নরেন্দ্র মোদীর প্রধান মন্ত্রী রূপে রাজ-অভিষেকের পর ‘নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য’ এই মূল নিবন্ধে সংযোজন ঃ
২৬ মে ঘটা করে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। এবারের এই অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ ছিল মালদ্বীপ সহ সার্ক দেশসমূহের উপস্থিতি। পাকিস্তানের উজিরে আজম নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি ও দুই রাষ্ট্র-প্রধানের মধ্যে নিভৃতে বার্তালাপ সবচাইতে বেশি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। এই সরকারের আসল এজেণ্ডা যে উন্নয়ন এবং সার্ক দেশসমূহের অভ্যন্তরিণ বানিজ্যের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করার জন্যই এই প্রয়াস তাতে আর অনেক বিশেষজ্ঞদেরই কোন সন্দেহ রইল না। বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধণ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে যে জটিল বিষয়গুলি রয়েছে তার মীমাংসার পথে যেন হাঁটে বর্তমান সরকার এটাই ছিল এলিট শ্রেণির আকাঙ্খা। কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশের সাথে এভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার রণকৌশলে ভাজপার কোর-কনস্টিট্যুয়েন্সি তো সন্তুষ্ট হতে পারে না। তাই এই মহা-সমারোহের পর চব্বিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই প্রধাণমন্ত্রী দপ্তরের রাজ্য-মন্ত্রী উস্কে দিলেন ৩৭০ ধারা নিয়ে বিতর্ক এবং তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলো আরএসএস-এর সদর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রী ফেডারেল কাঠামোকে শক্তিশালী করার কথা বলে জয়ললিতাদের বার্তা পাঠালেন বটে, কিন্তু সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে তাঁর রাজ্য মন্ত্রীর চটজলদি মন্তব্যের ব্যাপারে কিছু বললেন না। অন্যদিকে এই সরকারের শুরুয়াতটাও হয়েছে অর্ডিন্যান্সের মত একটি হাতিয়ার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে যা গণতান্ত্রিকদের আতঙ্কিত করার পক্ষে যথেষ্ট। কালো টাকার সন্ধান ও উদ্ধার নব-গঠিত কমিশনের তদন্তের দায়রা থেকে কতটুকু বেরোতে পারবে তা এখনো সন্দেহের আবর্তে, কারণ এক্ষেত্রে আমেরিকানদের স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে এবং পূর্বতন সরকারও কালো টাকার সন্ধানে অনেক কুনাট্য করেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই ভারসাম্যের খেলা কিছুদিন চলতে থাকবে, অন্ততঃ বিভিন্ন রাজ্যের আশু নির্বাচনগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো বটেই। আমাদের সংস্কারমুখী অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণাই করে দিয়েছেন যে রপ্তানী বৃদ্ধি করে জটিল আর্থিক পরিস্থিতিকে সামলানো ও বিকাশের হার বৃদ্ধি করাই তাঁর প্রাথমিকতা। রপ্তানী নির্ভর বিকাশ যে বিশ্ব বিত্ত পুঁজি ও বণিক পুঁজির কাছে সবচাইতে বেশি কাম্য এখন আর তা খোলসা করে কাউকে বোঝাতে হয় না। বর্তমান বিশ্বে বিত্ত পুঁজির নিয়ন্ত্রক আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট। সুতরাং সার্ক দেশসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমেরিকান প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এখানে কিছু সমস্যা রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করে ও দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধে স্বল্প সময়ের জন্য নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে অংশগ্রহণ করার জন্য পুঁজিবাদী দেশসমূহের মধ্যে আমেরিকা তার আর্থিক অবস্থাকে সুরক্ষিত করতে পেরেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপীয় দেশসমূহকে ক্ষতিপূরণের দায় জার্মানীর উপর চাপিয়ে দিয়ে যে ভার্সাই চুক্তি হলো, তাতে জার্মানী আমেরিকার কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হলো এবং জার্মান পুঁজিবাদ রপ্তানীভিত্তিক উৎপাদনের উপর গুরুত্ত্ব আরপ করতে গিয়ে চাহিদা মেটাতে বাস্তবে প্রভূত আমদানী বৃদ্ধি ঘটালো এবং ধারের জন্য উত্তরোত্তর আমেরিকান ব্যাঙ্কারদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ভিন্ন প্রেক্ষিতে অনুরূপ ব্যালেন্স অব ক্রাইসিসের মধ্যে ১৯৯০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে মনমোহন সিংহকে কাঠামোগত পুনর্গঠনের নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি চালু করতে হয়েছিল। আমেরিকান বিত্ত পুঁজির উপর নির্ভরশীল জার্মানী তথা ইউরোপীয় দেশসমূহ এই ঋণ-কাঠামোকে ধরে রাখার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারল না। তীব্র বেকারত্ব ও জনগণের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া যে চাহিদার সংকট তৈরি করল তাতে উৎপাদনী বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে এবং আমেরিকার ধার দেওয়ার ক্ষমতাকেও সংকুচিত করে ফেলল। এই সংকটের চূড়ান্ত পড়িনতি ১৯২৯ সালের শেয়ার বাজার পতন ও মহামন্দার শুরুয়াত। বিত্ত-পুঁজি নির্ভর বিকাশের এই ইউরোপীয় প্রজেক্টের বাইরে রইল একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়া যারা বিপ্লবোত্তর পরিকল্পনা-অর্থনীতির পথে হাঁটছিল। পুঁজিবাদের এই সংকট ও ১৯১৭ সালের রাশিয়ান বিপ্লবের পর গোটা ইউরোপে আন্দোলনমুখর শ্রমিক শ্রেণি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির বিকাশের বাস্তবতায় গড়ে উঠল পুঁজি-শ্রমের সমঝোতার নিউ-ডিল। ইউরোপের পুঁজিবাদের পুনরায় জেগে উঠা নির্ভর করছিল জার্মান অর্থনীতির সুস্থিরতা ও বিকাশের উপর। জার্মানীর বাস্তবতার অতি-মূল্যায়ন করে কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছিল যে জার্মানীতে বিপ্লব হয়ে যাবে ও শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করে নেবে এবং তাদের এই অত্যুৎসাহের ফলেই কম্যুনিস্ট পার্টি সমাজ-গণতন্ত্রীদের সাথেও ঐক্য স্থাপন করার কথা ভাবল না। এই সুযোগেই ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হলো ও হিটলারের বিশ্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। জার্মানীতেই এই প্রক্রিয়া গড়ে উঠার পেছনে সম্ভবত আরেকটি কারণ ছিল। ফরাসী বিপ্লব যেভাবে ফরাসীদের মনোজগতে লিবারেল-ডেমোক্রেসীর মূল্যবোধ গড়ে তুলেছিল, জার্মানীতে সেরকম কোন ঐতিহ্য ছিল না। যাইহউক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে স্বল্প সময়ের জন্য আমেরিকার অংশগ্রহণ অন্যান্য দেশের তূলনায় আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সীমিত করে রাখল এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ধার প্রদানের জন্য আমেরিকা বিত্ত পুঁজির প্রধান কেন্দ্র হয়ে রইল। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ও সামরিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কোন একক শক্তি আর রইল না। কিন্তু মুনাফা ও সঞ্চয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুজিবাদের দীর্ঘম্যাদী সংকট আবারও তৈরি হয়েছে সত্তরের দশকে। সুতরাং আরেকটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করার পথে হাঁটছে বিশ্ব-পুঁজিবাদ। এই পর্যায়ে মতাদর্শগত স্তরে সোভিয়েত রাশিয়ার মত কোন কম্যুনিস্ট বিকল্পের ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে না। তবে ভোগ্যপণ্যের ও মিলিটারী উৎপাদনী মেশিনকে চালু রাখার জন্য আমেরিকান বিশ্ব-আধিপত্যের আর্থিক ও সামরিক কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রদর্শন শুরু হয়ে গেছে। আর্থিক দিক দিয়ে চিন এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, ভাঙনের পরও রাশিয়ার সামরিক ক্ষমতা অটুট। চিন সমুদ্র উপকূলে শক্তি প্রদর্শনের জন্য রাশিয়া ও চিন যৌথ মহড়ায় অবতীর্ণ হয়েছে, ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দিয়েছে যে রাশিয়া তাদের রণকৌশলগত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই ছেড়ে দেবে না। ২০০৮ সালের শেয়ার বাজার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ক্ষমতাও দুর্বল হয়েছে। মোদী সরকার ও অন্যান্য সার্ক দেশগুলি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির এই দ্বিবিধ শক্তির রণকৌশলগত খেলায় কী বিদেশ নীতি অবলম্বন করে এটাও দেখার বিষয়। তবে বিশ্ব-পুঁজিবাদের এই সংকটময়কালে সীমিত যুদ্ধ, ফ্যাসীবাদী উত্থান ও তার বিপরীতে মেহনতি মানুষের আন্দোলনমুখী উত্থান যে এক বাস্তব পরিস্থিতি হিসেবে দেখা দিয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শক্তির ভারসাম্য যুদ্ধ-ফ্যাসীবাদ-ধ্বংস না গণতন্ত্র-সাম্যবাদ-সৃষ্টির পক্ষে বিকশিত হবে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ও রণনীতিগত পন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং একাজটি করতে হবে মানবতা ও মানব সভ্যতার স্বার্থেই। ইতিমধ্যেই পরিবেশ বিপর্যয় ও যুদ্ধ সামগ্রীর সম্ভার মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঐক্য, সৌভাতৃত্ব ও সাম্যের শ্লোগান আবারও বিশ্ব-মানবের আঙ্গিনায় মুখরিত হোক – এটাই কাম্য।
২৬ মে ঘটা করে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। এবারের এই অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ ছিল মালদ্বীপ সহ সার্ক দেশসমূহের উপস্থিতি। পাকিস্তানের উজিরে আজম নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি ও দুই রাষ্ট্র-প্রধানের মধ্যে নিভৃতে বার্তালাপ সবচাইতে বেশি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। এই সরকারের আসল এজেণ্ডা যে উন্নয়ন এবং সার্ক দেশসমূহের অভ্যন্তরিণ বানিজ্যের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করার জন্যই এই প্রয়াস তাতে আর অনেক বিশেষজ্ঞদেরই কোন সন্দেহ রইল না। বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধণ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে যে জটিল বিষয়গুলি রয়েছে তার মীমাংসার পথে যেন হাঁটে বর্তমান সরকার এটাই ছিল এলিট শ্রেণির আকাঙ্খা। কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশের সাথে এভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার রণকৌশলে ভাজপার কোর-কনস্টিট্যুয়েন্সি তো সন্তুষ্ট হতে পারে না। তাই এই মহা-সমারোহের পর চব্বিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই প্রধাণমন্ত্রী দপ্তরের রাজ্য-মন্ত্রী উস্কে দিলেন ৩৭০ ধারা নিয়ে বিতর্ক এবং তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলো আরএসএস-এর সদর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রী ফেডারেল কাঠামোকে শক্তিশালী করার কথা বলে জয়ললিতাদের বার্তা পাঠালেন বটে, কিন্তু সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে তাঁর রাজ্য মন্ত্রীর চটজলদি মন্তব্যের ব্যাপারে কিছু বললেন না। অন্যদিকে এই সরকারের শুরুয়াতটাও হয়েছে অর্ডিন্যান্সের মত একটি হাতিয়ার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে যা গণতান্ত্রিকদের আতঙ্কিত করার পক্ষে যথেষ্ট। কালো টাকার সন্ধান ও উদ্ধার নব-গঠিত কমিশনের তদন্তের দায়রা থেকে কতটুকু বেরোতে পারবে তা এখনো সন্দেহের আবর্তে, কারণ এক্ষেত্রে আমেরিকানদের স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে এবং পূর্বতন সরকারও কালো টাকার সন্ধানে অনেক কুনাট্য করেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই ভারসাম্যের খেলা কিছুদিন চলতে থাকবে, অন্ততঃ বিভিন্ন রাজ্যের আশু নির্বাচনগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো বটেই। আমাদের সংস্কারমুখী অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণাই করে দিয়েছেন যে রপ্তানী বৃদ্ধি করে জটিল আর্থিক পরিস্থিতিকে সামলানো ও বিকাশের হার বৃদ্ধি করাই তাঁর প্রাথমিকতা। রপ্তানী নির্ভর বিকাশ যে বিশ্ব বিত্ত পুঁজি ও বণিক পুঁজির কাছে সবচাইতে বেশি কাম্য এখন আর তা খোলসা করে কাউকে বোঝাতে হয় না। বর্তমান বিশ্বে বিত্ত পুঁজির নিয়ন্ত্রক আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট। সুতরাং সার্ক দেশসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমেরিকান প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এখানে কিছু সমস্যা রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করে ও দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধে স্বল্প সময়ের জন্য নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে অংশগ্রহণ করার জন্য পুঁজিবাদী দেশসমূহের মধ্যে আমেরিকা তার আর্থিক অবস্থাকে সুরক্ষিত করতে পেরেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপীয় দেশসমূহকে ক্ষতিপূরণের দায় জার্মানীর উপর চাপিয়ে দিয়ে যে ভার্সাই চুক্তি হলো, তাতে জার্মানী আমেরিকার কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হলো এবং জার্মান পুঁজিবাদ রপ্তানীভিত্তিক উৎপাদনের উপর গুরুত্ত্ব আরপ করতে গিয়ে চাহিদা মেটাতে বাস্তবে প্রভূত আমদানী বৃদ্ধি ঘটালো এবং ধারের জন্য উত্তরোত্তর আমেরিকান ব্যাঙ্কারদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ভিন্ন প্রেক্ষিতে অনুরূপ ব্যালেন্স অব ক্রাইসিসের মধ্যে ১৯৯০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে মনমোহন সিংহকে কাঠামোগত পুনর্গঠনের নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি চালু করতে হয়েছিল। আমেরিকান বিত্ত পুঁজির উপর নির্ভরশীল জার্মানী তথা ইউরোপীয় দেশসমূহ এই ঋণ-কাঠামোকে ধরে রাখার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারল না। তীব্র বেকারত্ব ও জনগণের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া যে চাহিদার সংকট তৈরি করল তাতে উৎপাদনী বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে এবং আমেরিকার ধার দেওয়ার ক্ষমতাকেও সংকুচিত করে ফেলল। এই সংকটের চূড়ান্ত পড়িনতি ১৯২৯ সালের শেয়ার বাজার পতন ও মহামন্দার শুরুয়াত। বিত্ত-পুঁজি নির্ভর বিকাশের এই ইউরোপীয় প্রজেক্টের বাইরে রইল একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়া যারা বিপ্লবোত্তর পরিকল্পনা-অর্থনীতির পথে হাঁটছিল। পুঁজিবাদের এই সংকট ও ১৯১৭ সালের রাশিয়ান বিপ্লবের পর গোটা ইউরোপে আন্দোলনমুখর শ্রমিক শ্রেণি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির বিকাশের বাস্তবতায় গড়ে উঠল পুঁজি-শ্রমের সমঝোতার নিউ-ডিল। ইউরোপের পুঁজিবাদের পুনরায় জেগে উঠা নির্ভর করছিল জার্মান অর্থনীতির সুস্থিরতা ও বিকাশের উপর। জার্মানীর বাস্তবতার অতি-মূল্যায়ন করে কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছিল যে জার্মানীতে বিপ্লব হয়ে যাবে ও শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করে নেবে এবং তাদের এই অত্যুৎসাহের ফলেই কম্যুনিস্ট পার্টি সমাজ-গণতন্ত্রীদের সাথেও ঐক্য স্থাপন করার কথা ভাবল না। এই সুযোগেই ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হলো ও হিটলারের বিশ্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। জার্মানীতেই এই প্রক্রিয়া গড়ে উঠার পেছনে সম্ভবত আরেকটি কারণ ছিল। ফরাসী বিপ্লব যেভাবে ফরাসীদের মনোজগতে লিবারেল-ডেমোক্রেসীর মূল্যবোধ গড়ে তুলেছিল, জার্মানীতে সেরকম কোন ঐতিহ্য ছিল না। যাইহউক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে স্বল্প সময়ের জন্য আমেরিকার অংশগ্রহণ অন্যান্য দেশের তূলনায় আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সীমিত করে রাখল এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ধার প্রদানের জন্য আমেরিকা বিত্ত পুঁজির প্রধান কেন্দ্র হয়ে রইল। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ও সামরিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কোন একক শক্তি আর রইল না। কিন্তু মুনাফা ও সঞ্চয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুজিবাদের দীর্ঘম্যাদী সংকট আবারও তৈরি হয়েছে সত্তরের দশকে। সুতরাং আরেকটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করার পথে হাঁটছে বিশ্ব-পুঁজিবাদ। এই পর্যায়ে মতাদর্শগত স্তরে সোভিয়েত রাশিয়ার মত কোন কম্যুনিস্ট বিকল্পের ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে না। তবে ভোগ্যপণ্যের ও মিলিটারী উৎপাদনী মেশিনকে চালু রাখার জন্য আমেরিকান বিশ্ব-আধিপত্যের আর্থিক ও সামরিক কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রদর্শন শুরু হয়ে গেছে। আর্থিক দিক দিয়ে চিন এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, ভাঙনের পরও রাশিয়ার সামরিক ক্ষমতা অটুট। চিন সমুদ্র উপকূলে শক্তি প্রদর্শনের জন্য রাশিয়া ও চিন যৌথ মহড়ায় অবতীর্ণ হয়েছে, ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দিয়েছে যে রাশিয়া তাদের রণকৌশলগত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই ছেড়ে দেবে না। ২০০৮ সালের শেয়ার বাজার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ক্ষমতাও দুর্বল হয়েছে। মোদী সরকার ও অন্যান্য সার্ক দেশগুলি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির এই দ্বিবিধ শক্তির রণকৌশলগত খেলায় কী বিদেশ নীতি অবলম্বন করে এটাও দেখার বিষয়। তবে বিশ্ব-পুঁজিবাদের এই সংকটময়কালে সীমিত যুদ্ধ, ফ্যাসীবাদী উত্থান ও তার বিপরীতে মেহনতি মানুষের আন্দোলনমুখী উত্থান যে এক বাস্তব পরিস্থিতি হিসেবে দেখা দিয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শক্তির ভারসাম্য যুদ্ধ-ফ্যাসীবাদ-ধ্বংস না গণতন্ত্র-সাম্যবাদ-সৃষ্টির পক্ষে বিকশিত হবে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ও রণনীতিগত পন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং একাজটি করতে হবে মানবতা ও মানব সভ্যতার স্বার্থেই। ইতিমধ্যেই পরিবেশ বিপর্যয় ও যুদ্ধ সামগ্রীর সম্ভার মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঐক্য, সৌভাতৃত্ব ও সাম্যের শ্লোগান আবারও বিশ্ব-মানবের আঙ্গিনায় মুখরিত হোক – এটাই কাম্য।
No comments:
Post a Comment