারা এদেশে ফ্লাট কিনবে। তখন হাউজিং সেক্টরটা খুব ভালোভাবে চলবে। এভাবে প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে প্রতিটি জিনিস সম্পৃক্ত। আর সেকারণে বিদেশি সমর্থন দরকার।
এখন যদি কূটনৈতিকরা বলে যে, না আমরা তোমাদের গার্মেন্ট কিনব না; তোমাদের জনশক্তি নেব না, তাহলে সঙ্কটে পড়তে হবে। এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি মধ্যপ্রাচ্যে লোক নিচ্ছে না। যদিও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন কিছু লোক নেয়ার তদবির করতে। কিন্তু সে সফর ব্যর্থ হয়েছে। তারা কেবল বলেছে মাত্র ২ হাজার নারী শ্রমিক তারা নেবে। তবে সেটিও নিশ্চিত করা যায়নি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া হবে। কিন্তু তারা সেটা করতে তো পারেইনি বরং বিভিন্ন দেশে তাদের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন ফিরে আসছে, নতুন চাকরির বাজারও সৃষ্টি হচ্ছে না। এর ফলে দেশে বেকারত্ব আরো বেড়ে গেছে। ফলে এ বিষয়টি আসলে কূটনীতির উপর নির্ভর করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম কিছু দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে খুব কঠিন অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশে যে পর পর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে, এ কারণেও তারা ক্ষুব্ধ। অথচ হাসিনা বলছেন, বিদেশিরা যে যাই বলুক না কেন আমি বিচার করব এবং মৃত্যুদণ্ড দিতেই থাকব। অর্থাৎ তার কথায় এমন মনে হচ্ছে যে, তিনিই বিচারক এবং তিনি মৃত্যুদণ্ড দিতেই থাকবেন। আর এর মাধ্যমে তিনি এদেশে হাজার হাজার বিধবা সৃষ্টি করছেন।
তবে এটি আজকের যুগে সম্ভব না। কারণ তুর্কিসহ ১২টি মুসলিম দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোট ১৪০টি দেশে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা হয়েছে। এসব কারণে ইইউ বাংলাদেশের প্রতি খুবই বিরক্ত। কারণ তারা মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। তাছাড়া আমেরিকাও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ওপর বিরক্ত। ফলে সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে সরকার বেকায়দায় আছে; নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। আর এজন্যেই প্রধানমন্ত্রী ইংল্যান্ডে গেলেন না। তার সফর বাতিল করা হয়েছে।
এর আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সঙ্গে দেখা করে তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, ক্যামেরন বলেছেন- পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি কখনও এমনটি বলেননি। আমি ইংল্যান্ডে বহু বছর ছিলাম এবং এখনও সেখানকার রাজনীতি আমি ফলো করি। কিন্তু আমি কখনও দেখিনি কোনো ভিজিটিং প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার পর দিনই একটা স্টেটমেন্ট আসে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরের পর এরকমই একটি স্টেটমেন্ট এলো যে, আমরা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই। এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই বিব্রত আছেন।
শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ সরকার এটি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। সুনির্দিষ্টভাবে আরো একটি জায়গায় তিনি আটকে গেছেন। লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে শেখ হাসিনার পুত্র সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ তিনি করেছেন। আর সেই অভিযোগের চিত্র মিডিয়াতে চলে এসেছে। আর জয় সম্পর্কে যেসব কথা লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, তার উত্তর শেখ হাসিনা অর্থাৎ জয়ের মা এখনও পর্যন্ত দিতে পারেননি।
কেন এই অভিযোগগুলো করা হলো, এটা সত্য নাকি মিথ্যা সে ব্যাপারে উনি কিছু বলছেন না। উনি কেবল লতিফ সিদ্দিকীর ধর্মের দিক এবং হজের দিকটা নিয়ে কথা বলেছেন। এটার ফলে একটা ধারণা করা যেতে পারে যে, আমেরিকা এবং ইইউসহ অন্যান্যরা বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তারা পেয়েছে। আর সেটা শেখ হাসিনার সরকারের জন্য শুভ সংবাদ নয়।
আর সেজন্যেই কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত থাকলে শেখ হাসিনার জন্য তার সরকারকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তারপরও কূটনীতিকরা বলবে যে হ্যাঁ আমরা তোমাদের দেশে দুর্নীতির চিত্র দেখছি; অনিয়ম দেখছি। এরপরও বলা হচ্ছে মানুষ আওয়ামী লীগকে চায়। বিএনপিকে প্রমাণ করতে হবে যে, দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে চায় না। জনসমর্থন তাদের পক্ষে। আর সেজন্যেই খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করছেন। কিশোরগঞ্জে জনসভা করেছেন। অন্যান্য জায়গায়ও তিনি মিটিং করেছেন।
বিএনপির জনসভায় এই যে জনসমর্থন বিদেশিরা এবং হাসিনা দেখছে- এতেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে জনসমর্থন বিএনপির পক্ষে রয়েছে। ফলে জনসমর্থন যেমন দরকার একইসঙ্গে কূটনৈতিক সমর্থনও দরকার।
তারপরও হার্ডডোজ যদি প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে আমি বলব খালেদা জিয়া অত্যন্ত সাহসী, তিনি শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাননি। শেখ হাসিনা সাহসের বড়াই করেন কিন্তু সময়মতো পালিয়ে যান। যেমন ১/১১ পর তিনি দু'বার পালিয়ে গিয়েছিলেন দেশ থেকে। তারপর বিদেশিদের কাছ থেকে গ্যারান্টি নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
তারপর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারাই তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। অন্যদিকে খালেদা অত্যন্ত সহসিকতার সঙ্গে বর্তমান আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। একই সঙ্গে আমি বলে রাখছি, আমি কিন্তু বিএনপির কোনো সদস্য নই।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের একটা বিশেষ ভূমিকা ও প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশের কূটনীতিকদের এক সম্মেলনে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আদর্শ নয়। তিনি চান বাংলাদেশে আদর্শ গণতন্ত্র ফিরে আসুক। ভারতীয় কূটনীতিবিদের এ বক্তব্যকে কিভাবে দেখবেন?
শফিক রেহমান: ভারত আমাদের শুধু তিন দিক থেকে ঘিরে রাখেনি সাড়ে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে বলে সাবেক ভারতীয় এক হাইকমিশনার দেব মুখার্জী আমাকে বলেছিলেন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। আমাকে তিনি বললেন, শফিক তোমাদের তিন দিক থেকে নয় সাড়ে তিন দিক থেকে আমরা ঘিরে রেখেছি। তার মানে জিজ্ঞেস করায় তিনি আমাকে বললেন, বঙ্গোপসাগরেও তোমাদেরকে আমরা ঘিরে রেখেছি। ফলে যে দেশটি আমাদের সাড়ে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব থাকতেই হবে। তবে তার মানে এই নয় যে তাদের পদানত হয়ে থাকতে হবে বা তারা আমাদেরকে পদানত রাখতে পারবে। ভারত যদি আমাদেরকে কাশ্মীর ভাবে তাহলে তারা ভুল করবে।
তবে কাশ্মীরের মুসলমানদেরকে তারা পদানত করে রাখতে পেরেছে এর কারণ হচ্ছে তারা স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। ফলে ভারতের জন্য সংকট হবে যদি তারা কাশ্মীরের কথা ভেবে অথবা হায়দ্রাবাদের কথা ভেবে বাংলাদেশকে পদানত করে রাখতে চায়। একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ব্রিটিশ শাসনের সময় যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তার অধিকাংশই কিন্তু বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে হয়েছে। সূর্যসেন যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন তিনিও বাংলাদেশের সন্তান। বলতে গেলে প্রায় সব আন্দোলন বাংলাদেশ থেকেই হয়েছে। ফলে আবারও যদি তীব্র আন্দোলন হয় তাহলে সেটা ভারতের জন্য ভালো হবে না।
এ প্রসঙ্গে আমি বলব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে যে মিটিং হয়েছে সেখানে অনেককে সাবেক বলা হলেও পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীতে সাবেক বলা যাবে না। কারণ আমি যতটুকু জানি পিআর চক্রবর্তী দিল্লিতে বাংলাদেশ ডেস্কের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। আর তিনি যদি বলেন- বাংলাদেশে একটি ভালো নির্বাচন হওয়া উচিত এবং তা হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তাহলে সেটা আমাদের জন্যও আশার কথা। আর একথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যাবে যে, ভারতের সুমতি হয়েছে অথবা বলতে হবে রামের সুমতি হয়েছে।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী সম্পর্কে আমি আরো দু'একটা কথা বলতে চাই। তার নামের আদ্যক্ষর হচ্ছে পিআর অর্থাৎ পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ঢাকায় হাইকমিশনার থাকা অবস্থায় কোনো দিনও তিনি বেগম খালেদা জিয়ার ঈদ বা অন্য কোনো পার্টিতে আসেননি। আমি ওইসব পার্টির অন্যতম সংগঠক হিসেবে বিষয়টি জানি। তারপর তিনি যখন থাইল্যান্ডে বদলি হয়ে যান তখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আর সেদিন আমি তাকে ধরলাম এবং হাসতে হাসতে বললাম, আপনি আপনার নামের প্রতি সুবিচার করেননি।
তিনি অবাক হয়ে গেলেন এবং এর অর্থ জানতে চাইলেন। তখন আমি তাকে বললাম আপনার নামের আদ্যক্ষর হচ্ছে পিআর, মানে পাবলিক রিলেশন্স। অথচ আপনি জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশন্স করেননি। আপনি কেবল একটি দলের সঙ্গে রিলেশন্স করেছেন। অথচ ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে উচিত ছিল দুটি দলের সঙ্গেই পিআর তৈরি করা। অথচ আপনি সেটা করেননি এবং সে বিষয়টি সংশোধন করার জন্য শেষবারের মতো আপনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি আমার কথার উত্তর দিতে পারেননি।
ফলে আমাদেরকে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এদেশের বুদ্ধিজীবী এবং কূটনীতিকরা ভারতের কথা এলেই চুপ হয়ে যায়। ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যে নতজানু হয়ে যায় সেটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। এর কারণ আমি খুঁজে পাই না। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিদেশে বহু বছর কাজ করেছি। ভারতের সঙ্গে কম্পিটিশন করে জিতেছি অনেক সময় তাদের চেয়ে ওপরে উঠেছি।
আমাদের দেশের মানুষদেরকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে দৃষ্টি দিতে হবে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকার দিকে। ফলে ফরগেট দি ইন্ডিয়ান! তারা ভালো হোক মন্দ হোক তাদের মতোই আছে; তাদের মতোই তারা তাদের রাষ্ট্র চালাবে। তাদের কাছে নতজানু হওয়ার বিষয়টি আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর মনে হয়। এই ভারতীয়দের আনা হচ্ছে। কেন তাদেরকে আনা হচ্ছে? কেন ইংল্যান্ড থেকে বা ইউরোপ আমেরিকার অন্যান্য দেশ থেকে লোকদের আনা হচ্ছে না। তারা আনতে পারবে না। এখানে ভারতপ্রীতি এবং ভারত ফোবিয়া দুটোকেই আমি মারাত্মক খারাপ বিষয় বলে মনে করি।
তবে হ্যাঁ একথাও সত্যি যে, ভারত আমাদের প্রতিবেশি বড় রাষ্ট্র। আমরা প্রতিবেশির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে চাই। ইউরোপে আমরা দেখেছি ফ্রান্স এবং জার্মানি বহু বছর লড়াই করেছে। আবার তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আমরাও ভারতের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতে চাই। তবে লিড নিতে হবে ভারতকে। কারণ তারা বড় রাষ্ট্র। তাদেরকে আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। আমরা তো তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে প্রস্তুত আছি; আমরা তো তাদের সঙ্গে লড়াই করে কখনও জিততে পারব না। ফলে আমরা কেন তাদের সঙ্গে লড়াই করব; এ বিষয়টি ভারতকে বুঝতে হবে।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জোটের আকার বাড়তে বাড়তে এখন ২০ দলে পৌঁছেছে। তারপরও আন্দোলনের বড় কোনো কর্মসূচি নেই। সংকটটা কাদের- বিএনপির নাকি জোটের?
শফিক রেহমান: দেখুন, এটি হচ্ছে আওয়ামী প্রচারণা। মিডিয়ার প্রচারণা। আর আপনারাও আওয়ামী সেই প্রচারণার মধ্যে পড়ে গেছেন। বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তাদের কোনো পত্রিকা নেই, রেডিও নেই, টেলিভিশন নেই; কিচ্ছু নেই। তাদের কেবল আছে জনসমর্থন। আর আওয়ামী সরকারের আছে মিডিয়া সমর্থন, আছে প্রোপাগাণ্ডা।
আমি বাংলাদেশে ছোটবেলা থেকে আছি। ১৯৪৫ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন আমি দেখে আসছি। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রায় সব আন্দোলনই আমি দেখেছি এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু ২০১৩ সালে যে আন্দোলন দেখেছি এমন দুর্বার আন্দোলন আর কখনও দেখিনি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে এর আগে আওয়ামী লীগ বলত তাদের কাছ থেকে বিএনপির আন্দোলন শিখতে হবে। তবে এখন আর তারা সেটা বলে না। কেননা বিএনপির আন্দোলন কিরকম হতে পারে সেটা আওয়ামী লীগ খুব ভালোভাবে জেনে গেছে।
সেই আন্দোলনের সময় কয়েক হাজার গাছ কাটা পড়েছে, অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীরা রেললাইন উপড়ে ফেলেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন শহর দখল করে নিয়েছিল। এমনটি ১৯৭১ সালেও হয়নি। এই সত্যটাকে আজকে মানতে হবে। আমি দেশজুড়ে ১৯৭১ সালেও এতবড় আন্দোলন দেখিনি। আমি ৭১ দেখেছি এবং ২০১৩ দেখেছি।
তবে সেই দুর্বার আন্দোলনেও সরকার পড়েনি। সরকার পড়েনি এই অর্থে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে না বের হয়ে গেলে সরকার পতন বলা যাবে না। তিনি যেদিন গণভবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলবেন, আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিলাম। অথচ সেটা তিনি করেননি। তিনি বসে আছেন এই ভরসায় যে কেউ না কেউ তাকে উদ্ধার করবে।
তবে আমি একথা বলব, আন্দোলন সার্বিকভাবে হয়েছে সারাদেশে। তবে ঢাকাতে সরকারের পতন হয়নি। তাছাড়া আমি আরো একটা কথা বলে রাখতে চাই সেটি হচ্ছে- বিএনপি কোনো সংগ্রামী, বিপ্লবী বা ক্যাডারভিত্তিক দল নয়। রাস্তায় নেমে মারামারি কাটকাটি করবে এটি বিএনপির কাছ থেকে আশা করাও তো অন্যায়।
বিএনপি সম্পর্কে আমি আরো বলতে চাই, খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে কোনো আন্দোলনে যেন কেউ মারা না যায়। তার কারণ হচ্ছে এর আগে এরশাদের আমলে মিছিলে আন্দোলনে বাস উঠিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। মিলনকে হত্যা করা হলো। অথচ খালেদা জিয়া সেটা করতে দেননি। তিনি মানুষের মৃত্যু চাননি। অথচ এখন আন্দোলনের সময় বলে দেয়া হয় দেখামাত্র গুলি কর, দেখামাত্র গ্রেপ্তার কর। তো এই অবস্থার মধ্যে আন্দোলন করতে গেলে সহিংস হতে হবে। বিএনপি সহিংস আন্দোলন চায় না। বিএনপি একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দল।
আওয়ামী লীগ যদি চায় এবং অন্যকে বাধ্য করে তাহলে তখন আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি সহিংস দল তৈরি হবে। আর তখন আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি নিজেও হয়তো সেই আন্দোলনে যোগ দেব। তবে সরকারের এমনটি করা কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না।ওরা অন্যায় করছে। তাদেরকে গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে এবং গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন করতে হবে। মানুষের আশা করা অন্যায় যে বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো সহিংস এবং বদমায়েশি করবে। এটা কখনও হবে না।
প্রশ্ন: সরকারবিরোধী আন্দোলনে আরো বড় প্লাটফর্ম গঠনের তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি, যে প্লাটফর্ম সরকারের হার্ডলাইন অবস্থানকে মোকাবেলায় মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। এমন কার্যকর প্লাটফর্ম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটা দেখছেন আপনি?
শফিক রেহমান: সরকারবিরোধী বড় প্লাটফর্ম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। যে কোনো গণতন্ত্রমনা দল বা ব্যক্তির উচিত হবে যদি বড় কোনো প্লাটফর্ম হয় তাহলে তাতে যোগ দেয়া। কেননা বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যুক্তফ্রন্ট থেকে শুরু করে ৯০-এ এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত বড় প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে।
যখন সবগুলো দল ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয় এবং একসঙ্গে আন্দোলন করে তখন তারা জয়লাভ করে। সেই হিসেবে যদি একটা বড় ফ্রন্ট হয় অর্থাৎ বিশ দল থেকে যদি ৩০ দল হয় তাহলে সফলতা আসবে খুব সহজেই। তবে বর্তমানে অনেক দল মানে একজনের একটি সাইনবোর্ড দল; তারপরও তাদের একটা অবদান থাকে। তারা কথা বলতে পারে; চিন্তাধারা প্রকাশ করতে পারে; এবং ইনপুট দিতে পারে। ফলে সবাই মিলে বিএনপির সঙ্গে যদি আন্দোলন করে সেটা বিএনপির জন্যও ভালো হবে এবং অন্য সবার জন্যও ভালো হবে। আর তখন দেশে একটা গণতন্ত্র ফিরে আসবে।
তবে সবচেয়ে ভালো হয় আওয়ামী লীগ যদি এটা বুঝতে সক্ষম হয় যে মারামারি কাটাকাটি করে কোনো লাভ হবে না, বিদেশিদের চাপ আছে এবং দেশে একটা বড় প্লাটফর্ম হয়েছে ফলে যে কোনো মুহূর্তে বড় আন্দোলন হতে পারে। হয়তো আওয়ামী লীগের এবং শেখ হাসিনার এমন একটা সুমতি হতে পারে যে আমি তোমাদের নির্বাচন দিলাম এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন হবে। যেখানে তারা এমপি থেকে হাস্যকর নির্বাচন করার বিষয়টি আর রিপিট করবেন না। তারা যদি তাদের ভুল এবং গোয়ার্তুমি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তাহলে দেশের জন্য ভালো হবে।
তবে বিএনপি যে কোনোভাবেই হোক জিতবে কারণ মানুষ তাদের পক্ষে। তবে বড় কোনো প্লাটফর্ম হলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে কথা হচ্ছে সেটি খুব দ্রুত সম্ভব হবে এবং ক্ষমতায় ফিরে আসাটা সহজ হবে। একইসঙ্গে হতাহতের পরিমাণ কম হবে। আর আমরা সেটাই চাই। বিভিন্ন আন্দোলনে এদেশে অনেকে বিধবা হয়েছে, অনেকে এতিম হয়েছে। আমরা আর রক্তপাত দেখতে চাই না।
http://bangla.irib.ir/2010-04-
http://www.amardeshonline.com/
__._,_.___
No comments:
Post a Comment