ভ্রান্তিবিলাস
দেশে এই প্রথম বামপন্থীরা অস্তিত্বের সংকটে৷ কারণ? শীর্ষ নেতৃত্বের অবিরত ভুল এবং সংশোধনে অনীহা৷ লিখছেন প্রসেনজিত্ বসু৷ শেষ পর্ব
পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-বিজেপি-র এই উত্থানকে যথাযথ ভাবে প্রতিরোধ করতে পারত একমাত্র নীতিনিষ্ঠ এবং প্রাণবন্ত একটি বামপন্থী শক্তি৷ কিন্ত্ত সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের এখনকার যা হাল, তাদের পক্ষে এই কাজ সম্ভবই নয়৷ সাধারণ মানুষের চোখে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর শীর্ষ নেতৃত্ব সমস্ত রকমের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে৷ এবং ঠিক এই কারণেই সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট কোনও আন্দোলন তো দূরের কথা, সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, টেট পরীক্ষার দুর্নীতি, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের বৃদ্ধি, ঊর্ধ্বমুখী মুদ্রাস্ফীতি, কৃষকদের দুরবস্থা, আদিবাসী, দলিত ও মুসলিমদের বঞ্চনা, এবং সর্বোপরি যুবসমাজের ক্রমবিলীয়মান কর্মসংস্থান ইত্যাদি ইস্যুতে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কোনও ঠিকঠাক প্রচার অভিযানও গড়ে তুলতে পারেনি৷ বিরোধী শক্তি হিসেবে বামফ্রন্টের এই ব্যর্থতা বিজেপি-র জন্য তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে কাজে লাগাবার পরিসর তৈরি করে দিয়েছে৷
আর ২০১৪-তে বামফ্রন্টের প্রচারের মুখ, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নিজের ব্যর্থতার জন্য অন্য সকলের উপর দোষ চাপিয়ে গোঁসা করেই বসে আছেন৷ তিনি শ্রমিক ও কৃষকদের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে যত না চিন্তিত, তার থেকে তাঁর বেশি দুশ্চিন্তা, কেন বড়ো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি এসইজেড-এর সুবিধা পেল না, তাই নিয়ে৷ ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্যও মূলত বিগত যুগের কিছু জীর্ণ ক্লিশেতে পূর্ণ৷ 'গুজরাট মডেল', হিন্দুত্ব এবং সামাজিক পুনর্বিন্যাসের যে জনমোহিনী মিশ্রণটি এ বারের নির্বাচনে আরএসএস-বিজেপি পেশ করেছে, তার কোনও সুচিন্তিত সমালোচনা তাঁর জবানে পাওয়া যায়নি৷ মনে রাখা দরকার, কিছু বছর আগেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বিতর্কের সময় তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মানুষের উদ্দেশে 'গুজরাট মডেল'-এর গুণাগুণ নিয়ে উপদেশ বর্ষণ করেছিলেন৷ বলেছিলেন এই মডেল-এ সরকার এবং বিরোধী- উভয়ই সমান শিল্প-বান্ধব৷ এখন মোদী-ব্র্যান্ড পুঁজিবাদ নিয়ে তাঁর ভণ্ড সমালোচনা কে-ই বা শুনবে?
একমাত্র একটি সময়ই তাঁকে প্রবল সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে, যখন কংগ্রেসকে সমর্থন করার প্রশ্ন এসেছে৷ আর তাঁকে সেই কাজে পূর্ণ সহায়তা করেছেন সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক এবং রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত আর এক পলিটব্যুরো-সতীর্থ৷ দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের গোটা পাঁচ বছরের শাসনকালে এক বারের জন্যও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে শোনা যায়নি কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের গগনচুম্বী দুর্নীতি এবং জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মুখর হতে৷ বরং ২০১২ সালে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দিল্লি থেকে আসা একটি ফোন সিপিআই(এম)-কে বাধ্য করেছিল দুই মাস আগে কোজিকোড পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত কংগ্রেস ও বিজেপি-র থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে একটি বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার রাজনৈতিক লাইনকে বিসর্জন দিয়ে কংগ্রেসের তত্কালীন অর্থমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থন জানাতে৷ সিপিআই(এম) নেতৃত্ব কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার কৌশল, যা ধোপে টেঁকেনি যখন তৃণমূল কংগ্রেসও সেই একই প্রার্থীর সমর্থনে ভোট দেয়৷
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল এ বারের লোকসভা নির্বাচনের আগে, যখন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সংবাদসংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে জানালেন ২০০৪ সালের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সিপিআই(এম) কংগ্রেস সরকারকে সমর্থন করবে৷ যখন বামফ্রন্টের অন্য শরিকরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাল,তখন তিনি সেটাই করলেন যা তিনি সব থেকে ভালো করে থাকেন৷ অর্থাত্, কথা ফিরিয়ে নিলেন৷ যেমন তিনি আগেও বহু বিবৃতির ক্ষেত্রে করেছেন৷ কিন্ত্ত এত দিনে সাধারণ মানুষ সার কথাটি বুঝে নিয়েছেন- কংগ্রেসের অপশাসন, দুর্নীতি এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বের কোনও মাথাব্যথা তো নেইই, তার উপর তাঁরা বাস্তবের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্যুত, তাই ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েও ভাবছেন ২০০৪ সালের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি হতে পারে৷ কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) নেতৃত্বের এই দোদুল্যমানতা এই রাজ্যে ভারতীয় জনতা পার্টির বাড়বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, যে রাজ্যে সাধারণ মানুষের একটি বড়ো অংশের কংগ্রেসের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরোধিতা করার ঐতিহ্য রয়েছে৷
বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও দলের রাজনৈতিক লাইন নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ানোর জন্য তাদের কর্তব্য কর্মটুকু করে গিয়েছে৷ ২০০৯ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও (এই 'তৃতীয় ফ্রন্ট' শব্দবন্ধটি এতটাই কুখ্যাতি লাভ করেছে যে খোদ বামপন্থী নেতৃত্বও এটি ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছেন), আবার চেষ্টা করা হল আরও একটি 'তৃতীয় ফ্রন্ট' গঠনের৷ যে মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সরকার মুজফ্ফরনগর দাঙ্গার সময় অতীব নঞর্থক ভূমিকা পালন করেছিল, এবং যে মুলায়ম সিংহ প্রথমে নিউক্লিয়ার চুক্তির ইস্যুতে এবং পরে খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে পর পর দু'বার বামপন্থীদের পথে বসিয়েছেন, ২০১৩ সালের অক্টোবরে বামপন্থীদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কনভেনশনে তাঁকেই দেওয়া হল কিনা রাজার পার্ট! আর ভারতীয় জনতা পার্টির ১৭ বছরের জোটসঙ্গী নীতীশ কুমার সহসা হয়ে উঠলেন ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল প্রতীক৷ শেষ পর্যন্ত তাঁদের কেউই বামপন্থীদের সঙ্গে কোনও তাত্পর্যপূর্ণ নির্বাচনী সমঝোতায় কোনও রকম আগ্রহ না দেখালেও, বামপন্থীরা তৃতীয় ফ্রন্টের এই বোঝা ঝেড়ে ফেলতে পারল না৷
অতএব, বামপন্থীদের, বিশেষত সিপিআই(এম)-এর সমস্যা অসংখ্য৷ কাজেই তাদের বালিতে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বুঝতে হবে ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম বার, সিপিআই(এম)-সহ ভারতের সব বামপন্থীরাই অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি৷ এই সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনও সহজ পথও নেই৷ সিপিআই(এম)-এর শীর্ষ নেতৃত্ব, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, যে ভাবে ব্যর্থ তা কোনও রকম সংশোধনের অযোগ্য৷ কোনও সদর্থক পরিবর্তন সম্ভবই নয় যদি না নতুন নেতৃত্বের নতুন ভাবনা নিয়ে মেহনতি মানুষের, বিশেষত যুবসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা যায়৷ তার সঙ্গে, বামপন্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত পথ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হওয়া জরুরি৷ এক দিকে, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সমঝোতা করে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও সামাজিক শোষণের বিরোধিতার পথকে বিসর্জন দিলে বামপন্থীদের অস্তিত্বের মূল কারণটাই আর থাকে না৷ আবার অন্য দিকে, বিশ শতকের ব্যর্থ সমাজতান্ত্রিক মডেলের অন্ধ অনুসরণ ক্ষয় এবং মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করবে৷ বিশেষ জোর দেওয়া দরকার বিদেশি মডেল অনুকরণ না করে ভারতীয় পরিস্থিতিতে বামপন্থী আন্দোলনকে নতুন করে গড়ে তোলার দিকে৷ মনে রাখা দরকার, বামপন্থীদের জন্য সন্ধিক্ষণ সমাগত৷ এবং মোদী সরকার কেন্দ্রে দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সময় আরও কমছে৷ (শেষ)
পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-বিজেপি-র এই উত্থানকে যথাযথ ভাবে প্রতিরোধ করতে পারত একমাত্র নীতিনিষ্ঠ এবং প্রাণবন্ত একটি বামপন্থী শক্তি৷ কিন্ত্ত সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের এখনকার যা হাল, তাদের পক্ষে এই কাজ সম্ভবই নয়৷ সাধারণ মানুষের চোখে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর শীর্ষ নেতৃত্ব সমস্ত রকমের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে৷ এবং ঠিক এই কারণেই সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট কোনও আন্দোলন তো দূরের কথা, সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, টেট পরীক্ষার দুর্নীতি, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের বৃদ্ধি, ঊর্ধ্বমুখী মুদ্রাস্ফীতি, কৃষকদের দুরবস্থা, আদিবাসী, দলিত ও মুসলিমদের বঞ্চনা, এবং সর্বোপরি যুবসমাজের ক্রমবিলীয়মান কর্মসংস্থান ইত্যাদি ইস্যুতে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কোনও ঠিকঠাক প্রচার অভিযানও গড়ে তুলতে পারেনি৷ বিরোধী শক্তি হিসেবে বামফ্রন্টের এই ব্যর্থতা বিজেপি-র জন্য তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে কাজে লাগাবার পরিসর তৈরি করে দিয়েছে৷
আর ২০১৪-তে বামফ্রন্টের প্রচারের মুখ, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নিজের ব্যর্থতার জন্য অন্য সকলের উপর দোষ চাপিয়ে গোঁসা করেই বসে আছেন৷ তিনি শ্রমিক ও কৃষকদের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে যত না চিন্তিত, তার থেকে তাঁর বেশি দুশ্চিন্তা, কেন বড়ো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি এসইজেড-এর সুবিধা পেল না, তাই নিয়ে৷ ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্যও মূলত বিগত যুগের কিছু জীর্ণ ক্লিশেতে পূর্ণ৷ 'গুজরাট মডেল', হিন্দুত্ব এবং সামাজিক পুনর্বিন্যাসের যে জনমোহিনী মিশ্রণটি এ বারের নির্বাচনে আরএসএস-বিজেপি পেশ করেছে, তার কোনও সুচিন্তিত সমালোচনা তাঁর জবানে পাওয়া যায়নি৷ মনে রাখা দরকার, কিছু বছর আগেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বিতর্কের সময় তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মানুষের উদ্দেশে 'গুজরাট মডেল'-এর গুণাগুণ নিয়ে উপদেশ বর্ষণ করেছিলেন৷ বলেছিলেন এই মডেল-এ সরকার এবং বিরোধী- উভয়ই সমান শিল্প-বান্ধব৷ এখন মোদী-ব্র্যান্ড পুঁজিবাদ নিয়ে তাঁর ভণ্ড সমালোচনা কে-ই বা শুনবে?
একমাত্র একটি সময়ই তাঁকে প্রবল সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে, যখন কংগ্রেসকে সমর্থন করার প্রশ্ন এসেছে৷ আর তাঁকে সেই কাজে পূর্ণ সহায়তা করেছেন সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক এবং রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত আর এক পলিটব্যুরো-সতীর্থ৷ দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের গোটা পাঁচ বছরের শাসনকালে এক বারের জন্যও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে শোনা যায়নি কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের গগনচুম্বী দুর্নীতি এবং জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মুখর হতে৷ বরং ২০১২ সালে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দিল্লি থেকে আসা একটি ফোন সিপিআই(এম)-কে বাধ্য করেছিল দুই মাস আগে কোজিকোড পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত কংগ্রেস ও বিজেপি-র থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে একটি বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার রাজনৈতিক লাইনকে বিসর্জন দিয়ে কংগ্রেসের তত্কালীন অর্থমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থন জানাতে৷ সিপিআই(এম) নেতৃত্ব কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার কৌশল, যা ধোপে টেঁকেনি যখন তৃণমূল কংগ্রেসও সেই একই প্রার্থীর সমর্থনে ভোট দেয়৷
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল এ বারের লোকসভা নির্বাচনের আগে, যখন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সংবাদসংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে জানালেন ২০০৪ সালের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সিপিআই(এম) কংগ্রেস সরকারকে সমর্থন করবে৷ যখন বামফ্রন্টের অন্য শরিকরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাল,তখন তিনি সেটাই করলেন যা তিনি সব থেকে ভালো করে থাকেন৷ অর্থাত্, কথা ফিরিয়ে নিলেন৷ যেমন তিনি আগেও বহু বিবৃতির ক্ষেত্রে করেছেন৷ কিন্ত্ত এত দিনে সাধারণ মানুষ সার কথাটি বুঝে নিয়েছেন- কংগ্রেসের অপশাসন, দুর্নীতি এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বের কোনও মাথাব্যথা তো নেইই, তার উপর তাঁরা বাস্তবের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্যুত, তাই ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েও ভাবছেন ২০০৪ সালের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি হতে পারে৷ কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) নেতৃত্বের এই দোদুল্যমানতা এই রাজ্যে ভারতীয় জনতা পার্টির বাড়বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, যে রাজ্যে সাধারণ মানুষের একটি বড়ো অংশের কংগ্রেসের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরোধিতা করার ঐতিহ্য রয়েছে৷
বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও দলের রাজনৈতিক লাইন নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ানোর জন্য তাদের কর্তব্য কর্মটুকু করে গিয়েছে৷ ২০০৯ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও (এই 'তৃতীয় ফ্রন্ট' শব্দবন্ধটি এতটাই কুখ্যাতি লাভ করেছে যে খোদ বামপন্থী নেতৃত্বও এটি ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছেন), আবার চেষ্টা করা হল আরও একটি 'তৃতীয় ফ্রন্ট' গঠনের৷ যে মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সরকার মুজফ্ফরনগর দাঙ্গার সময় অতীব নঞর্থক ভূমিকা পালন করেছিল, এবং যে মুলায়ম সিংহ প্রথমে নিউক্লিয়ার চুক্তির ইস্যুতে এবং পরে খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে পর পর দু'বার বামপন্থীদের পথে বসিয়েছেন, ২০১৩ সালের অক্টোবরে বামপন্থীদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কনভেনশনে তাঁকেই দেওয়া হল কিনা রাজার পার্ট! আর ভারতীয় জনতা পার্টির ১৭ বছরের জোটসঙ্গী নীতীশ কুমার সহসা হয়ে উঠলেন ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল প্রতীক৷ শেষ পর্যন্ত তাঁদের কেউই বামপন্থীদের সঙ্গে কোনও তাত্পর্যপূর্ণ নির্বাচনী সমঝোতায় কোনও রকম আগ্রহ না দেখালেও, বামপন্থীরা তৃতীয় ফ্রন্টের এই বোঝা ঝেড়ে ফেলতে পারল না৷
অতএব, বামপন্থীদের, বিশেষত সিপিআই(এম)-এর সমস্যা অসংখ্য৷ কাজেই তাদের বালিতে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বুঝতে হবে ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম বার, সিপিআই(এম)-সহ ভারতের সব বামপন্থীরাই অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি৷ এই সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনও সহজ পথও নেই৷ সিপিআই(এম)-এর শীর্ষ নেতৃত্ব, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, যে ভাবে ব্যর্থ তা কোনও রকম সংশোধনের অযোগ্য৷ কোনও সদর্থক পরিবর্তন সম্ভবই নয় যদি না নতুন নেতৃত্বের নতুন ভাবনা নিয়ে মেহনতি মানুষের, বিশেষত যুবসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা যায়৷ তার সঙ্গে, বামপন্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত পথ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হওয়া জরুরি৷ এক দিকে, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সমঝোতা করে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও সামাজিক শোষণের বিরোধিতার পথকে বিসর্জন দিলে বামপন্থীদের অস্তিত্বের মূল কারণটাই আর থাকে না৷ আবার অন্য দিকে, বিশ শতকের ব্যর্থ সমাজতান্ত্রিক মডেলের অন্ধ অনুসরণ ক্ষয় এবং মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করবে৷ বিশেষ জোর দেওয়া দরকার বিদেশি মডেল অনুকরণ না করে ভারতীয় পরিস্থিতিতে বামপন্থী আন্দোলনকে নতুন করে গড়ে তোলার দিকে৷ মনে রাখা দরকার, বামপন্থীদের জন্য সন্ধিক্ষণ সমাগত৷ এবং মোদী সরকার কেন্দ্রে দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সময় আরও কমছে৷ (শেষ)
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/post-edit-2/articleshow/35421128.cms
No comments:
Post a Comment