একটি বিশেষ শক্তির কাছে আমরা নিজেদের
আসফউদ্দৌলাহ্: জিডিপির উর্ধগতি আর রিজার্ভ বাড়লেই তো হবে না। এগুলো তো সোস্যাল ইনডিকেটর নয়। পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা দেখতে হবে। অতীতকে যখন বর্তমানের তুলনায় বেশি সমৃদ্ধ ও উন্নত মনে হবে, তখন বুঝতে হবে আগামীটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমরা ক্রমাগত একটা গভীর গর্তের দিকে ধাবিত হচ্ছি। #
সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করে দিয়েছি
- মোহাম্মদ আসফউদ্দৌলাহ্
সাবেক সচিব মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলাহ্। তাঁর আরো পরিচয় তিনি একাধারে সঙ্গীত শিল্পী, কবি, টেলিভিশন টকশো’র আলোচক। এছাড়াও তিনি চলমান অস্থির-অসুস্থ রাজনীতির একজন সাহসী সমালোচক। এ কারণে ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ে অনেক ক্ষতির শিকারও হয়েছেন এই জ্যেষ্ঠ প্রবীণ নাগরিক। কাছ থেকে দেখা রাষ্ট্র- সরকার- রাজনীতি এবং চাকরিজীবনের অনেক অভিজ্ঞতার কথা প্রোবের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন আনোয়ার পারভেজ হালিম।
কেমন চলছে দেশ ও সরকার
দেশের মানুষ কেমন আছে এবং সরকার কেমন চালাচ্ছে দেশ-এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলাহ্’র মূল্যায়ন হচ্ছে- কোন অর্থেই দেশের মানুষ ভাল নেই। দেশের মানুষ নিরাপত্তার সঙ্গে সুখে আছে কিনা, মানুষ দেশে থাকতে চায় কিনা। কেন সাড়ে তিন হাজার লোক মালয়েশিয়ায় গিয়ে বসতি গড়েছে, এসব প্রশ্নের মাঝেই উত্তর নিহিত রয়েছে। অনেকে আবার বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়েও বসবাস করছেন। সেখানেও তারা কষ্টে আছেন, তবে তারা অশান্তি কিংবা নিরাপত্তাহীনতায় নেই। এখানে তো সবকিছুতে অশান্তি। কেন ক্ষমতায় আকঁড়ে থাকতে হবে!
অশান্তির কারণটা কী? কারণ দুটো নয়-একটাই, আমাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। যিনিই ক্ষমতায় যান, তিনি ক্ষমতায় ছাড়তে চান না।
‘দেশ তো উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে’-সরকারের এই দাবি সম্পর্কে সাবেক আমলা আসাফউদ্দৌলাহ বলেন- আমি নিজে দীর্ঘসময় প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য ছিলাম। সুতরাং উন্নয়নের যেসব তথ্য বলা হচ্ছে এর কোন ফিগারই কারেক্ট নয়। সরকার প্রদত্ত কোন পরিসংখ্যানই সঠিক নয়। এগুলো হুকুম করে বলে দেয়া হয়। ধরুন, অর্থমন্ত্রী বলে দিলেন- আমাদের ৬.২ উন্নয়ন হবে। ব্যাস, পরিসংখ্যান বিভাগ লেগে গেল এটাকে ৬.২ বানাতে। কিন্তু আপনার- আমার কারো জীবনের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক আছে!
যেহেতু বিদ্যমান গণতন্ত্রে সহিংসতা বেশি, তাই গণতন্ত্রের পরিবর্তে উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, নেতা, সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মুখে আজকাল এমন কথাও শোনা যায়। কিন্তু এ ধারণার সঙ্গে একমত নন আসফউদ্দৌলাহ্। তিনি বলেন, আপনাদের ধারনা অনুযায়ী এ রকম উন্নয়ন চলতে থাকলে দেশের অস্তিত্বই থাকবে না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কতগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছি।
তিনি বলেন, এখানে কোন প্রতিবাদ নেই। সীমান্তে প্রতিদিন ১টা/২টা লাশ পড়ছে। কখনোও ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে বাংলাদেশের ফরেন অফিসকে বলতে শুনেছেন যে, বারবার আমরা নিষেধ করেছি- তোমরা এগ্রিও করেছো, তারপরও এটা করে যাচ্ছো কেন। ডাকবার সাহস নেই। এ কোন স্বাধীনতা!
তিনি বলেন, এখানে কোন প্রতিবাদ নেই। সীমান্তে প্রতিদিন ১টা/২টা লাশ পড়ছে। কখনোও ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে বাংলাদেশের ফরেন অফিসকে বলতে শুনেছেন যে, বারবার আমরা নিষেধ করেছি- তোমরা এগ্রিও করেছো, তারপরও এটা করে যাচ্ছো কেন। ডাকবার সাহস নেই। এ কোন স্বাধীনতা!
আসফউদ্দৌলাহ্ বলেন, আমি নিরাপত্তার সঙ্গে শান্তিতে থাকতে চাই। আমি যেন এ দেশের জন্য মরতে পারি। এ দেশের মঙ্গলে যেন হাসতে পারি। দেশের কোন ভাল হলে যেন আমারও ভাল লাগে। দেশের কোন ক্ষতি হলে যেন আমারও কষ্ট লাগে, এই-ই তো দেশপ্রেম, নাকি! সেটা তো হচ্ছে না। এখন আর কারো মধ্যে দেশ প্রেম দেখি না। আমার মধ্যে যদি দুর্নীতি থাকে তাহলে তো দেশ প্রেম হয় না।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন
৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দেয়নি, অথচ পার্লামেন্ট হয়েছে, এর কোন জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতা তো ভোটারদের কাছে সংরক্ষিত থাকে। তারা তো ভোট দিতে আসেনি। আমি নিজেও তো কাউক ভোট দেইনি। আমার এমপি কে, তাও আমি জানি না।
দেশটা কি এভাবেই চলতে থাকবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আসফউদ্দৌলাহÑ এমন সংকটের মধ্যে কোন দেশ চলতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশ চলছে এবং এভাবেই চলতে থাকবে।
কিন্ত জনগণকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র আমলা আর মিলিটারিনির্ভর হয়ে খুব বেশিদিন কী চলা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে আসফউদ্দৌলাহ্ বলেন, জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করে শুধুমাত্র এদের উপর ভরসা করবে তো চলবে না। আপনি কনসেপ্টটা লক্ষ্য করুন- ‘আমরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছি। আমরা ক্ষমতায়। আমাদের হাতে ক্ষমতা।’ এই শব্দগুলো পৃথিবীর কোন গণতন্ত্রে ব্যবহৃত হয়না। ওবামা কখনো ভুল করেও বলেন না যে, ‘আমি ক্ষমতায়’। ক্যামেরুনের এই সাহস নেই যে, বলবে ‘আমি ক্ষমতা পেয়ে ১০ ডাউনিং ষ্ট্রিটে এসেছি। উই আর ইন পাওয়ার।’ তারা এগুলোকে অসভ্য শব্দ মনে করে। মনে রাখবেন, জনগণ কিন্তু রাজনীতিকদের ক্ষমতা দেয় এবং ক্ষমতায় বসায়, জনগণের কল্যানের জন্য। জনগণকে শান্তিতে রাখার জন্য। এ জন্য ভোট দেয়। তাহলে বলুন, বর্তমান সরকার, কিংবা এর আগের সরকার, কিংবা তার আগের সরকার কোন কাজটা করেছে, যাতে মানুষের দুর্ভোগ কমেছে।
তিনি বলেন, সরকার জনগণকে উপেক্ষা করে সংবিধান রক্ষার নামে একটা নির্বাচন করল। ভাল কথা, আপনি তিন মাসের মধ্যে আরেকটা নির্বাচন দেন। তাতো দিলেন না। আপনি জনগণকে ভয় পাচ্ছেন কেন? জনগণকে ভয় পেলে তো আপনার ক্ষমতায় থাকারই অধিকার নেই। আপনি ঠিকই জনগণকে ভয় পান। যে কারণে আপনি জনমত যাচাইয়ের রেফারেন্ডাম পর্যন্ত সংবিধান থেকে উঠিয়ে দিয়েছেন। এই সরকার এটা করেছে। আপনি গনতন্ত্রের কথা বলছেন! পৃৃথিবীর কোথাও এমন কোন গণতন্ত্র খুঁজে পাবেন না, যেখানে রেফারেন্ডাম নেই।
আসফউদ্দৌলাহ্ বলেন, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ থাকবে কি থাকবে না- সেটা আপনি বা আমি সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক নেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। তারা চায় কীনা, তাদের জনমত যাচাই পর্যন্ত করা হয়নি।
আ. লীগ ও বিএনপির মধ্যে গুনগত পার্থক্য নেই
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির মধ্যে কোন গুনগত পার্থক্য নেই বলে মনে করেন তিনি এবং নিকট ভবিষ্যতে এর কোন পরবর্তনও আসবে বলে মনে করেন না। আসফউদ্দৌলাহ বলেন, এখন নাকি একটা মিটিং করতে ৬/৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়। আমাদের সময় একটা মাইকের ভাড়া ছিল মাত্র তিনশো টাকা। এখন রাজনীতি করতে গেলে হাজার হাজার কোটি টাকা লাগে। আপনি কত টাকা চাঁদা তুলবেন। কোন ভদ্র লোকের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। রাজনীতি করতে এখন যে পরিমাণ অর্থ ও সঙ্গতি দরকার কোন থার্ড পার্টির সেই সঙ্গতি নেই। একজন ভদ্রলোকদের কত টাকাইবা থাকতে পারে। আজকাল শোনা যায়, অমুক রাজনীতিকের পূর্বপুরুষেরা জমিদার ছিল, অমুকের শ্বশুর ছিলেন রাজা, এগুলো সব গপ্পো, সত্য নয়। সুতরাং রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তন আসবে কিভাবে! তবে এই দুটি দলের মধ্যে একটি ক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষণীয়। সেটা হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। ধর্মীয় মূল্যবোধের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে।
মানচিত্রের হিসেব-নিকেশ
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে তৃতীয় কোন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না ওঠা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আসফউদ্দেীলাহ্র ব্যাখ্যা হচ্ছে- এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। পাকিস্তান থেকে আমরা অনেক কষ্টে একাত্তরে মুক্ত হয়েছি। স্বাধীন হয়েছি। আসলে স্বাধীনতা কী পেয়েছি, মুক্ত কী হয়েছি? আমি তরুণ বয়সে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ পোস্টার লিখেছি। সেই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। কী অদ্ভুত এই দেশটা। আমাদের মানচিত্রটা এরকম হলো কেন? মানচিত্র তো এরকম হওয়ার কথা ছিল না। বেঙ্গল ওয়াজ আওয়ার প্রভিন্স। আসাম বাদ দিলেও বেঙ্গলে তো মেজরিটি জনগণ মুসলিম। মেজরিটির ভিত্তিতে প্রভিন্স এ্যালোকেশন হয়েছে। তাহলে বেঙ্গল কেন তখন পাকিস্তানকে দেওয়া হলো না। দেখুন, আমাদের প্রতিটি নদীটির উৎস ভারতে। এরকম পার্টিশন দুনিয়ার অন্য কোথাও হয়নি। এই অন্যায়টা তখন থেকে চলে আসছে।
আমি তো মনে করি , পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের বর্তমানের যে ভৌগলিক সীমানা- এটা কিছুতেই থাকবে না। পরিবর্তন হবে। কীভাবে কোন দিকে হবে- তা আগে থেকে বলা যায় না। আমার ধারণা, বর্তমানের সীমানাই চ’ড়ান্ত নয়। আরো নতুন নতুন সীমানা দেখা যাবে।
কোথায় বাক স্বাধীনতা?
‘আসলে স্বাধীনতা কী পেয়েছি’ এ কথা কেন বললেন, জানতে চাইলে সাবেক এই সচিব পুনরায় বলেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে হৃদয়ে যে আনন্দ থাকার কথা- ১৭ ডিসেম্বর থেকেই তো সেই আনন্দ নেই। আমাদের সমস্ত আনন্দ ফুলকিবাজির মতো ফুস করে জলে উঠে আবার হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাতকোটি জনগণের বহুদিনের সংগ্রামের ফসল। সংগ্রাম স্বার্থক হয়েছিল। কৃষক, শ্রমিক, রিকসাঅলা ,শিক্ষক, ছাত্র , সরকারি- বেসরকারি চাকুরে এরাইতো যুদ্ধে জীবন দিয়েছে। এরা কেউ কি মুক্তিযুদ্ধের খেতাব পেয়েছে! আওয়ামী লীগ বলল, তারাই মুক্তিযুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ নাকি তাদের দান।
আমি মনে করি, নেতৃত্বের ব্যর্থতার জন্যই আজকের এই করুন পরিণতি। এ কথাগুলো আমি যেমন বলতে ভয় পাই- তেমনি আপনি ছাপতেও ভয় পাবেন।
আমি মনে করি, নেতৃত্বের ব্যর্থতার জন্যই আজকের এই করুন পরিণতি। এ কথাগুলো আমি যেমন বলতে ভয় পাই- তেমনি আপনি ছাপতেও ভয় পাবেন।
সংবিধানে বাক-স্বাধীনতার কথা বলা হলেও কোথায় বাক স্বাধীনতা- এটা তো টোটাল ডিক্টেটরশীপ।
আপনি তো টেলিভিশনের টকশোতে সরকারের অনেক সমালোচনা করতে পারছেন, কোন অসুবিধা কী হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আসফউদ্দৌলাহ বলেন, আগে টকশোতে যেতাম- এখন আর যাইনা। তার কারণ, টেলিভিশনে কথা বলার কারণে, আমার গত ৩৫ বছরের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন চেয়েছে। ৩৫ বছরের রিটার্ন হয় নাকি, তিন বছরের বেশি রিটার্ন হয় না। তারপর আমার মেয়ের উপর চাপ এসেছে। সে সরকারের ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ছিল। আমার কারণে তাকে বলা বলা হলো- এখানে তোমার চাকরি করা অসুবিধা হবে। সে বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আমার ছেলে একটি কোম্পানির সিইও পদে ছিলো। ওই কোম্পানির মালিককে চাপ দেওয়া হলো, যাতে তাকে বরখাস্ত করা হয়। তারা সরকারের নির্দেশ পালন করেছে। আমার কথা বলার অপরাধে ছেলে ও মেয়ের চাকরি গেল। দুটো ঘটনাই হাসিনা সরকারের আমলে ঘটেছে। আমার অপরাধ হলে আমাকে শাস্তি দাও। সন্তানের ক্ষতি মেনে নেয়া কষ্টকর।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ-দু’পক্ষই জিয়া ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অযাচিত অশালীন শব্দের প্রয়োগে কথা বলছে- যা রাজনীতিতে কেবল উত্তাপই ছড়ায়নি, বরং দেশ পড়েছে এক অনিশ্চয়তার কবলে। এ প্রসঙ্গে আসফউদ্দৌলাহর মন্তব্য- এ ধরনের রাজনীতি তো আগে কখনো ছিল না। এটা বাঙালির দুর্ভাগ্য। রাজনীতিতে যেসব শব্দ ব্যবহার হচ্ছে- তা সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। কোন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে শালীনতা বজায় রেখে উক্তি করা শোভনীয়।
বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে
বঙ্গবন্ধু আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। মাত্রাতিরিক্ত। আমি তখন পানি সম্পদ সচিব। ১৯৭৩ সালের ঈদের দিনে আমি তাঁকে বলেছিলাম, আপনার এই নেতৃত্বটা কেন যেন মনে হচ্ছে সর্বগ্রাসী। শুনে খুবই অফেন্ডেড (মনোকষ্ট) হয়েছিলেন। বললেন, ‘তুই আমাকে সর্বগ্রাসী বললি!’
আমি তখন বলেছিলাম, আপনি কখনোই জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন না যে, মাওলানা ভাসানী নামে আরেকজন খুব বড় মাপের পাবলিক লিডার ছিলেন। তিনিও বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। আপনি কখনোই তাঁর নাম নেন না। কলকাতায় আমরা দেখেছি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি আপনাকে হাতে ধরে রাজনীতি শিখিয়েছেন। তাঁর কথা আপনি একবারও মুখে আনেন না। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে আপনি ভুলে গেছেন। অথচ এমন কোন বাঙালি পরিবার নেই যে, ফজলুল হক তাদের উপকার করেননি। এমন কোন মুসলিম পরিবার নেই- যে পরিবারের কোন না কোন সদস্য তাঁর দ্বারা উপকৃত হননি- এই বাংলায়। তাঁকে ‘শেরেবাংলা’ করতে কোন আইন করতে হয়নি। মানুষ স্বতঃস্ফ’র্তভাবে তাঁকে ‘শেরে বাংলা’ বলেছে। আমার এ মন্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেন নি। কিন্তু চুপসে গিয়েছিলেন।
প্রশাসনে দলীয়করণ ও মেধার শূন্যতা
আপনি তো সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ আমলা ছিলেন। প্রশাসনকে দলীয়করণের বিষয়টি কিভাবে শুরু হলো, এ প্রশ্নের জবাবে আসফউদ্দৌলাহ্ বলেন, ক্ষমতাসীনরা সরকারি কর্মকর্তাদের পলিটিশিয়ান বানিয়ে ফেলছে। অথচ এক সময় এটা ছিলো না। আমরা চিন্তাও করতে পারিনি। আমরা প্রত্যেকে কাউকে না কাউকে ভোট দিয়ে থাকি। কিন্তু জোর গলায় বলতে পারি, আমাদের কোন সিদ্ধান্তে ব্যক্তি ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রভাব পড়েনি। মনে হতো এটা তো গুনাহ। আমি দেখেছি যে, আমার কলিগ একটি দলকে পছন্দ করে। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত দেখেছি একেবারে সেই দলের বিপক্ষে। জিজ্ঞেস করলে সে বলেতো- এটাইতো ঠিক সিদ্ধান্ত। আমি যখন বলতাম তুই তো ওই দল করিস। সে জবাবে বলতো -‘ভোট দেয়ার জন্য দল করি। সিদ্ধান্তের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।’ বলতে পারেন- আমাদের সময় কর্মকর্তাদের কাছে দলীয়করণ অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
আমলাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর একটাই কারণ, সিএসপি ক্যাডার উঠিয়ে দেয়া। পাকিস্তান আমলে সিএসপি ও ইপিসিএস- এই দুধরনের ক্যাডারভিত্তিক কর্মকর্তা ছিল। যেটাকে বলা হতো ইপিসিএস- এখন সেটা হচ্ছে বিসিএস। বাংলাদেশ আমলে সিএসপি তুলে দেয়া হয়। কেন জানতে চান? সিএসপিরা ছিল অধিকাংশই সে সময়কার অল থ্রো ফার্স্ট ক্লাশ পাওয়া অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। যে ছেলেটি ক্লাসে ফার্স্ট হতো সে সামনের বেঞ্চে বসে। আর যারা রাজনীতি করতো তারা তো ক্লাসে যেতো না। তারা কর্মী থেকে নেতা এবং নেতা থেকে মন্ত্রী হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটা কমপ্লেক্স দেখা দেয় যে, আমার ক্লাসের ফার্ষ্ট বয় আমার অধীনস্থ সেক্রেটারি। সে তো আমার কথা শুনবে না। মন্ত্রীদের মানবে না। এ অজুহাতে সিএসপি ক্যাডার বাদ দেয়া হল। আজকে প্রশাসনে যে মেধার শূন্যতা বিরাজ করছে তার কারণ ওটাই। ভবিষ্যতে প্রশাসন আরো মেধা শূন্য হয়ে পড়বে। দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য মেধাবী প্রশাসনেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।
বন্ধুত্ব মানে আত্মসমর্পন নয়
‘কেউ শত্রু নয়- সবাই বন্ধু’ -আমাদের রাষ্ট্র কি এই পররাষ্ট্রনীতিতে এখনও অটল আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে এই সাবেক সচিব বলেন, আমার তো মনে হয় একটি বিশেষ শক্তির কাছে আমরা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আত্মসমর্পন করে দিয়েছি। মনে রাখবেন বন্ধুত্ব হতে হবে সমতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে। সেটা যখন নয়- তখন তাকে বন্ধুত্ব বলা যাবে না, প্রভুত্ব বলা যায়। বন্ধুত্ব মানে তো আত্মসমর্পন নয়।
আমরা এখন পৃথিবীর সব শক্তিকে ছেড়ে দিয়ে একটি মাত্র শক্তির কোলে বসেছি। তাদের সমর্থনকে মনে করছি জনগণের সমর্থন। তাদের সমর্থনকেই মনে করছি- আমাকে অমর এবং অজেয় করে রাখবে।
আমরা এখন পৃথিবীর সব শক্তিকে ছেড়ে দিয়ে একটি মাত্র শক্তির কোলে বসেছি। তাদের সমর্থনকে মনে করছি জনগণের সমর্থন। তাদের সমর্থনকেই মনে করছি- আমাকে অমর এবং অজেয় করে রাখবে।
আগামী দিনগুলোতে মানে নিকট ভবিষ্যতে আপনার প্রত্যাশিত শান্তির কোন সম্ভাবনা কী দেখতে পান?
আসফউদ্দৌলাহ্: জিডিপির উর্ধগতি আর রিজার্ভ বাড়লেই তো হবে না। এগুলো তো সোস্যাল ইনডিকেটর নয়। পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা দেখতে হবে। অতীতকে যখন বর্তমানের তুলনায় বেশি সমৃদ্ধ ও উন্নত মনে হবে, তখন বুঝতে হবে আগামীটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমরা ক্রমাগত একটা গভীর গর্তের দিকে ধাবিত হচ্ছি। #
No comments:
Post a Comment