মহারাষ্ট্রের ফেসবুক-কাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে কাটজু বলেছেন, অম্বিকেশ মহাপাত্রকে হেনস্থা করার ঘটনায় জড়িত পুলিশকর্মীদেরও একই ভাবে শাস্তি দেওয়া উচিত। অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা তুলে তাঁদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথাও বলা হয়েছে চিঠিতে। দময়ন্তী সেনকে যে ভাবে 'সরিয়ে দেওয়া' হয়েছে, তা-ও কাটজুর মতে অন্যায়।
অবিলম্বে দময়ন্তী সেনকে তাঁর পুরনো পদে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। এমনকী একট বেসরকারি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে মাওবাদী বলে 'অপমান' করার জন্য তাঁর কাছেও মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে কাটজু মনে করেন। কেননা, ক্ষমা চাইলে শুধু রাজ্যেরই নয়, গোটা দেশের কাছেই তাঁর সম্মান অনেক বেড়ে যাবে।
মমতা বলেন, অনেক রায় টাকার বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে; এটা দুর্ভাগ্যজনক। তিনি আরা দাবি করেন, বিচার ব্যবস্থার একটা অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত।
এ বক্তব্য দেয়ার জন্য মামলা হতে পারে উল্লেখ করে মমতা বলেন, এ কথা বলার জন্য তিনি জেলে যেতেও তৈরি আছেন। অবশ্য শুধু বিচার বিভাগই নয় মমতার কঠোর সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি বিভিন্ন কমিশনও।
বিচার বিভাগীয় অনেক কমিশন গঠন করা হলেও তার কোনো ফলাফল দেখা যায়নি- উল্লেখ করে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী বলেন, এ সব কমিশনের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে কিন্তু তারা উপরস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করা ছাড়া আর কিছুই করে না।
সরকারকে বিব্রত করতেই দুবরাজপুর ও তেহট্টে পরিকল্পিত ভাবে গোলমাল পাকানো হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে এমনটাই মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার মহাকরণে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রথম বার দুবরাজপুর ও তেহট্টের ঘটনা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তেহট্টের ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত চলছে। কিন্তু সরকার যে হাত-পা গুটিয়ে থাকেনি, এদিন তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা।জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই এসডিপিও এবং ওসি-কে সরানো হয়েছে। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এড়াতেই যে এই পদক্ষেপ, সে কথাও বলেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন,তেহট্টের মামলা যাতে খুব শিগগিরই নিষ্পত্তি নয়, সে জন্য দিলীপ নায়েকের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনায় মৃত পরিবারবর্গদের এককালীন আর্থিক সাহায্য ও চাকরি দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, দুবরাজপুরে পুলিশের গুলি চালনার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকায় তেমন গুরত্ব না-দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, সাংসদ মুকুল রায়কে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তবে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট সরকারের হাতে এখনও আসেনি। এডিজি সুব্রত পুরকায়স্থ ঘটনার রিপোর্ট খুব তাড়াতাড়িই জমা দিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুবরাজপুরে পুলিশের গুলিতে আহত পাঁচ পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে বলে তিনি এদিন ঘোষণা করেন।
দু'টি ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়া হবে বলে এদিন মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর দাবি, বাম জমানা থেকেই দুবরাজপুরে গোলমালের সূত্রপাত। তাই চাষীদের আগে সরকারকে জমি বিক্রির বিষয়ে হলফনামা জমা দিতে হবে। তারপরই সরকার জমি অধিগ্রহণের কাজে নামবে।
এদিন তিনি আরও বলেন, তেহট্ট ও দুবরাজপুরে না গেলেও হুগলি জেলার সিঙ্গুরের বিডিও অফিসে প্রশাসনিক বৈঠক করবেন। বিধায়ক বেচারাম মান্নাকে ঘিরে সিঙ্গুরে বিক্ষোভে আদৌ গুরুত্ব দেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগামী ৩ ডিসেম্বর মাসে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলা সফরে যাবেন।
কাটজুর চিঠির ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মমতা নিজে অবশ্য এ দিন বলেছেন, 'রাজা চলে বাজার, কুত্তা ভোকে হাজার।' মমতার এই প্রতিক্রিয়ার কথা কাটজুকে জানানো হলে তিনি বলেন, বাজে কথার উত্তর দিতে তাঁর রুচিতে বাধে। বিচারপতি কাটজুর ব্লগে কিন্তু এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগেরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা প্রয়োগ নিয়ে আপত্তি রয়েছে।
ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু বলেছেন, 'পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও বেশি ধৈর্যশীল হতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর কোনো ধৈর্য নেই। উনি কারও কথা শোনেন না।'
গত রোববার কলকাতা প্রেসক্লাবে কালিদাস-গালিব ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত প্রখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক স্মরণসভায় বিচারপতি কাটজু এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ প্রশাসক হিসেবে নিশ্চয়ই মমতা সব সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু সবার কথাও তাঁর শোনা উচিত। মুখ্যমন্ত্রীর বোঝা উচিত, এটা গণতন্ত্র। রাজতন্ত্রে প্রভু আর প্রজারা ভৃত্য। কিন্তু গণতন্ত্রে এর উল্টোটা।
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কাটজু বলেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। সব সময় তিনি ইয়েসম্যান বা বশংবদদের পছন্দ করেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে আরও ধৈর্যশীল হওয়ার পরামর্শ দেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খামখেয়ালিপনা ও অসহিষ্ণু আচরণের সমালোচনা করে ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু সরাসরি চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে, মমতা তার আচরণের পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। এর আগে অবশ্য কাটজু মমতার কাজের প্রশংসা করেছিলেন। তবে ফেসবুকে কার্টুন কাণ্ডে গ্রেপ্তার, পার্ক স্ট্রিটে মহিলাকে ধর্ষণের কথা অস্বীকার এবং টিভিতে মমতার নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় হেনস্তার মতো ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাবেক এই বিচারপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠি পাঠিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তার আচরণ সংশোধনের জন্য।
''রাজ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং তা মুখ্যমন্ত্রীর অপ্রতাশিত কাণ্ডকারখানা এবং খামখেয়ালি আচরণের জন্যই।'' রাজ্যের বর্তমান পরিণতির জন্য এবার সরাসরি প্রশাসনিক প্রধান মমতা ব্যানার্জিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কাটজু। শুধু তাই নয়, নিজেকে মুখ্যমন্ত্রীর 'শুভাকাঙ্ক্ষী' দাবি করে এই প্রাক্তন বিচারপতির পরামর্শ, অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, বাঁশপাহাড়ির শিলাদিত্য চৌধুরী, অন্যায্যভাবে বদলি করা দময়ন্তী সেন থেকে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজ—সকলের কাছেই অন্তত ক্ষমা চান মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, 'যিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চান তিনিই তো প্রকৃত ভদ্রজন'।
মাত্র চারদিন আগেই কলকাতায় এসে মুখ্যমন্ত্রীর অসহিষ্ণু আচরণের কড়া সমালোচনা করে কাটজু বলেছিলেন, ''মমতা ব্যানার্জি প্রশাসনে একমাত্র 'ইয়েসম্যান' পছন্দ করেন। উনি অসহিষ্ণু হয়ে কোনো সমালোচনা সহ্য করছেন না।'' কার্যত সেই সুর আরও চড়িয়েই ফের সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন এই বিচারপতির ৪৪২শব্দের ই-মেলে পত্রাঘাত। যদিও যে প্রবণতাকে কাটজু সমালোচনা করেছিলেন, সেই অসহিষ্ণুতা থেকেই এদিনও ফের তাঁর সমালোচকদের ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে মমতা ব্যানার্জি নিজের কাজকর্মের সাফাই দিয়ে বলেছেন, ''রাজা চলে বাজার, কুত্তা ভোকে হাজার, করনে দো।''
রাজ্যে আতঙ্করাজের উদাহরণ দিতে গিয়েই সম্প্রতি তাঁর কলকাতা সফরের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে মার্কণ্ডেয় কাটজু তাঁর এই ই-মেল বার্তায় লিখেছেন, ''কলকাতা সফরে গিয়ে দেখেছি আপনার মন্ত্রী ও আমলারা আপনার সামনে সাবলীলভাবে খোলামনে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন। আপনার অপ্রত্যাশিত ও খামখেয়ালি আচরণে তাঁরা আতঙ্কিত।''
দলের একাংশের কর্মীদের তোলাবাজির বিরুদ্ধে দলের প্রবীণ বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মন্তব্য থেকে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের দল ছাড়ার ভাবনা—এই পরিস্থিতিতেই এই ই-মেল পত্রাঘাত সরকারের বিড়ম্বনার মাত্রাকে দ্বিগুণ করেছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিব্রত তৃণমূল শিবির। এই নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দিতেই রাজি হননি কোন তৃণমূল নেতা কিংবা মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করেই বুধবার রাতে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীকে এই ই-মেল করেন কাটজু। তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সচিবকে অনুরোধ করেন তাঁর এই মতামত মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতে। যদিও এদিন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ''তিনি কোন চিঠি পাননি।''
কাটজু তাঁর ই-মেল বার্তায় মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছেন, ''যে পুলিসকর্তা যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র এবং শিলাদিত্য চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করবো।'' এমনকি এক্ষেত্রে সম্প্রতি মহারাষ্ট্র সরকারের একটি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে কাটজু চিঠিতে লেখেন, ''আপনি নিশ্চয় জানেন মুম্বাইতে বাল ঠাকরের শেষকৃত্যের দিন যেভাবে গোটা শহর বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেই বিষয়ে ফেসবুকে আপত্তি জানিয়ে পোস্ট করার জন্য এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী সেই পুলিস আধিকারিককে সাসপেন্ডের নির্দেশ দিয়েছেন।'' এই উদাহরণকে সামনে রেখেই অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় যুক্ত পুলিসকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আরজি জানিয়েছেন কাটজু।
পাশাপাশি যেভাবে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে তদন্ত করে ধর্ষণে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করার পরেও তৎকালীন কলকাতা পুলিসের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) দময়ন্তী সেনকে বদলি করা হয়েছিল তাতেও আরও একবার মমতা ব্যানার্জির অসহিষ্ণু ও খামখেয়ালি আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো বলে মনে করছেন সুপ্রিম কোর্টের এই প্রাক্তন বিচারপতি। খোদ কলকাতা পুলিস কমিশনার থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যেখানে পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের ঘটনা সাজানো ঘটনা, সরকারকে অপদস্ত করার চেষ্টা বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন সেখানে কার্যত স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে গোটা ঘটনার তদন্তে নামেন দময়ন্তী সেন। 'পুরস্কার' বাবদ তাঁকে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ডি আই জি (ট্রেনিং) পদে বদলি করা হয়। যদিও রাজনৈতিক মহলের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর চরম অসিহষ্ণুতার নজির তৈরি হয়েছিল টাউন হলে একটি ইংরেজি সংবাদ চ্যানেলের অনুষ্ঠানে যখন তাঁকে অপ্রিয় প্রশ্ন করার জন্য প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কৃতী ছাত্রীকে মাওবাদী বলে আখ্যা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এই দুটি ঘটনার উল্লেখ করে কাটজু ই-মেল বার্তায় বলেছেন, তানিয়া ভরদ্বাজকে আপনি যেভাবে অপমানিত করেছেন তার জন্য কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত আপনার।
কেন রাজ্য এই অস্থিরতা, কেন প্রশাসনে প্রতিটি কাজকর্মে এরকম খামখেয়ালিপনা প্রকাশ পাচ্ছে বোঝাতে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণকে দায়ী করেই কাটজু তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য, ''নিজের আচরণ না বদলালে এবং আরও সহিষ্ণু না হলে মুখ্যমন্ত্রী পদেও বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব নয় আপনার।'' এর আগেও কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ব্যনার্জি স্তাবক পরিবৃত হয়ে রয়েছেন বলে উল্লেখ করে মার্কণ্ডেয় কাটজু বলেছিলেন, ''মুখ্যমন্ত্রীর এমন ভালো উপদেষ্টা প্রয়োজন যাঁরা তাঁকে সঠিক পথে চালিত করবে। কিন্তু উনি শুধু ইয়েসম্যানদের কথায় চলছেন। কিছু অন্য কথা বলার লোকও তো পাশে থাকা দরকার।'' এই ই-মেল বার্তায় আর এক ধাপ এগিয়ে কাটজুর অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্যের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ''সফল শাসক তিনিই যিনি ভালো পরামর্শদাতা নিয়োগ করেন এবং তাঁদের পরামর্শ শোনেন। অবশ্যই পরামর্শদাতাদের পরামর্শ শুনে আপনি নিজেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনার পরামর্শদাতারা স্বাধীনভাবে মতামত জানানো উচিত।''
মাত্র দেড় বছরের শাসনেই মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানের এই পত্রাঘাত রীতিমতো নজিরবিহীন। তেহট্টে গুলি চালানো নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট চেয়ে পাঠানোর ২৪ঘণ্টার মধ্যেই এই ই-মেল কাণ্ডে রীতিমতো অস্বস্তিতে সরকার। তিনি যে মমতা ব্যানার্জির সমালোচক কিংবা শত্রু নন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই এই চিঠির একেবারে শেষে কাটজু লিখেছেন, ''আপনার হয়তো মনে থাকবে যে আমি একসময় আপনার প্রশংসাও করেছিলাম। কিন্তু আপনি এখন ক্রমাগত অহিসষ্ণু ও খামখেয়ালি হয়ে উঠছেন যা আপনাকে কেবল বড়সড় সমস্যার মুখেই দাঁড় করাবে।'
"রাজা চলে বাজার সে, কুত্তা ভৌকে হাজার সে..." আজ বেঙ্গল বিল্ডসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই ভাষাতেই প্রাক্তন বিচারপতি ও প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কাটজুর সমালোচনার জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী জানান প্রাক্তন বিচারপতির কোনও চিঠিই তিনি পাননি।
এর আগে আজই কড়া সমালোচনা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠান কাটজু। চিঠিতে তিনি বলেন, রাজ্যের মন্ত্রী-আমলারা মুখ্যমন্ত্রীর সামনে খোলামনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর খামখেয়ালি আচরণে তাঁরা ভীত-সন্ত্রস্ত। এই ধরণের আচরণ বদলে সহিষ্ণুতা না দেখাতে পারলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশি দিন মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন না বলেও চিঠিতে সরাসরি লিখেছেন তিনি।
প্রয়াত শিবসেনা নেতা বাল থ্যাকারের অন্তেষ্ট্যি নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় দুই তরুণীকে গ্রেফতার করেছিল মহারাষ্ট্র পুলিস। পরে, সংশ্লিষ্ট পুলিস আধিকারিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রের হেনস্থার সঙ্গে জড়িত পুলিস আধিকারিকদের বিরুদ্ধে একইরকম পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আহ্বান জানিয়েছেন মার্কণ্ডেয় কাটজু। অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়ে তাঁদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যও মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন কাটজু।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দময়ন্তী সেনকে যেভাবে পদচ্যুত করেছিলেন তা ভুল ছিল বলে মনে করেন কাটজু। অবিলম্বে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর পদে (পুলিস কমিশনার ক্রাইম) ফিরিয়ে আনতেও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন মার্কণ্ডেও। এমনকী একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান চলাকালীন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে মাওবাদী বলে অপমান করার জন্যও মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কাটজু। তিনি মনে করেন এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছেই শুধু নয় সারা দেশের কাছেই অন্তত কিছুটা হলেও তাঁর হারানো ভাবমূর্তি ফিরে পাবেন মুখ্যামন্ত্রী।
কাটজু লিখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি যতবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন মন্ত্রী-আমলারাও তাঁর সামনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর খামখেয়ালি আচরণের ভয়ে তাঁরা সবসময় তটস্থ। মন্ত্রী, আমলারা ভিন্নমত পোষণ করলেও তাঁদের কথা বলার অধিকার থাকা উচিত বলে মনে করেন কাটজু। এই প্রসঙ্গে প্রথম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। উদাহরণ টেনেছেন কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র থেকেও।
চিঠির শেষে কাটজু লিখেছেন একসময় তিনিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করতেন। কিন্তু এখন তাঁর অসহিষ্ণু আচরণকে সমালোচনা না করে তিনি থাকতে পারছেন না। শুভাকাঙ্খী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর অনুরোধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন দেরি হওয়ার আগেই তাঁর ভুল শুধরে নেন।
কাটজু লিখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি যতবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন মন্ত্রী-আমলারাও তাঁর সামনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর খামখেয়ালি আচরণের ভয়ে তাঁরা সবসময় তটস্থ। মন্ত্রী, আমলারা ভিন্নমত পোষণ করলেও তাঁদের কথা বলার অধিকার থাকা উচিত বলে মনে করেন কাটজু। এই প্রসঙ্গে প্রথম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। উদাহরণ টেনেছেন কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র থেকেও। চিঠির শেষে কাটজু লিখেছেন একসময় তিনিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করতেন। কিন্তু এখন তাঁর অসহিষ্ণু আচরণকে সমালোচনা না করে তিনি থাকতে পারছেন না। শুভাকাঙ্খী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর অনুরোধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন দেরি হওয়ার আগেই তাঁর ভুল শুধরে নেন।
আজ সিঙ্গুর সফরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সেখানে বিডিও অফিসে প্রশাসনিক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সিঙ্গুরে নতুন স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইতিমধ্যেই কলেজের জন্য ৫ একর জমি পাওয়া গিয়েছে। সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হবে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলকে। একশো দিনের কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বছর কাজ হয়েছিল ১১ দিন, এ বছর কাজ হয়েছে ২৯ দিন। আবার কৃষকদের উদ্দেশ্যে তাঁর ঘোষণা, চাষের কাজে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ভর্তুকি দেওয়া হবে। জমি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মামলা মিটলেই জমি ফেরত দেওয়া হবে। জেলাশাসক অসুস্থ ছিলেন বলেই অনিচ্ছুক কৃষকদের টাকা দিতে দেরি হয়েছে। তবে এ বার থেকে প্রতি মাসেই তারা টাকা পেয়ে যাবেন বলে আশ্বাস দেন মুখ্যমন্ত্রী।
সুপ্রিম কোর্টে বহু বিতর্কিত সিঙ্গুর মামলার শুনানি হবে আগামী সোমবার। কলকাতা হাইকোর্ট সিঙ্গুর আইনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেওয়ার পর, সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিল রাজ্য সরকার। সেই আবেদনের ভিত্তিতেই সিঙ্গুর নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করবে টাটারা। এর পাশাপাশি, কোন পরিস্থিতিতে টাটারা রাজ্য ছেড়েছিল, সুপ্রিম কোর্টে সেই যুক্তিও পেশ করতে পারেন টাটাগোষ্ঠীর আইনজীবী।
প্রসঙ্গত, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম ইস্যুকে কেন্দ্র করেই এ রাজ্যে রাজনৈতিক পটভূমির পরিবর্তন হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল সরকারের যে সিঙ্গুর আইন প্রণয়ন করে হাইকোর্ট তাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেওয়ায় ব্যাকফুটে চলে যায় রাজ্য সরকার।
এদিকে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষীরাও বহু দিন পর সরকারের বিরুদ্ধে এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যে সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন কে কেন্দ্র করে মমতা সরকারের জন সমর্থনের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, জমি ফেরত দিতে না পারায় তাও এখন প্রশ্নের মুখে। এ রকম পরিস্থিতিতে সোমবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে সিঙ্গুর সহ গোটা দেশ।
সিঙ্গুরের জমি রাজ্য সরকারেরই। মামলা মিটলে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেবে সরকার। সিঙ্গুরে প্রশাসনিক বৈঠক শেষে একথাই বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আরও জানান সিঙ্গুরে ৩১ হাজার চাষিকে আট হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। জেলা শাসক অসুস্থ থাকার জন্য বেশ কিছুদিন মাসিক টাকা দেওয়ায় দেরি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গুর সফর ঘিরে মানুষের মধ্যে সেই পুরনো উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। দিলেন না নতুন কোনও প্রতিশ্রুতিও। জমি যে এখনও কাঁটা সিঙ্গুরে দাঁড়িয়ে তা কার্যত স্বীকার করতে হল তাঁকে। অনিচ্ছুক কৃষকদের অনুদান নিয়ে ত্রুটির কথা মানলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রুটি স্বীকার করলেও রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে কোনও গুরুত্বই দিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। উল্টে গুরুত্ব দিলেন বেচারাম মান্নাকেই।
আজ সকালেই সিঙ্গুরে বিডিও অফিসে প্রশাসনিক বৈঠক করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুকুল রায়, মদন মিত্র। উপস্থিত ছিলেন কৃষি দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী বেচারাম মান্না। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৈঠকে যোগ দেননি সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বনাম বেচারাম মান্নার সংঘাতে এই মুহূর্তে উত্তপ্ত সিঙ্গুর। তাই যে সিঙ্গুর একসময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একডাকে সাড়া দিয়েছে, সেই সিঙ্গুরেই আজ সভা বাতিল করে শুধুই প্রশাসনিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন মুখ্যমন্ত্রী। বাতিল হওয়া ওই সভায় গরিব মানুষদের জমির পাট্টা, সাইকেল প্রদান সহ মুখ্যমন্ত্রীর একগুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে আগাম জানানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনসভা বাতিল করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজনীতিকদের মতে, সিঙ্গুরে বিক্ষোভের মুখে পড়ার আশঙ্কাতেই সভা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে আজ কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে সিঙ্গুরে। মুখ্যমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে সিঙ্গুরবাসীর মধ্যেও তেমন উত্সাহ দেখা যায়নি।
তৃণমূলের দলীয় বৈঠক ঘিরে জোর নাটক। বিক্ষুদ্ধ শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে বৈঠকে ডেকেও তাঁকে ফিরে যেতে বলা হল। তৃণমূল ভবনে বৈঠক চলাকালীন শোভনদেবকে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু তারপরই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ফোন পেয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে যান শভনদেব বাবু। দলীয় অস্বস্তি এড়াতেই কী তড়িঘড়ি এই পদক্ষেপ? উঠছে প্রশ্ন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে হেনস্থার প্রতিবাদে শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশ করছিলেন আইএনটিটিইউসি সমর্থকেরা। সমাবেশ হয় ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে। সমাবেশ থেকে আইএনটিটিইউসির অন্য গোষ্ঠীর নেতাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়। বিক্ষোভ সমাবেশের পর মিছিলেরও কর্মসূচি ছিল। তবে সমাবেশ চলাকালীনই তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ফোন করেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে। এরপরই মিছিলের কর্মসূচি বাতিল করা হয়। নেত্রীকে সম্মান জানাতেই মিছিল বাতিলের সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়েছে আইএনটিটিইউসির নেতরা।
শুক্রবারই দলে বিদ্রোহ ঠেকাতে বৈঠকে বসছেন তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। বৈঠকে ডাকা হয় ক্ষুব্ধ শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে। আজ বিকেলে তৃণমূল কংগ্রেস ভবনে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা ছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মুকুল রায়ের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএনটিটিইউসি-র একটি গোষ্ঠীর হাতে হেনস্থার শিকার হন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এরপর দলের ভিতরে সম্মান-মর্যাদার প্রশ্নে সরব হন তিনি। প্রবীণ বিধায়ক তথা সরকারের মুখ্য সচেতকের এই ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসে পড়ায় যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়ে তৃণমূল কংগ্রেস। সেই অস্বস্তি ঢাকতে গতকাল শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ হাকিম।
এই সময়: 'ব্রিটিশরা বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি৷ তাদের তুলনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো অনেক ক্ষুদ্র শক্তি৷ এ ভাবে বিরোধী কণ্ঠ রোধ করে আখেরে নিজের কবরই খুঁড়ছেন মুখ্যমন্ত্রী'৷ 'এই সময়'কে দেওয়া টেলিফোন সাক্ষাত্কারে এমনই বিস্ফোরক দেশের 'একজন সাধারণ নাগরিক' মার্কণ্ডেয় কাটজু৷ যাঁর অন্য পরিচয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ও বর্তমানে প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান৷ এবং মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা যাঁর খোলা চিঠি বৃহস্পতিবার দিন ভর সরগরম করে রাখল রাজ্য রাজনীতি৷
সাম্প্রতিক যে কয়েকটি ঘটনায় রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয়েছে, চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে, চিঠিতে সেই সবক'টি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমা চাইতে বলেছেন প্রাক্তন বিচারপতি৷ এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর 'খামখেয়ালি মেজাজের ভয়ে তাঁর আমলা ও মন্ত্রীরা কাঁটা হয়ে থাকেন' বলেও মন্তব্য করতে ছাড়েননি কাটজু৷ তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে 'ডিয়ার মমতাজি'কে লেখা চিঠিটি কাটজু পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আমলা, রাজ্যের তথ্য ও সংস্কতি সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীকে৷ ইমেলের কপি পাঠানো হয়েছে সংবাদসংস্থা পিটিআইকেও৷
চিঠির গোড়াতেই ফেসবুকে কার্টুন প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন কাটজু৷ বাল ঠাকরের মৃত্যুতে মুম্বইয়ে বন্ধ হওয়ায় ফেসবুকে মহারাষ্ট্র সরকারের সমালোচনা করায় গ্রেফতার করা হয়েছিল শাহিন ধাদা ও রেণু নামে দুই তরুণীকে৷ দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ফলে চাপে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বান ওই ঘটনায় অভিযুক্ত তিন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ মমতাকে চিঠিতে কাটজু লিখেছেন, 'মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আপনার শিক্ষা নেওয়া উচিত৷ যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও বেলপাহাড়ির শিলাদিত্য চৌধুরীকে যে পুলিশ অফিসাররা গ্রেফতার করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন আপনি৷ ওই দু'জনের কাছেই আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত৷' প্রসঙ্গত, ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রী ও তত্কালীন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়কে নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র ফরোয়ার্ড করার জন্য গ্রেফতার করা হয় অম্বিকেশ মহাপাত্রকে৷ আর বেলপাহাড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় তাঁকে সারের দাম নিয়ে প্রশ্ন করার দায়ে হাজতবাস করতে হয় শিলাদিত্য চৌধুরীকে৷
কাটজুর এই চিঠি প্রকাশ্যে আসার পরই তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে৷ মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করেননি৷ কিন্ত্ত কাটজুর নাম না করেই তিনি বলেন, 'আপনারা যা ইচ্ছা লিখতে পারেন, আমার কিছু যায় আসে না৷ আমি কোনও মন্তব্য করব না৷'
পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের ঘটনায় প্রাক্তন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনকে সরিয়ে দেওয়া নিয়েও মুখ খুলেছেন কাটজু৷ তিনি লিখেছেন, 'অবিলম্বে দময়ন্তী সেনকে তাঁর পদ ফিরিয়ে দিন আপনি৷ তাঁর মতো দক্ষ ও সত্ অফিসারকে শাস্তি দিয়ে আপনি যে ভুল করেছেন তার জন্যও আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত৷ মানুষ মাত্রেই ভুল করে, কিন্ত্ত সেই ভুল স্বীকার করার মধ্যেই রয়েছে মহত্ত্ব৷' একটি ইংরেজি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে 'অপমান করার জন্যও' মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে দাবি করেছেন কাটজু৷
মুখ্যমন্ত্রীর অসহিষ্ণুতা নিয়ে রবিবারই কলকাতায় এসে মুখ খুলেছিলেন কাটজু৷ এ বার কয়েক কদম এগিয়ে তিনি বলেন, 'আপনার দুর্বোধ্য ও খামখেয়ালি ব্যবহারের জন্য আপনার মন্ত্রী ও আমলারা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন৷ নির্ভয়ে কেউ আপনাকে কোনও কথা বলতে পারেন না৷ এই পরিস্থিতিকে অস্বাস্থ্যকর বললেও কম বলা হয়৷' তবে এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি তিনি৷ চিঠিতে 'বন্ধুসুলভ পরামর্শ' দিয়ে মমতাকে তাঁর বার্তা, 'নিজেকে না বদলালে এবং আরও সহিষ্ণু না হলে খুব বেশিদিন মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না৷'
গত এক বছরে একাধিকবার কলকাতায় এসেছেন কাটজু৷ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘক্ষণ কথাও হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি না লিখে সচিবকে লিখলেন কেন? 'এই সময়ের' প্রশ্নের উত্তরে তাঁর জবাব, 'মুখ্যমন্ত্রীর ইমেল আইডি আমার কাছে ছিল না৷ তাই নন্দিনীকে লিখেছি৷ আর সংবাদসংস্থাকে ইমেল ফরোয়ার্ড করেছি, যাতে আমার কথা গোপন না থাকে৷' ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যেও ফেসবুকে মত প্রকাশ করা নিয়ে গ্রেফতারির ঘটনা ঘটেছে৷ প্রধানমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে মন্তব্য করায় ১৫ দিন হাজতবাস করতে হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার দুই কর্মীকে৷ তা হলে শুধু পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়েই বারবার সরব হচ্ছেন কেন কাটজু? 'এই সময়'এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমি ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও গিয়েছি৷ কিন্ত্ত পশ্চিমবঙ্গের মতো এত সন্ত্রস্ত অবস্থা দেশের আর কোথাও নেই৷' রাজ্যের এই পরিস্থিতি কি তবে সাতের দশকের জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে তাঁকে? 'না৷ আমি মনে করি না বাংলায় সেই পরিস্থিতি তৈরি হবে৷ এই মাটিতে সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের মতো বিপ্লবীরা জন্মেছেন৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলেও বাঙালির কণ্ঠরোধ করতে পারবেন না৷'
মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে উদ্ধতি দিয়ে কাটজু লিখেছেন, 'ভাল পরামর্শদাতা নিয়োগ করে যিনি তাঁদের পরামর্শ শোনেন তিনিই সফল শাসক৷ তাঁদের কথা শুনে চড়ান্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যই আপনি নেবেন৷ কিন্ত্ত আপনার পরামর্শদাতারা যেন নির্ভয়ে তাঁদের মত দিতে পারেন'৷ কাটজুর এই পরামর্শ অবশ্য গ্রাহ্য করেননি মুখ্যমন্ত্রী৷ তিনি বলেছেন, 'আমার সরকার মানবিক৷ দানবিক বা পাশবিক নয়৷ সংবিধান মেনে, রীতি মেনেই আমরা সরকার চালাব৷ আমার সরকারকে কেউ ব্ল্যাকমেল করবে, ধমকাবে, চমকাবে, নিজের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করবে তা আমি মানব না৷'
কাটজুর এই পত্রবোমা প্রত্যাশিত ভাবেই খুশি করেছে বিরোধী শিবিরকে৷ বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, 'বিচারক কাটজু মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধুসুলভ পরামর্শদাতা৷ কিন্ত্ত মুখ্যমন্ত্রী যে উত্তর দিয়েছেন তা মোটেই বন্ধুর মতো নয়৷ আসলে বিরোধী হোক বা সংবাদমাধ্যম বা সাধারণ মানুষ - কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাব দেখতে পাই আমরা৷'
http://eisamay.indiatimes.com/-/--/articleshow/17427967.cms
সিঙ্গুর: মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। শুক্রবার সিঙ্গুরে মমতার প্রশাসনিক বৈঠকের দিনই সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা জানিয়ে দিলেন 'মাস্টারমশাই'। অব্যাহতি চান দলীয় বিধায়ক পদ থেকেও। তবে দল বা সরকারের উপর অভিমান নয়, নিছকই শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ইস্তফা দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
গত কয়েক দিন ধরেই তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। দলে তোলাবাজি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এদিন অবশ্য তুলনায় অনেকটাই সুর নরম ছিল তাঁর। সিঙ্গুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত নতুন প্রকল্প ও প্রয়াসকে সাধুবাদ জানান তিনি। পাশাপাশি দাবি করেন যে শুক্রবার ঘোষিত প্রকল্পগুলির প্রস্তাব তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রেখেছিলেন। তাঁর কথা রাখার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান রবীন্দ্রনাথ। দলে তোলাবাজির বিরুদ্ধে এর আগে প্রশ্ন তুললেও এদিন তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেত-কর্মী সত্ বলে দাবি করেন রবীন্দ্রনাথ। অপমানিত না হলে তাঁর দল ছাড়ার কোনও প্রশ্ন নেই বলেও জানিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মন্ত্রিত্ব ছাড়ার কথা বললেও, এ বিষয়ে সরকারি ভাবে তাঁর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন যে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, "আপনাকে ছাড়া যাবে না।" অভিমান থেকেই তাঁর সরে যাওয়া কিনা, সে বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে অস্বীকার করেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, "অভিমানের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। আমি অসুস্থ। ৮০ বছর বয়স হয়েছে। এক বছর আগে ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। তাই অব্যাহতি চাইছি। কয়েক দিন দলের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করব। তারপর বিধানসভার স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করব।"
দলের প্রতি কোনও অভিমান নেই বলে দাবি করলেও, সিঙ্গুরে এদিনের বৈঠকে তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে কথা উঠলে স্পষ্ট ধরা পড়ল অভিমান। সিঙ্গুরের বৈঠকের বিষয়ে জানিয়ে দিন কয়েক আগে তাঁর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে ফোন আসে বলে জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বলা হয় ৩০ নভেম্বর সিঙ্গুরের বৈঠকে থাকতে। এতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এ সমস্ত ক্ষেত্রে লিখিত ভাবে জানানোটাই রেওয়াজ। তবে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কেউ বা মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হলে, তা তিনি কখনোই ফিরিয়ে দিতেন না বলে জানিয়েছেন।
http://eisamay.indiatimes.com/rabindranath-has-send-his-resignation/articleshow/17429674.cms
রবীন্দ্রনাথের পর দল ছাড়ার ইঙ্গিত ক্ষুব্ধ শোভনদেবেরও
দশ দিন আগেই দেড় বছর পূর্ণ করেছে নতুন সরকার৷ মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটিয়ে এবং নতুন মুখ এনে নয়া উদ্যমে কাজে নামার প্রস্ত্ততিও নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ শুক্রবারই তাঁর সিঙ্গুরে প্রশাসনিক বৈঠক করার কথা৷ তার আগে সিঙ্গুরের বিধায়ক এবং বিধানসভার মুখ্য সচেতকের বিদ্রোহ রাজ্য রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে৷ বিরোধীরা ইতিমধ্যেই এ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷ রাজনৈতিক মহল মনে করছে, রবীন্দ্রনাথবাবু এবং শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বিদ্রোহে অটল থেকে শেষ পর্যন্ত দল ছাড়লে তৃণমূলের সাংগঠনিক ক্ষতি খুব বেশি হবে না৷ কিন্ত্ত ভোটবাক্সে তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল৷ এই দুই নেতারই পুঁজি দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তি৷ মমতা যেখানে দুর্নীতির অভিযোগকে হাতিয়ার করে কংগ্রেসকে আক্রমণ এবং 'কেন্দ্রের বন্ধু' বলে সিপিএমকে গালমন্দ করছেন, তখন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এই দুই নেতাকে দল ছাড়তে হলে তৃণমূলের মুখ পুড়বে৷
মঙ্গলবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলের কর্মচারী ইউনিয়নের একাংশ শোভনদেববাবুকে হেনস্থা করে৷ তাঁকে গলা ধাক্কা দেওয়া হয়৷ তিনি বলেন, 'সিপিএম বা কংগ্রেস মারলে গর্ববোধ করতাম৷ কিন্ত্ত দলেরই কিছু লোক যে ভাবে আমাকে অপদস্থ করেছে তা মেনে নিতে পারছি না৷ আমি মানসিক ভাবে খুবই বিপর্যস্ত৷'
দল ছাড়ার প্রসঙ্গে রাসবিহারী কেন্দ্রের এই বিধায়ক বলেন, 'মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীর নাম করে জোড়াসাঁকো থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি৷ দু'দিন দেখি পুলিশ কী করে, তার পর সিদ্ধান্ত নেব৷'
রবীন্দ্রনাথবাবুও থেমে নেই৷ কৃষি দফতর হাতছাড়া হওয়া নিয়ে এ দিন তিনি প্রকারান্তরে মুখ্যমন্ত্রীকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন৷ ক'দিন আগেই মমতা প্রকাশ্যে দাবি করেছিলেন, তিনি কাটমানি নিয়ে দল চালান না, প্রয়োজনে নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করে দল চালাবেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর এই স্বচ্ছতার দাবিকেই কার্যত চ্যালেঞ্জ ঠুকে সিঙ্গুরের বিধায়ক বলেন, 'আমি কৃষিমন্ত্রী থাকাকালীন ধান-গমের বীজ কেনা নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম৷ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত উপাচার্যকে সরিয়ে দিয়েছিলাম৷ তার পরও আমাকে কেন কৃষি দফতর থেকে সরানো হল বোঝা যাচ্ছে না৷' দু'দিন আগেই এই বিদ্রোহী বিধায়ক প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলেছিলেন, তৃণমূলের লোকজনই রাজ্যে তোলাবাজি চালাচ্ছে৷
বেশ কয়েক মাস আগেই এই অভিযোগ তুলেছিলেন শোভনদেববাবুও৷ এ দিন তিনি কাটমানি নিয়ে দলনেত্রীকে একহাত নিয়েছেন৷ তিনি বলেন, 'মুখ্যমন্ত্রী তো প্রকাশ্যেই কাটমানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন৷ নিশ্চই ওঁর কাছে খবর আছে দলের কারা তোলাবাজির সঙ্গে যুক্ত৷ তা হলে উনি তাঁদের দল থেকে বের করে দিচ্ছেন না কেন?' ক্ষোভ উগরে দিয়ে শোভনদেববাবু বলেন, 'আমি তৃণমূলের প্রথম বিধায়ক৷ দল আমায় মন্ত্রী করেনি৷ সে জন্য কোনও দিন ক্ষোভ প্রকাশ করিনি৷ মন্ত্রিত্বের মোহ আমার নেই৷ আমি কোনও সিন্ডিকেটের নেতা নই৷ শুধু চেয়েছিলাম সম্মান নিয়ে রাজনীতি করতে৷ কিন্ত্ত সেটাই পারছি না৷'
দলীয় সূত্রে খবর, শোভনদেববাবুর বিদ্রোহের পিছনে শুধু মঙ্গলবারের ঘটনাই দায়ী নয়৷ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই মমতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরে৷ এর পিছনে অন্যতম কারণ হল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনে দখলদারি৷ শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু এবং দোলা সেনকে দলের শ্রমিক সংগঠনের মাথায় বসাতেই প্রতিবাদ করেন শোভনদেববাবু৷ নেত্রীর আস্থা হারালেও এই প্রবীণ শ্রমিকনেতা কিন্ত্ত দমে যাননি।
ক্ষোভের আঁচ পেয়ে সুর নরম মুখ্যমন্ত্রীর
প্রশ্নটা এড়ানো যাচ্ছে না৷
সিঙ্গুরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার এক দিন আগে বৃহস্পতিবার দিনভর তিনি নিজে এবং সহকর্মী নেতা-মন্ত্রীদের নামিয়ে যে ভাবে নানা ক্ষেত্রে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করলেন, তার সঙ্গে আজকের মুখ্যমন্ত্রী কিংবা একদা বিরোধী নেত্রী 'অগ্নিকন্যা' মমতার অমিল অনেকটাই৷ এই প্রথম জমি আন্দোলনের আঁতুড়ঘর সিঙ্গুরে গেলেও সেখানে কোনও জনসভা করছেন না মমতা৷ পুলিশি ঘেরাটোপে প্রশাসনিক বৈঠক করেই কলকাতায় ফিরে আসছেন৷ কিন্ত্ত সিঙ্গুর যে আজও রাজনীতিতে তাঁর হাতিয়ার, সে বার্তা দিতেও ভুল করেননি৷ বৃহস্পতিবার আচমকাই মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সিঙ্গুরবাসীকে বার্তা দিয়েছেন, 'আমি আপনাদের পাশে আছি৷' একই সঙ্গে ঝুলি থেকে বের করে এনেছেন তাঁর জমি আন্দোলনের স্মৃতি৷ বলেছেন, 'সিঙ্গুর থেকেই জমি আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম আমি৷ সেখানে বিডিও অফিসে হেনস্থা করা হয়েছিল আমাকে৷ তাই সেই অফিসেই শুক্রবার প্রশাসনিক বৈঠক করব৷'
সিঙ্গুরে তাঁর জমি আন্দোলনের অন্যতম মুখ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বিদ্রোহ করেছেন৷ সেই সিঙ্গুরেই বুধবার জনতার বিক্ষোভের মুখে পড়েন তাঁর কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না৷ দল ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিধানসভায় সরকারের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়৷ তেহ ও দুবরাজপুরে পুলিশের গুলি চালনার জন্য তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে সেই সবগুলি প্রসঙ্গই সামনে এনে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷
এর পাশাপাশি রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ হাকিমকে দিয়ে শোভনদেববাবুকে শান্ত করারও চেষ্টা চালিয়েছেন মমতা৷ সুব্রতবাবু নিউ সেক্রেটারিয়েটে তাঁর দফতরে ডেকে শোভনদেববাবুকে চা খাইয়ে 'সুখ-দুঃখে'র গল্প করেছেন৷ বলেছেন, 'তুই দলের নিষ্ঠাবান সৈনিক৷ তোর অসম্মান হয়, এমন কোনও কিছুর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে দিকে আমাদের নজর থাকবে৷' আর ফিরহাদ হাকিম ফোনে শোভনদেববাবুকে বলেন, 'আপনি দলের প্রবীণ নেতা৷ কারও আচরণে দুঃখ পেয়ে থাকলে, আমরাও দুঃখিত৷ তবে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন৷'
চলতি মাসেই প্রথমে বীরভূমের লোবা গ্রামে ও পরে নদিয়ার তেহে পুলিশের গুলির ঘটনা বাম জমানার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দিনগুলির স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে৷ লোবার ঘটনায় মমতার সরকারের বিরুদ্ধেও জোর করে জমি নেওয়ার অভিযোগ ওঠে৷ কিন্ত্ত এ ব্যাপারে বাম সরকারের থেকে তাঁর অবস্থান যে ১৮০ ডিগ্রি উলটো, সিঙ্গুর সফরের আগে সে কথাও স্মরণ করিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তিনি বলেন, 'দুবরাজপুরে পুলিশ ঠিক কাজ করেনি৷ তদন্ত চলছে৷ পুলিশ প্রশাসনের যাঁরা দোষী, তাঁদের শাস্তি হবে৷' সেই সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'কোনও অবস্থাতেই আমার সরকার কৃষকের আপত্তি উপেক্ষা করে জমি নেবে না৷' সিঙ্গুরের বিদ্রোহী বিধায়ক তথা মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথবাবু সম্পর্কে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে এদিনও মুখ খোলেননি৷ তবে দল ও প্রশাসনে কারও বেয়াদবি যে তিনি বরদাস্ত করবেন না, তা-ও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন৷
এ দিন তেহের গুলিচালনার প্রসঙ্গও টেনে আনেন মুখ্যমন্ত্রী৷ জমি নয়, তেহের ঘটনার সঙ্গে যদিও যুক্ত ছিল আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'সেখানেও গুলিচালনা অন্যায় হয়েছে৷ বিচারবিভাগীয় তদন্ত যাতে নিরপেক্ষ হয়, সে জন্য সেখানকার মহকুমা শাসক ও মহকুমা পুলিশ আধিকারিককে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷'
তোলাবাজির তিরেই তৃণমূলকে তোপ বু্দ্ধ-গৌতমের
নিজের দলের নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে সিঙ্গুরের প্রবীণ তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের 'তোলাবাজি'র অভিযোগকে পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে 'হাতিয়ার' করতে কোমরবেঁধে নামল সিপিএম৷ এমনকী স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে 'তোলাবাজি'র অভিযোগ এনে তীব্র আক্রমণ শানালেন গৌতম দেব৷ 'তোলাবাজদের সরকার' চলছে বলে কটাক্ষ করলেন বিমান বসু৷ আর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতির সঙ্গেই তোলাবাজির বিষয়টিকে যুক্ত করেছেন৷ তাঁর তোপ, 'সমাজবিরোধীরা সাহস পাচ্ছে সরকারের মনোভাবে৷'
মোদ্দা কথা, প্রবীণ তৃণমূল নেতার উত্থাপিত তোলাবাজি-বিতর্ক থেকে সম্ভাব্য রাজনৈতিক মাইলেজের সুযোগ নষ্ট করতে চাইছেন না সিপিএম নেতৃত্ব৷ বুধবার উত্তর শহরতলির সিঁথিতে জনসভার মঞ্চে এবং কামারহাটিতে যুব ফ্রন্টের শিক্ষাশিবিরে--দফায় দফায় এই হাতিয়ারেই শান দিয়েছেন সিপিএম নেতারা৷
বাসভাড়া বৃদ্ধির মতো বিষয়ে আমজনতার মধ্যে অসন্তোষ সত্ত্বেও সেটাকে ব্যবহার করতে না পারায় বামফ্রন্টের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল৷ শরিকদের কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুকে৷ সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই এ বার শুরু থেকেই ঝাঁপাচ্ছে সিপিএম৷ আর বিতর্কের সূত্রপাত যেহেতু সিঙ্গুরের বিধায়কের মুখে, ছ'বছর আগে সেখান থেকে ন্যানো-বিদায়ের লাঞ্ছনার প্রত্যাঘাতেও মরিয়া বুদ্ধবাবু, গৌতমবাবুরা৷
সিঁথির জনসভায় গৌতম দেব প্রশ্ন তোলেন, 'আমরা তো মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাকা তোলেন কী করে? উনি বলছেন নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করে টাকা তোলেন৷ সে ছবি কারা কেনে?' প্রশ্ন তুলেই অবশ্য থামেননি গৌতম৷ তাঁর ভাষায়, 'উনি তো হয় ঘাসফুল নয় কাশফুলের ছবি আঁকেন৷ কারা এই ছবি কিনছে, কেন বলছেন না উনি? এটাও এক ধরনের তোলাবাজি৷ আমি ছবি আঁকব, তুমি এই দামে ছবি কিনবে--এটাই তো তোলাবাজি৷' রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বিতর্কিত মন্তব্যের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও একাধিকবার বলেছেন যে তৃণমূলের নামে কেউ টাকা চাইলে দেবেন না৷ মুখ্যমন্ত্রীর আগের সেই বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে কামারহাটির শিক্ষাশিবিরে বিমান বসুর মন্তব্য, 'মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেছেন যে তোলাবাজি হচ্ছে তখন নিশ্চয়ই তাঁর কাছে রিপোর্ট আছে৷ এখন তোলাবাজরা যদি মনে করে যে এটা তাদেরই সরকার, তা হলে কী হবে!' রাজ্যের নানা জায়গায় গণ্ডগোলের পিছনেও এই তোলাবাজিই দায়ী বলে মত সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের৷
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও রাজ্যের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে তোলাবাজির বিষয়টিকে যুক্ত করেছেন৷ সিঁথির জনসভাতেই বুদ্ধদেবের কটাক্ষ, 'আইনশৃঙ্খলা কোথায় যাচ্ছে? চুরি-ডাকাতি আগেও হত৷ কিন্ত্ত গত দেড় বছরে যা হয়েছে তা আগে কখনও হয়নি৷ তোলাবাজি হচ্ছে৷ গুন্ডামি হচ্ছে৷ মহিলাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হচ্ছে৷' বামফ্রন্ট জমানায় বানতলার মতো ঘটনা ঘটলেও নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে তাঁর দাবি৷ অভিযুক্তদের সবাই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷ বামফ্রন্ট সরকার আইনানুগ ব্যবস্থা নিত, কিন্ত্ত তৃণমূল জমানায় মহাকরণের মনোভাবের কারণে সমাজবিরোধীরা সাহস পাচ্ছে বলে অভিযোগ বুদ্ধবাবুর৷ তাঁর প্রশ্ন, 'কেউ এখন গ্রেফতার হচ্ছে? শাস্তি পাচ্ছে? উল্টে মহাকরণ থেকে বার্তা যাচ্ছে যে কিছুই হয়নি৷ সমাজবিরোধীরা সাহস পাচ্ছে সরকারের এই মনোভাবের জন্যেই৷'
তোলাবাজির পাশাপাশি 'সাম্প্রদায়িক' বিজেপির বাড়বাড়ন্তের জন্যও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকেই দায়ী করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর অভিযোগ, 'এই সরকার সূক্ষ্মভাবে সাম্প্রদায়িকতা করছে৷ তাই বিজেপি মাথা তুলছে৷ এই সরকারের কাজ দেখে বিজেপি মাঠে নেমেছে৷' এফডিআই নিয়ে তৃণমূলের অনাস্থা প্রস্তাবের কৌশলকেও বিঁধেছেন বুদ্ধদেব৷ তাঁর কটাক্ষ, 'ওদের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধিই নেই!'
নয়াদিল্লিঃ কয়েকদিন আগেই শহরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কাটজু৷ তিনি বলেছিলেন দলে শুধু ইয়েসম্যান-ই পছন্দ মমতার৷এবার কার্যত নজিরবিহীনভাবে একধাপ সুর চড়িয়ে মমতার কড়া সমালোচনা করে তাঁকে ই-মেল পাঠালেন তিনি৷ মমতা খামখেয়ালি আচরণ করছেন বলে অভিযোগ জানিয়ে অতীতে তাঁর প্রশংসায় সরব হওয়া কাটজু বলেছেন, সবাই আপনাকে ভয় পায়৷ খোলা মনে পরামর্শ দিতে পারছেন না মন্ত্রী-আমলারাও৷ আচরণ না বদলালে এবং আরও সহিষ্ণু না হলে মমতা বেশিদিন মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না বলেও তাঁকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এই প্রাক্তন বিচারপতি৷ সাম্প্রতিক অতীতে যাঁরা নানা সময় প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর রোষে পড়ে তাঁর 'অসহিষ্ণুতার শিকার' হয়েছেন বলে অভিযোগ, সেই অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরি, তানিয়া ভরদ্বাজের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও অভিমত জানিয়েছেন কাটজু৷ এও বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভুল স্বীকার করে দময়ন্তী সেনকে আগের পদে ফেরানো উচিত বলেও ই মেল বার্তায় উল্লেখ করেছেন তিনি৷
ই মেলটি এইরকম,
প্রিয় মমতা,
আপনি জানেন, বাল ঠাকরের শেষকৃত্যের দিনে গোটা মুম্বই যেভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, ফেসবুকে আপত্তি জানানোয় এক তরুণীকে গ্রেফতার করা হয়৷ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী সেই পুলিশকর্তাকে সাসপেন্ডের নির্দেশ দিয়েছেন৷
যে পুলিশকর্তা যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র এবং শিলাদিত্য চৌধুরীর গ্রেফতারের নির্দেশ দেন, তাঁর বিরুদ্ধেও আপনাকে একই ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করব৷ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি আপনার ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত৷ দময়ন্তী সেনকে যেরকম অন্যায়ভাবে বদলি করা হয়েছে, সেজন্য তাঁর কাছেও আপনার প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত৷ মানুষমাত্রেই ভুল হয়৷ কিন্তু, যিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে নেন, তিনিই আসল ভদ্রলোক৷ একটি ইংরেজি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে তানিয়া ভরদ্বাজকে আপনি যেভাবে অপমানিত করেছেন, তাঁর কাছেও আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত৷
আমি বলতে পারি, ক্ষমা চেয়ে নিলে শুধু রাজ্য নয়, গোটা দেশের মানুষের আপনার প্রতি সম্মান অনেক বেড়ে যাবে৷
কলকাতা সফরে গিয়ে দেখেছি, মন্ত্রী ও আমলারা আপনার সামনে খোলা মনে কথা বলতে ভয় পান৷ আপনার খামখেয়ালি আচরণে তাঁরা আতঙ্কিত৷ এককথায় বলতে পারি, রাজ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ আচরণ না বদলালে এবং আরও সহিষ্ণু না হলে আপনি বেশিদিন মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না৷
অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বলেছেন, সফল শাসক তিনিই, যিনি ভাল পরামর্শদাতা নিয়োগ করেন এবং তাঁদের পরামর্শ শোনেন৷ পরামর্শ শুনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রী নেবেন৷ তবে পরামর্শদাতাদের নির্ভয়ে মতপ্রকাশের পরিবেশ থাকা উচিত৷ এপ্রসঙ্গে আমি বলতে পারি, দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার পটেল তাঁর সচিবদের বলেছিলেন, তাঁরা যেন নির্ভয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করেন৷ সেই মত, তাঁর মতামতের বিরোধী হলেও তাতে তিনি কিছু মনে করবেন না৷ কারণ মনের কথা না বললে, সেই পরামর্শ কাজে আসবে না৷ আপনারও এভাবেই চলা উচিত৷
এখনও দেরি হয়নি৷ আমার কথা শুনে আপনি আচরণ পাল্টান৷ আমি আপনার শুভাকাঙ্খী৷ আপনার মনে থাকবে, একসময় আমিও আপনার প্রশংসা করেছি৷ কিন্তু, সম্প্রতি আপনি ক্রমাগত অসিহষ্ণু ও খামখেয়ালি হয়ে উঠেছেন৷ এতে আপনিই বড়সড় সমস্যায় পড়বেন৷
জাস্টিস কাটজু
এদিকে নাম না করে কাটজুর সমালোচনার জবাবে পাল্টা কটাক্ষ-বিদ্রূপ করেছেন মমতাও৷ কাটজু প্রসঙ্গ এড়িয়ে তাঁর মন্তব্য, কারও কোনও চিঠি পাইনি৷ পাশাপাশি তিনি ফের আক্রমণ করেছেন এবিপি আনন্দকেও৷ নিন্দুকদের সমালোচনা করে তিনি এও বলেছেন, 'রাজা চলে বাজার, কুত্তা ভোকে হাজার', যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, রাজা যাচ্ছেন বাজার, পিছনে কুকুর ডাকছে হাজার!
একদিকে ফের কাটজুর কড়া সমালোচনা, অন্যদিকে নানা প্রশ্নে বিরোধীদের মুখ খোলার জবাবে মুখ্যমন্ত্রীর এহেন প্রতিক্রিয়ায় প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি সব সমালোচককেই একসঙ্গে জবাব দিলেন তিনি?
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, শুভাকাঙ্খীরাই এখন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন! রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরির প্রতিক্রিয়া, অসহিষ্ণু মমতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির কটাক্ষ, বেপরোয়া নীতিতে চলছে সরকার৷
http://abpananda.newsbullet.in/national/60/30745
ক্ষমতায় মমতা... সুকুমার মিত্র | Issue Dated: ডিসেম্বর 25, 2011
মরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে৷ এসএমএসে এই বার্টি পেয়েছিলাম 20 মে, 2011পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ওই রাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে৷ এসএমএস বার্টি প্রত্যাশিত বলেই সেই রাতে মনে হয়েছিল৷ কিন্তু কার্যত মুখ্যমন্ত্রী মমতা চাইলেও তাঁর সঙ্গীদের অনেকেই সার বুঝে 'রাজা' না হয়ে মন্ত্রী হতে বেশি আগ্রহী ছিলেন৷ কারণ এই দেশে মন্ত্রী হওয়ার যে ঢের মজা রয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর এই 'রাজা'-র নৈতিক, মানবিক দায়িত্ব তো অনেক৷ সেই দায়িত্ব থেকে মন্ত্রীর তকমাটা তাঁদের কাছে শ্রেয় ছিল৷ চড়়াই উতরাই-এর গত ছয় মাসে নানা সমস্যার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অধিকাংশ মন্ত্রী ও মন্ত্রিত্ব প্রত্যাশীরা অন্যতম প্রধান সমস্যা বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহল৷ ওই মহলের মতে, 'বোঝার ওপর শাকের আঁটি' হয়েছে সরকার পোষিত নানা কমিটির সদস্যদের অধিকাংশ সদস্য৷ এটা ঠিক, টানা 34 বছরের বাম জমানার পর মাত্র ছয়মাসে রাজ্যটার খোলনলচে বদলে স্বর্গরাজ্য হয়ে যাবে এমনটা কেউ ভাবেনও নি৷ কিন্তু বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সুকৌশলে হাসপাতালের বেহাল দশা, শিক্ষা কাঠামো ভেঙে পড়া, আইনশৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করেছেন, এই প্রশ্ন তোলা হচেছ৷ এই দায়িত্বজ্ঞানহীন বিরোধী দলগুলির বর্তমান রাজ্য সরকারের সমালোচনা করা বা কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ঔদ্ধত্য দেখলে মনে হয় না তাঁরা জনগণের রায় থেকে কোনও শিক্ষা গ্রহণ করেছেন৷ তবে এ কথাও ঠিক ছয়মাসের এই সরকার কাজ করতে গিয়ে চলার পথে কোথাও যদি অনিচছাকৃত ভুল বা বেঠিক কোনও পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তাহলে মানুষ দায়ী করবে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে৷ কেন না তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে দেখে নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখেই তাদের যাবতীয় আস্হা ও বিশ্বাসকে স্হিত করতে চেয়েছেন৷ ফলত, সরকার যদি কোনও ভুল পদক্ষেপ অসতর্কভাবেও নেয় তার কঠিন মাশুলও কিন্তু দিতে হবে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই৷ তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেসের জোট সরকার নামে হলেও পশ্চিমবঙ্গবাসী কিন্তু রাজ্যের দায়িত্বভার তুলে দিয়েছেন আবেগপ্রবণ বাংলার এক সাধারণ মেয়ে থেকে প্রায় মিথ হয়ে ওঠা এই মানবীকে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বাংলার মানুষের কাছে তিনি আজও 'মমতা' হিসেবে বেশি জনপ্রিয়৷ আর এটাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাছে যেমন সম্পদ, তেমনি আমজনতার আশাভঙ্গ হলে বড় বিপদ বা আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ পশ্চিমবঙ্গবাসী মমতাকে চিনেছেন৷ প্রশ্ন একটাই৷ খোদ তাঁর হাতে গড়া দল তৃণমূল কংগ্রেসের এক বড় অংশের নেতা ও নেতৃস্হানীয় কর্মীরা মানুষের আন্দোলনের আবেগকে মূল্য দিতে কতটা আগ্রহী্ট সত্যি কি কোনও মূল্য দেন্ট তাঁরা হয়তো জানেনও না, মমতা মানুষের অন্তরের দর্পণ৷ তবে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি কিন্তু একা, বড়ই একা৷ মাঠটাকে বড় করতে গিয়ে তাঁর এই একাকীত্ব ক্রমশ বেড়েছে,বেড়েই চলেছে৷ সংসদীয় কোঠারি রাজনীতি মমতার আবেগে চলার এই পথকে কতটা অনুমোদন দেবে সেটার ওপর নির্ভর করছে রাজ্য সরকারের ভবিষ্যৎ সাফল্যের চাবিকাঠি৷ কারণ দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস করলেও মন্ত্রিসভার এক বড় অংশেরই তৃণমূলস্তরের মানুষের সঙ্গে কোনও যোগসূত্র নেই৷ আর এই কারণে নিচুতলার মানুষের সঙ্গে যোগসূত্রটা এখনও যিনি ধরে রেখেছেন তিনি হলেন মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী, এক ও অদ্বিতীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মুখ্যমন্ত্রীর জেদ, প্রতিজ্ঞা, স্বপ্নিল ভাবনা রাজ্যকে বাম আমলে গেঁড়ে বসা সাড়ে তিন দশকের নানা জড়তা কাটিয়ে একটা গতিশীলতা যে দ্রুত এনে দিতে পেরেছে একথা স্বীকার করতেই হবে৷ কিন্তু ভাঁড়ার শূন্য এই রাজ্যের একটা বাজেট প্রণয়ন করে তিনি দক্ষতার একটা নজির গড়তে পারতেন৷ রাজ্য পরিচালনার এই বিশাল কাজে তাঁর মন্ত্রিসভা তাঁকে সাহায্য করলে বাজেট তৈরি করা একটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল না৷ তাতে মন্ত্রিদের ব্যত্তিুগতভাবে কাজের জবাবদিহি করার জায়গা থাকত৷ কেন্দ্রীয় সর়কারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মতো উদার আর্থিক সহযোগিতা পেলে চরম আর্থিক সংকট কাটিয়ে রাজ্য চালাতে মুখ্যমন্ত্রীকে এতটা বেগ পেতে হত না৷ এরই মাঝে রাজ্যের মন্ত্রীদের ভাতা বেড়েছে,পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের একাংশের মহার্ঘভাতা বন্ধ রয়েছে৷ এইসব নিয়ে অযথা বিতর্ককে হয়তো এড়ানো যেত৷ মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়প্রমাণ নানা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি দেখালেও আন্তরিকতার কোনও খামতি তাঁর ছিল বা রয়েছে এমন কথা বলা যাবে না৷ আর এই আন্তরিকতার বলেই তিনি পাহাড় ও ডুয়ার্সের সমস্যা সমাধানে একাধিকবার আলাপ আলোচনা করে একটা চুত্তিুতে পাহাড়ের আন্দোলনকারীদের আনতে সক্ষম হয়েছেন৷ সমাধান হয়ে গেছে এমনটা দাবি না করেও বলা যায় সমস্যাকে জিইয়ে না রেখে সমাধানের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন৷ রাজ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে গুরুত্ব না দেওয়ার যে দীর্ঘ অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু ছিল তা ভেঙেছেন মমতা৷ সবার সমর্থনে রাজ্যের নাম ইংরেজি 'ওয়েস্ট বেঙ্গল' থেকে পরিবর্তন করে 'পশ্চিমবঙ্গ'করেছেন৷ বিধানসভার পাশাপাশি বিধান পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিরোধীরা রাজ্য সরকারের আর্থিক ব্যয়ভারের প্রশ্ন তোলায় কমিটি গড়ে সেই কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে আপাতত তা স্হগিত রেখেছেন৷ সদ্য অনুষ্ঠিত কলকাতা চলচিচত্র উৎসবেও এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে 'আমরা-ওরা' বিভেদকে তিনি উপেক্ষা করে সকলকে নিয়ে চলেছেন৷ রাজ্য নাট্যমেলা ঘিরেও কোনও বিতর্ক তুলতে পারেনি বিরোধীরা৷ রাজ্যে তিন দশক ধরে বন্ধ রয়েছে হাজার হাজার কলকারখানা৷ মন্দা শিল্পে জোয়ার আনতে মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন৷ এর আগে রাজ্য ক্ষমতায় আসার আগেও তিনি বণিকমহলের সঙ্গে রেলমন্ত্রী হিসেবে বেশ কয়েক দফায় বসেছিলেন৷ লক্ষ্য ছিল রাজ্যে লগ্নি করতে শিল্পমহলকে একটা স্বচছ বার্ দেওয়া৷ বন্ধ বসুমতী প্রকাশনাকে দ্রুত় চালু করা হবে এমনটা মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে উদ্যোগ নিলেও সেই উদ্যোগে যেন একটা ভাটা পড়েছে বলে ওই সংস্হার কর্মীদের মধ্যে হতাশা দানা বাঁধতে শুরু করেছে৷ ইতিমধ্যে বারুইপুরে সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট কারখানা, মালদা, কোচবিহার, বালুরঘাট, আসানসোল-দুর্গাপুর, মেদিনীপুর, বীরভূ৲ম ও সাগরে বিমানবন্দর, কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ চালুর মতো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে৷ এছাড়া রাজ্য পরিবহন সংস্হার পুনর্গঠন, সামুদ্রিক পণ্য ও ফল সংরক্ষণের জন্য হাওড়া, হুগলি, নদিয়া ও জঙ্গলমহলে হিমঘর তৈরির কাজ শুরু হয়েছে৷ পঞ্চায়েত ও পুরসভা পরিচালনায় গতি ও জনকল্যাণের জন্য মনিটারিং কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ কলকাতার সৌন্দর্য়নের জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে৷ দার্জিলিং, ডুয়ার্স ও দিঘার পর্যটন উন্নয়নের জন্য নানা কর্মসূচি শুরু হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর নির্চনী ইস্তাহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো সিঙ্গুরে অনিচছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল মমতার সরকারের প্রথম ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত৷ সরকারের ওই সিদ্ধান্ত রূপায়ণে আইনি বাধা তুলেছে টাটা মোটরস৷ সময়সীমার মধ্যে রাজনৈতিক বন্দিদের মুত্তিু, জঙ্গলমহল থেকে যৌথবাহিনী প্রত্যাহার ও জঙ্গলমহলের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে ছয়জনের একটি কমিটি গঠন করলেও মাত্র ছয়মাসে সেই কমিটির কার্যকারিতা নিয়ে সরকারপক্ষ, জঙ্গলের আমজনতা, এমনকী, মাওবাদী নেতৃত্ব সকলেই অনাস্হা প্রকাশ করেছে৷ নতুন করে জঙ্গল অশান্ত হওয়ার জন্য 'খতমের রাজনীতি'-তে বিশ্বাসী সিপিআই (মাওবাদী)-দের যদি দায়িত্ব থেকে থাকে তাহলে প্রধান ও নীতিগত দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না তথাকথিত মধ্যস্হতাকারীরা৷ তাঁদের ওপর জঙ্গলবাসী ও মাওবাদীদের আস্হা নেই জানার পরও তাঁরা ওই পদ আঁকড়ে মহাকরণের অলিন্দে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে মুখ উঁচিয়ে থাকেন৷ বুড়িশোলের জঙ্গলে 24 নভেম্বর মাওবাদী পলিটবু্যরো সদস্য কিষেণজি নিহত হওয়ার পর সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য ছাড়া মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রের নেতৃত্বে বাকি পাঁচ সদস্য তাঁদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব ত্যাগ করলেন৷ শাল-পিয়ালের জঙ্গলের রাঙামাটির পথ বা কাঁসাই, শিলাবতী, ডুলং, সুবর্ণরেখা নদীর স্রোত না চেনা, না জানা এই মধ্যস্হতাকারীদের কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে স্বেচছায় সরকারের অর্পিত দায়িত্ব মাঝপথে ত্যাগ করাটা রাজ্যবাসী ভাল চোখে নেয়নি৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জঙ্গলের সমস্যা নিয়ে যখন বেশ বিচলিত তখন প্রায় ছয়মাস সময় কার্যত দায়িত্ব নিয়ে তা সমাধানে তাঁরা সদর্থক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেন৷ মধ্যস্হতাকারীদের এই ব্যর্থতার দায় কার্যত রাজ্যবাসীর একাংশ এঁদের নির্চনের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকেই দায়ী করছেন৷ কারণ অনেক আশা করে বাংলার মানুষ তাঁর হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়েছেন৷ ফলে গোটা রাজ্যবাসীর প্রত্যাশাকে তিনি সম্মান দেবেন এই আশা করেন তাঁরা৷ এমনকী রাজনৈতিক মহলও৷ এদিকে মাওবাদী নেতা কিষেণজির মৃতু্যর পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে, যৌথবাহিনীর অভিযানের মাধ্যমে মাওবাদী সমস্যার আপাত সমাধান হলেও রাজ্যের জঙ্গলমহলেউদ্ভুত সমস্যা সমাধান কোন পথে হবে তা নিয়ে কিন্তু ধোঁয়াশা রয়েই গেছে৷ বিশেষ করে 2008 সালে লালগড়ের ছোটপেলিয়ায় মধ্যরাতে জনজাতিদের গ্রামে পুলিশি বর্বরতার কথা জঙ্গলবাসী ভুলবে কীভাব্টে? কাঁটাপাহাড়ির লক্ষ্মী প্রতিহারের গর্ভস্হ সন্তান পুলিশের লাথিতে মারা যাওয়া, ছোটপেলিয়ার বৃদ্ধা ছিতামনি মুর্মুর চোখ উপড়ে নেওয়া,শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ক্ষমানন্দ মাহাতকে প্রকাশ্যে পুলিশের অপমানের প্রতিবাদে দলিলপুরের চকে প্রকাশ্য সভা থেকে গঠিত পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির 13 দফা দাবির নিষ্পত্তি কবে হব্টে অপরাধী পুলিশ কর্মী, অফিসারদের কোনও শাস্তি হয়নি৷ অরণ্যবাসীর মধ্যে অপমানের সেই ক্ষোভ কিন্তু সুপ্ত থেকেই গেল৷ কোনও উন্নয়ন কর্মসূচি প্রান্তিক এই মানুষগুলোর অপমানের ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারবে বলে মনে হয় না৷ জঙ্গলবাসী আশা করে, মুখ্যমন্ত্রী সেই ঘটনায় জড়িত দোষী পুলিশদের শনাত্তু করে শাস্তির ব্যবস্হা করবেন৷ নতুবা আপাত শান্ত জঙ্গলমহলের মানুষের মনে সুপ্ত অভিমান আকস্মিক কোনও বিস্ফোরণ ঘটালে তা কিন্তু আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে৷ জঙ্গলের প্রশ্ন, শুধু পুলিশে নয়, যেই অরণ্য নিয়ে তাঁদের জীবন সেই বন দফতর ও সেখানে জল বিভাজিকা প্রকল্পের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে কৃষি দফতর জঙ্গলের বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্হানের উদ্যোগ নিলে তা আরও বেশি ফলপ্রসূ হতে পারত৷ বন্দুকধারী স্কোয়াড ও খতমের রাজনীতিতে বিশ্বাসী মাওবাদীদের সঙ্গে জঙ্গলের কোটি কোটি মানুষের সমস্যাকে এক করে দেখার মাশুল দিতে হয়েছে প্রাত্তুন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে৷ সেই কথা যেন বর্তমান রাজ্য সরকার না ভুলে যায়৷ বিনা বিচারে রাজনৈতিক বন্দিদের দ্রুত মুত্তিুর ব্যবস্হা গ্রহণ করা হবে এমনটাই নির্চনী ইস্তাহারে বলা হয়েছিল৷ এছাড়া রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করা হবে জীবন ও সম্পত্তির অধিকার৷ এসবই রাজ্য সরকার প্রথম ছয়মাসের মধ্যে করবে এমনটা প্রতিশ্রুতি থাকলেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি৷ তেমনি মানবাধিকার হরণের ঘটনার ছয়মাসের মধ্যে তদন্ত ও শাস্তির ব্যবস্হা গ্রহণ করা হবে৷ মরিচঝাঁপি, বিজনসেতু, কাশীপুর, বরানগর, শান্তিপুর, ছোট আঙারিয়া,নন্দীগ্রাম, দিনহাটা, বাসন্তী, গোপালপুর, করন্দা, কেশপুর, গড়বেতা, মালোপাড়া, ভিখারি পাশোয়ান সহ জঙ্গলমহলে নেতাই গণহত্যার ইতিহাস মানুষ ভোলে নি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেষ্টা করছেন মানুষ কিন্তু তা প্রত্যক্ষ করছেন৷ দু'হাত তুলে এখনও মমতার সরকারকে সমর্থন করে চলেছেন৷ বিশেষ করে জঙ্গলমহলের জন্য দু'টাকা কেজি দরে প্রতি মাসে আদিবাসী ও উপজাতিভুত্তু সকল পরিবারের 55 কেজি চাল ও গম বিলি বিশেষ অত্যন্ত জরুরি একটি পদক্ষেপ৷ এই সুবিধাভোগীদের বার্ষিক আয়ের উর্ধসীমা রাজ্য সরকার 24 হাজার থেকে বাড়িয়ে 42 হাজার টাকা করেছে৷ যাতে অধিকাংশ জঙ্গলবাসী এই সুযোগ পেতে পারেন৷ এদিকে নানা প্রশ্নে সম্প্রতি খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব কিছুটা হলেও বেড়েছে৷ তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণে নিহত-আহত কংগ্রেস কর্মীদের পরিবারের সমর্থনে কংগ্রেস খোদ কলকাতায় মৌন মিছিল করে সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে বিব্রত করেছে৷ এই ধরনের বিরোধ যদি চলার শুরুতেই প্রকাশ্য রাজপথে নেমে আসে তাহলে বাকি সময় পাড়ি দিতে মুখ্যমন্ত্রীকে যে বেশ বেগ পেতে হবে সে-কথা হলফ করেই বলা যায়৷ আর এর প্রতিফলন যদি কেন্দ্রের আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে পড়ে তাহলে তা রাজ্য সরকারের রত্তু সঞ্চালনকে ব্যাহত করবে৷ অন্যদিকে বাম জমানায় নানা সুযোগ সুবিধা পাওয়া আমলা ও কর্মীরা নানাভাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাজের গতিকে শ্ল্লথ করে দিচেছন৷ অভিযোগ, সুকৌশলে অন্তর্ত চলছে সরকারের বিভিন্ন দফতরে৷ রাতারাতি ভোল পাল্টে শাসক দলের কাছাকাছি হওয়া আমলা,কর্মীরা ক্রমশ শত্তিুশালী শুধু নয়, নিয়ামক হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখাচেছন তা কিন্তু বড় আশঙ্কার কথা৷ আর ওই সব আমলা় কর্মীদের ভূমিকার বিরূপ প্রভাব পড়ছে রাজ্যের সদ্যোজাত সরকারের ঘাড়ে৷ মহাকরণে ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী বেহাল ও বাস্তুঘুঘুর বাসা সরকারি হাসপাতালগুলি আকস্মিক পরিদর্শন করে শোরগোল তুলে দিয়েছিলেন৷ মানুষের আশা ছিল অন্তত কর্মসংস্কৃতির বদল ঘটুক, মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা বন্ধ হোক৷ কিন্তু রাজ্যের 19টি জেলায় সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ, জেলা, মহকুমা,গ্রামীণ হাসপাতাল বা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্হ্যকেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্হ্যকেন্দ্র, উপস্বাস্হ্যকেন্দ্রগুলির হাল পাল্টাতে সল্টলেকের স্বাস্হ্যভবন থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেননি কর্রা৷ এতগুলি শিশুমৃতু্যর ঘটনার পরও প্রতিশ্রুতি মতো জেলায় জেলায় নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট তৈরি হয়নি৷ মুখ্যমন্ত্রী খোদ স্বাস্হ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও হেলদোল দেখা যায়নি স্বাস্হ্য দফতরের অধিকাংশ কর্দের৷ সদ্য পাশ করা চিকিৎসকদের নিয়ে এক সভায় তাঁদের উচচশিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ লক্ষ্য ছিল রাজ্যের স্বাস্হ্যকেন্দ্রের হাল ফেরানো৷ তাঁর প্রতিশ্রুতিতে সাড়া দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আকর্ষণীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্হ্যকেন্দ্রে সম্প্রতি চাকরি নিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে৷ নিয়োগ শুরু হয়েছে চিকিৎসক৷ এটা সম্ভব হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্হ্যমন্ত্রীর আন্তরিক আবেদনে সাড়া দিয়েই৷ ঠিক এইরকম সাড়া সরকারের বিভিন্ন দফতরগুলির অভ্যন্তর থেকে আসত তাহলে হয়তো স্বাস্হ্য পরিষেবা-সহ নানা দফতরের বেহাল দশা থেকে মুত্তিু পেত রাজ্যবাসী৷ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া আগুনছোঁয়া সবজি বাজার৷ বিব্রত মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যবাসী দেখেছেন ছুটে যেতে গড়িয়াহাট মার্কেট, কোলে মার্কেটে সরেজমিন তদন্তে৷ এই উদ্যোগকে অনেকে চমক বলেছেন, কিন্তু এটা কেন আন্তরিক উদ্যোগ ভাবা হবে না? মন্ত্রী ও সংশ্ল্লিষ্ট দফতরগুলির মন্ত্রীদের তো কাজ যেখানে সমস্যা সেখানে দ্রুত ছুটে গিয়ে পরিস্হিতি খতিয়ে দেখা৷ আসলে 34 বছর মহাকরণে ধোপদুরস্ত ধুতি পরা মন্ত্রীদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ও মাঝে মাঝে অলিন্দে এসে বিবৃতি দিয়ে সমস্যা থেকে নিজের ও সরকারের দায়কে এড়িয়ে যেতে দেখে অভ্যস্ত চোখ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর এই কর্মতৎপরতাকে তাঁরা মেনে নিতে পারছে না৷ জঙ্গলমহলের বাইরেও গোটা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে রাজ্যবাসী বেশ উদ্বিগ্ন৷ বিভিন্ন এলাকায় খোদ শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী খুন হচেছ৷ অভিযোগে ধৃত হচেছ তৃণমূল কংগ্রেস নেতা,মন্ত্রী আশ্রিত দুষ্কৃতীরা৷ মহানগরী লাগোয়া কেষ্টপুরে তৃণমূলের কর্মী স্বপন মণ্ডল খুনের অভিযোগে ধৃত দুই দুষ্কৃতী রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পুর্ণেন্দু বসুর ঘনিষ্ঠ৷ বিধানসভা নির্চনী ফলাফল প্রকাশের আগেই হাওড়ার বালিতে খুন হয়েছিলেন হাওড়া জেলা যুব তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি ও জলাভূমি বাঁচাও আন্দোলনের নেতা তপন দত্ত৷ সেই খুনেও ধৃতরা শুধু তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত শুধু নয়, পুলিশের চার্জশিটে রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ের নাম উঠে আসে৷ স্হানীয় ও রাজ্যের বিভিন্ন সংগঠনের চাপে শেষ পর্যন্ত সিআইডি তদন্ত শুরু হলেও সেই তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে সিবিআই তদন্তের দাবি করেছেন নিহত তপনবাবুর স্ত্রী৷ পুলিশের লাঠিচার্জ-এর ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটলেও পুলিশের গুলিতে জঙ্গলমহলের বাইরে গত ছয়মাসে খুন হয়েছে তিন ব্যত্তিু৷ 1 ডিসেম্বর দক্ষিণ 24 পরগনার মগরাহাটে বিদু্যতের হুকিং কাটতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়৷ দুই ব্যত্তিুর মৃতু্য ঘটে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে উপস্হিত থাকলেও তিনি এই বিষয়টি জানেন না বলে মন্তব্য করেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, "মহাকরণেই ছিলাম, আগে জানলে অন্যভাবে সমাধান করতাম৷" পাশাপাশি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম জানিয়েছেন, "ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তা জানতে পেরেছিলাম৷" দুই জনের দু'ধরনের বত্তুব্য শুনে মনে পড়ে যায়, 2007 সালে26 ডিসেম্বর নন্দীগ্রামে জনসভায় দাঁড়িয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, '14 মার্চ পুলিশ গুলি চালাবে জানলে পাঠাতাম না৷' কতকটা সেই কমিউনিকেশন গ্যাপেরই অনুক়রণ৷ যদিও 14মার্চ, 2007 তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, 'ব্লো দেম আপ'৷ পরিবর্তনের পর শোনা গিয়েছিল বিভিন্ন মন্ত্রী ও দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য একটা পৃথক দফতর গঠন করা হবে৷ কিন্তু সেই সমন্বয় সাধনের কোনও লক্ষণ কিন্তু রাজ্যবাসী দেখতে পেলেন না৷ মা-মাটি-মানুষের সরকার বারবার সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের কথা বললেও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে আটজন অফিসারের মধ্যে কিন্তু একজনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্হান হয়নি৷ অভিজিত লাটুয়াকে সংখ্যালঘু উন্নয়নের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ তিনি যে সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এমন কোনও প্রেক্ষাপটের কথা জানা নেই৷ যদিও ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ুত্তু করেছে৷ ওবিসি সংরক্ষণের ফলে এই রাজ্যের পশ্চাদপদ মুসলিমরা নিশ্চয় কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন এটা আশা করা যায়৷ সাচার কমিটির সুপারিশ মেনে সংখ্যালঘু উন্নয়নে ইতিমধ্যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার সাড়াও দিয়েছিলেন৷ রাজ্যের 10 হাজার বেসরকারি মাদ্রাসা সরকারি অনুমোদন পেয়েছে নতুন সরকারের এই ছয়মাসের মধ্যে৷ পাশাপাশি রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের 93 শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন৷ এঁদের নিয়ে সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু কাজ করলেও তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি রয়ে গেছে অবহেলিতই৷ নেই নূ্যনতম মজুরির কোনও নিশ্চয়তা৷ সমাজের সংখ্যাবহুল অংশ হওয়া সত্ত্বেও এঁরা নির্তিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে এই অংগঠিত শ্রমিকদের কিন্তু প্রত্যাশা রয়েছে৷ বিশেষ পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের শ্রম দফতরের কোনও ভাবনার প্রতিফলন কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা দেখতে পাননি বলে অসন্তোষ রয়েছে তাঁদের মধ্যেও৷ তবে চা বাগিচা শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত চুত্তিু করেছে রাজ্য সরকার৷ কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বারবার বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে কোনও বিশেষ কর্মসূচি নেয়নি কৃষি দফতর৷ একফসলি, দোফসলি জমিকে বহুফসলি করার ব্যাপারে সেচ, জলবিভাজিকা প্রকল্প, স্বনির্ভর বীজ ভাণ্ডার তৈরির কোনও কর্মসূচি নেওয়া হয়নি৷ এমনকী কৃষি গবেষণাকে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ গত ছয় মাসে লক্ষ্য করা যায়নি৷ রাজারহাট নিউটাউনে অনিচছুক কৃষকদের 10 শতাংশ অর্ৎ 1687 একর জমি ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রূপায়ণে কোনও উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি৷ অন্যদিকে রাজারহাটের গাঁতি মৌজায় নতুন করে 250 একর জমির ক্ষতিপূরণ নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে হিডকো উত্তর 24 পরগনা জেলাশাসকের মাধ্যমে৷ রাজারহাট জমি বাঁচাও কমিটির সম্পাদক নীলোৎপল দত্ত জানিয়েছেন, ভুল করে আটজন ওই বিজ্ঞপ্তি গ্রহণ করলেও বাকি 270 জন জমির মালিক তা গ্রহণ করেননি৷ আটজন জমির মালিক ভুল করে ওই বিজ্ঞপ্তি গ্রহণ করলেও বাকিরা সকলেই ট্রাক টার্মিনালের জন্য ওই জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ প্রাত্তুন সিপিএম মন্ত্রী গৌতম দেবের সাধের ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্হানীয় বাসিন্দারা জমি দিতে নারাজ৷ শিক্ষাক্ষেত্রে সিপিএমের দলবাজির অভিযোগের পাশাপাশি প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া, সহজপাঠ বাতিল,প্রাথমিক থেকে পাশ ফেল তুলে দেওয়া, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির পরিচালন সমিতি গঠিত হত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নির্দেশে৷ শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে রাজ্যের মানুষ আন্দোলনে সোচচার হয়ে ওঠেন৷ পিটিটিআই ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ ও তাঁদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ায় প্রতিবাদ প্রতিরোধ নতুন মাত্রা পায়৷ রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে এসব ঘটনা অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষাক্ষেত্রে এই দলবাজির আখড়া ভাঙার কথা শুধু মুখের কথায় রাখেননি৷ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের হূতগৌরব ফেরাতে সেখানে মেন্টর গ্রুপে অমর্তয সেন, সুগত বসুদের মতো ব্যত্তিুত্বকে এনে উচচশিক্ষার মান উন্নয়নে ব্রতী হয়েছেন৷ এই ক্ষেত্রে 'ওরা' ও 'আমরা' বিভেদের 'বাম-সংস্কৃতি'কে ভাঙতে তিনি সক্ষম হয়েছেন৷ তবে সিলেবাস বিতর্ক, পাশ ফেল রদ নিয়ে সরকার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই বিতর্ক উঠেছে৷ বাম আমলের পর্বত প্রমাণ সমস্যা যেমন পরিবেশবিদ্যা নিয়ে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ওই বিষয়ে সুকল বা মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনে চাকরির কোনও ব্যবস্হা না থাকা৷ ওই বিষয়ে হাজার হাজার পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত অন্ধকারে রেখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাম সরকার৷ এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষিত বেকাররা তাঁরা সার্ভিস কমিশনে ওই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের দাবি তুলেছেন৷ তাঁদের ভরসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও উচচ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবেন৷ কিন্তু সিলেবাস নিয়ে রাজ্যের উচচ শিক্ষামন্ত্রীর দোলাচলতা শিক্ষাবিদদের তো বটেই রাজ্যবাসীকে বেশ হতাশ করছে৷ তবে একথা ঠিক যেখানে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি প্রায় নেই বললেই চলে এমন কিছু কাজে বর্তমান সরকার বেশ সাফল্যের ছাপ ফেলতে পেরেছে৷ বিশেষ করে হাওড়া-সহ সম্প্রসারিত কলকাতা পুলিশ এলাকার যানজট সমস্যার অনেকটাই সমাধান করতে পেরেছে৷ এই লক্ষে ইতিমধ্যেই গড়া হয়েছে হাওড়া ও আসানসোল পুলিশ কমিশনারেট৷ এরকম পরিস্হিতিতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও প্রবীণ আমলাদের একাংশ মনে করেন, প্রতি দফতরে আরও বেশ কিছু দক্ষ প্রশাসক ও কর্মী নিয়োগ বিশেষ জরুরি৷ পাশাপাশি বিভিন্ন দফতরে বামমন্ত্রী,নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিকড় গজিয়ে বসে থাকা আধিকারিক ও কর্মীদের তাঁদের দফতর থেকে আশু বদলি প্রয়োজন৷ কাজের ক্ষেত্রে কর্মী সংগঠনের খবরদারি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন অনেকেই৷ সরকারি কর্মীদের 'আসি যাই মাইনে পাই' অভ্যাস পাল্টাতে হবে৷ অবসরের পর প্ত-জ্জ বছর চুত্তিুতে কাজ করে সরকারি কর্মীদের বিভিন্ন দফতরে কলকাঠি নাড়ছে নিজেদের স্বার্থে৷ এই ব্যবস্হা বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করেন দক্ষ প্রশাসকরাই৷ মুখ্যমন্ত্রী সচল, কিন্তু গোটা সরকারি পরিকাঠামো ও সংস্কৃতির খোল-নলচে যদি বদল না ঘটানো হয় তাহলে তাঁর কঠোর পরিশ্রম ও আন্তরিকতা পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে৷ তিনি উন্নয়নের ওপর জোর দিচেছন৷ চাইছেন রাজ্যে কর্মসংস্হান সৃষ্টির জোয়ার আনতে৷ রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতিমুত্তু একটা পরিচছন্ন রাজ্যে পরিণত করতে চান পশ্চিমবঙ্গকে৷ আর সম্ভবত এই আবেগ থেকেই তাঁর কলকাতাকে লন্ডন, দিঘাকে গোয়া, পাহাড়কে সুইজারল্যান্ড বানানোর ইচছা৷ সদিচছা থাকলে সব কিছু সম্ভব যেমন সত্যি তেমনি সদিচছা থাকলে একা গোটা রাজ্যকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা-মাটি-মানুষের সরকার কার্যত একঘোড়ার ইঞ্জিন৷ এই ইঞ্জিনটি সচলভাবে ঠিকঠাক কাজ করলে রাজ্য ঠিকঠাক চলবে৷ কোনও কারণে ইঞ্জিন সাময়িক বিকল হল়ে বা অনিচছাকৃত কারণেই যদি ভুল পথে চালিত হয় তবে রাজ্যের ক্ষেত্রে তা বড় অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ সম্ভবত এই সমস্যার কথা স্মরণে রেখে মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সকলকে নিয়ে জেলাস্তরে মন্ত্রিসভার বৈঠক করছেন, ঘনঘন একঝাঁক মন্ত্রীদের নিয়ে সফরে বেরিয়ে একটা যৌথ নেতৃত্ব গড়তে চাইছেন৷ পাহাড় প্রমাণ সমস্যা, দুই লক্ষ আট হাজার কোটি টাকা ঋণের পূর্বতন বাম সরকারের আর্থিক ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে এই রাজ্যকে চালাতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সরকারকে বাস্তবিক জনতার সরকার হতে হবে৷ সম্ভবত গত ছয়মাসে চলার পথে সরকারের নানা সিদ্ধান্তে ও মুখ্যমন্ত্রীর কাজে সেই কথা মনে রেখে তাঁর অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা চালাচেছন৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে মনে হয়, 'পারবে, তুমিই পারবে৷' রাজ্যের মানুষ যে বর্তমান সরকারের ওপর আস্হা হারাতে শুরু করেছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার বোধ হয় সময় এখনই আসেনি৷ সদ্য শেষ হওয়া দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্চনে ছ শতাংশ ভোট কম পড়া সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সুব্রত বক্সী সিপিএম প্রার্থী ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ৰৰ হাজার ভোটের ব্যবধান বাড়িয়েছেন৷ সাম্প্রতিক এই ঘটনা থেকে বিরোধীদের যেমন শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, পাশাপাশি শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বিশেষত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর মানুষ আরও দায়িত্ব বাড়িয়ে দিলেন৷ এই বিষয়টি থেকে তাঁকে ও তৃণমূল কংগ্রেসকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে৷
৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান পশ্চিমবঙ্গে
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটেছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস, জাতীয় কংগ্রেস ও এসইউসিআই জোট। বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে গতকাল ২৮৯ আসনের বেসরকারি ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ২২৪ আসনে জয়ী হয়েছে। আর ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট পেয়েছে ৬০টি। পাঁচটি আসনে জয় পেয়েছে অন্যান্য দল। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পরাজয় মেনে নিয়ে বামফ্রন্ট নেতা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পদত্যাগ করেছেন। যদিও নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। নির্বাচনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজের আসনেও হেরেছেন। এদিকে তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস-ডিএমকে জোটকে লজ্জায় ডুবিয়ে আবার মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন জয়ললিতা। তার দল বিধানসভার ২৩৪ আসনের মধ্যে ২০৪টিতে জয় পেয়েছে। আসামে টানা তৃতীয়বারের মতো জয় পেয়েছে কংগ্রেস। তরুণ গগৈইয়ের নেতৃত্বে বিধানসভার ১২৬ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ৭৬টি। পণ্ডিচেরিতে বিজয়ী হয়েছে অল ইন্ডিয়া এনআর কংগ্রেস। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট। গত বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৬৬ আসনে জয় পেয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনী ফলাফল উল্টে গেছে। নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও রাজ্যের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অর্থমন্ত্রী অসীম দাসগুপ্ত, শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন, তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী দেবেশ দাস, শ্রমমন্ত্রী অনাদি সাহু, গৃহায়ন উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব, পরিবহনমন্ত্রী রঞ্জিত কুণ্ডু, পিডব্লিউডিমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ প্রমুখ। পরাজয়ের পর এরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়সহ দলের সব হেভিওয়েট প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এদিকে সিঙ্গুরে চারশ' একর জমি অনিচ্ছুক কৃষকদের ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল বলে অবশেষে স্বীকার করে নিল সিপিএম। রাজ্যে বামফ্রন্টের শোচনীয় পরাজয়ের পর নিজের তাত্ক্ষণিক অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে একথা বললেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। বিধানসভা নির্বাচনে ১৮ এপ্রিল প্রথম দফায় ৫৪ আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়। এরপর ২৩ এপ্রিল ৫০ আসনে, ২৭ এপ্রিল ৭৫ আসনে, ৩ মে ৬৩ আসনে, ৭ মে ৩৮ আসনে এবং সর্বশেষ ১০ মে ১৪ আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়। কেন্দ্রগুলোতে ভোট গণনা শুরু হয় শুক্রবার সকাল ৮টায়। রাজ্যে বিগত পঞ্চায়েত, পৌরসভা ও লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এবার বিধানসভা নির্বাচনেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকল। এই ভরাডুবির পেছনে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, রেজওয়ান হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ইস্যু মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাত্ : পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়ার লক্ষ্যে গভর্নর বা রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গতকাল বিধানসভা নির্বাচনের ঐতিহাসিক জয়ের পর রাজ্যে নিজেদের দলের সরকার গঠনের দাবি নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুকুল রায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল এমকে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করে আগামী দিনের নতুন সরকার গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সারেন। মমতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। রাজভবনে রাজ্যপালের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার পর সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ আবার ফিরে যান তিনি। তৃণমূল সূত্রে জানা গেছে, আগামী মঙ্গলবার ১৮ মে রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুদ্ধদেবের পদত্যাগ : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পদত্যাগ করেছেন। গতকাল দুপুরে তিনি রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণকারী এই প্রবীণ বামপন্থী নেতা ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তার শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গে মার্ক্সবাদী বাম রাজনীতি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে শাসনামলের শেষ দিকে নন্দিগ্রাম ও দক্ষিণ মণিপুরসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় তার সরকার। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল : সিপিএম : বাম শাসনের পতনকে সাধারণ মানুষের 'পরিবর্তন' প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করেছে বামফ্রন্ট। সাধারণ মানুষের এ রায় মেনে নিয়ে দলের পলিটব্যুরোর এক বিবৃতিতে একথা উল্লেখ করা হয়েছে। বামফ্রন্টের শীর্ষ নেতা সীতারাম ইয়াচুরি এবং বৃন্দা কারাতও একই কথা বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা ছিল তাকেই পুঁজি করে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট এ বিজয় অর্জন করেছে এবং বামফ্রন্টের ভরাডুবি হয়েছে। সেইসঙ্গে দলের পক্ষ থেকে এ ভরাডুবির জন্য সরকারের ভুলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা রাজ্যে বামফ্রন্টের পরাজয় বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য হতাশাজনক। তবে দেশের জন্য বাম সরকারের উন্নয়ন নীতিমালা ও কর্মসূচি অস্বীকার করা যাবে না। শুভেচ্ছ : পশ্চিমবঙ্গের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় বিজয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন। শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কংগ্রেস, এসইউসিআইকে সরকারে আমন্ত্রণ : বিপুল ভোটে জয়লাভ করা তৃণমূল কংগ্রেস-জোটের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গতকাল দলের শরিক কংগ্রেস এবং বাম বিরোধী দল 'সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া'কে তার সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কালীঘাটের বাসভবনে সাংবাদিকদের মমতা বলেন, আমি কংগ্রেস এবং এসইউসিআইকে আমাদের সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। নয়াদিল্লিতে কংগ্রেস নেতা এবং অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত দল এখনও নেয়নি। ওদিকে এসইউসিআই মমতার সরকারে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ নাকচ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে কেবল সিপিআই'র (এম) দীর্ঘদিনের শাসনাবসানের জন্যই তারা তৃণমূল কংগ্রেস জোটকে সমর্থন দিয়েছে বলে জানিয়েছে। এসইউসিআই'র সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের মতবিরোধিতা সত্ত্বেও আমরা কেবল সিপিআইকে (এম) পরাজিত করার জন্যই তাদের সমর্থন করছি। উত্সবের চেহারা : কালীঘাটের ৩৩ হরিশ চ্যাটার্জি রোডে মমতার বাড়ির দলীয় কার্যালয় কার্যত উত্সবের চেহারা নিয়েছে। সেখানে পাঁচ বছরের শিশু থেকে ৭০ বয়সোর্ধ্ব বৃদ্ধ সবার মুখেই সবুজ আবীর মাখা। সঙ্গে দলীয় পতাকা আর মুহুর্মুহু মমতার নামে জয়ধ্বনি। বেলা যত বাড়ে ততই একে একে তৃণমূলকর্মী সমর্থকদের ভিড় বাড়ে অপ্রশস্থ গলিটিতে। কাতারে কাতারে মানুষ একটিবার মমতার দেখা পেতে ভিষণ আগ্রহী। কারও হাতে মিষ্টির হাঁড়ি। কেউবা পেল্লাই সাইজের ফুলের মালা নিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে মমতা উত্সাহী সমর্থকদের দেখা দিতে বারদুয়েক বের হয়ে এলেন। মুহূর্তে উল্লাসের আওয়াজ চরম সীমায় পৌঁছায়। তবে এরই মধ্যে রাজ্যের কর্মীসমর্থকদের শান্তি ও সংহতি বজায় রাখতে তিনি আবেদন জানান। কেরালায়ও জয়ী কংগ্রেস জোট : পশ্চিমবঙ্গের পর কেরালায়ও হেরে গেছে বামপন্থীদের জোট এলডিএফ। রাজ্যের ১৪০টি আসনের মধ্যে ৭২টিতে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ইউডিএফ। ক্ষমতাসীন জোট এলডিএফ পেয়েছে ৬৮ আসন। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৭১টি আসন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে কেরালায় ক্ষমতার পালাবদলের ঐতিহ্য বহাল রইল। গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখা গেছে, এ রাজ্যে প্রতি পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। গতকাল সকাল ৮টা থেকে কেরালায় ভোট গণনা শুরু হয়ে বিকাল পর্যন্ত চলে। এ রাজ্যে মোট ভোটার ২ কোটি ২৪ লাখ ৭৮ হাজার ৭৬৭। এবার ভোট পড়ে ৭৫ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের নেতৃত্বাধীন এলডিএফ ৯৯ আসন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। আর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ৪১টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। তামিলনাড়ু জয়ী এআইএডিএমকে : কংগ্রেস-ডিএমকে জোটকে লজ্জায় ডুবিয়ে আবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন জয়ললিতা। জয়ললিতার অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড়া মুন্নেত্রা কাঝাগাম (এআইএডিএমকে) মিত্র দলগুলোকে নিয়ে বিধানসভার ২৩৪ আসনের মধ্যে ২০৪টিতে জয় পেয়েছে। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৫২ আসন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ডিমকে-কংগ্রেস জোট ৪০টিরও কম আসনে জয় পেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ডিএমকে প্রধান করুণানিধি। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর জয়ললিতা বলেন, গত তিন বছরে আমি যেখানে গেছি সেখানেই লোকজন ডিএমকের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ডিএমকে সরকারের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ার অপেক্ষায় ছিলেন তারা। সুযোগ পেয়েই তারা ঝাল মিটিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন জয়ললিতা। আসামে জয় পেয়েছে কংগ্রেস : বিধানসভা নির্বাচনে আসামে টানা তৃতীয়বারের মতো জয় পেয়েছে কংগ্রেস। তরুণ গোগোইর নেতৃত্বে বিধানসভার ১২৬ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ৭৬টি। বিরোধী দল (আঞ্চলিক দল) এজিপি ১০টি আসনে জয় পেয়েছে। আর বিজেপির ঝুলিতে উঠেছে মাত্র ৪টি। গতবছর ১০টি আসন পাওয়া এ দলটি এবার বুঝি তাও পাবে না। পণ্ডিচেরিতে বিজয়ী এআইএনআরসি জোট : পণ্ডিচেরিতে বিজয়ী হয়েছে অল ইন্ডিয়া এনআর কংগ্রেস তাথা এআইএনআরসি জোট। জোটের অপর দল হলো এআইএডিএমকে। ৩০ আসনের মধ্যে এআইএনআরসি পেয়েছে ১৫টি এবং এআইএডিএমকে পায় ৫টি আসন। তারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। অবসান হচ্ছে ডিএমকে সমর্থিত কংগ্রেসের শাসন। কংগ্রেস পেয়েছে ৭টি এবং ডিএমকে পেয়েছে দুটি আসন। ডিএমকে বিদ্রোহী শিবকুমার একটি আসনে জয় পেয়েছেন। |
No comments:
Post a Comment